করতোয়ার কঙ্কাল!

মেহেদী হাসান নাঈম, কলাম লেখক ও শিক্ষার্থী, [email protected]

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ময়লা কাগজ, পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতল, পচা-মরা পশু-পাখিসহ শহরের সব ধরনের আবর্জনা ভাসছে। এগুলো পচে গিয়ে যে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, তা হয়তো শহরবাসীর নাক অব্দি পৌঁছায় না। পানির মতো দেখতে কালো যেটুকু চোখে পড়ে তা মূলত টয়লেট থেকে আসা শৌচকার্যে সৃষ্ট তরল বর্জ্য। অথবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরল বর্জ্য পদার্থ। এটিকে আর যাই হোক আমি পানি বলতে পারলাম না। টিস্যু, হাট-বাজারের পচা সবজি, এমনকি বাচ্চাদের ব্যবহৃত বেবি ডায়াপার পর্যন্ত স্থান পেয়েছে এখানে। কি ভাবছেন, আমি দেশের কোনো উন্নত মানের স্মার্ট ডাস্টবিনের বর্ণনা দিচ্ছি? না, কোনো স্মার্ট ডাস্টবিন নয়। এটি একসময়ের খরস্রোতা করতোয়া নদী।

দেশের উত্তর জনপদের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের প্রশ্নে শুরুতেই আসবে করতোয়া নদীর নাম। যার রয়েছে গৌরবজ্জ্বল সোনালি ইতিহাস। হাজার বছরের প্রাচীন গ্রন্থ মহাভারতে করতোয়ার কথা উলে¬খ আছে। করতোয়া নদী ছিল গঙ্গা নদীর তিনগুণ। ১১১৫ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গদেশ অভিযানের সময় রচিত একটি গ্রন্থে করতোয়া যে গঙ্গার চেয়ে কত গুণ বড় ছিল তার বর্ণনা দেয়া আছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে করতোয়া নদী পবিত্র। মহাভারত অনুযায়ী ৩ দিন পর করতোয়া দর্শন হচ্ছে অশ্মমেধা অর্থাৎ ঘোড়াকে বলি দেওয়ার সমান। পুরাণে আছে, দেবতা শিব-পার্বতীর বিয়ের সময় শিবের কররেখা থেকে এই নদীর জলধারার উৎপত্তি। করতোয়া নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতের পশ্চিবঙ্গের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের জলপাইগুড়ি জেলার বৈকণ্ঠপুরের অরণ্যগর্ভে। ভুটানের সীমান্ত বেয়ে দার্জিলিং জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর অঞ্চল ছুঁয়ে করতোয়ার জলধারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এঁকেবেঁকে চলা নদীর এই সর্পিল গতি মানব সৃষ্ট দুর্যোগের কবলে পড়েছে অনেক আগেই। নদী কোথাও শীর্ণকায় এক খাল। কোথাও সামান্য পানি তাও দূষণে কালো হয়ে গেছে। কোথাও নদীর মধ্যে তৈরি করা হয়েছে চাষের ভূমি। কোথাও নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অবকাঠামো। নদীর কিছুটা ভেতরে ও নদীর মুখে নির্মিত হয়েছে কংক্রিটের বহুতল ভবন। নদীর ভেতরে নগরীর বর্জ্য আবর্জনা ফেলে বড় ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। পচা গন্ধে এই পথ ধরে হাঁটা যায় না। করতোয়া নদীর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বগুড়া অংশে। নগরীর রেলব্রিজ সংলগ্ন নদী ভূমি দেখে মনে হবে বর্জ্য ফেলার ভাগাড়। ময়লা-দুর্গন্ধ-দখল-দূষণে করতোয়া এখন সরু খাল।

এক সময় বিশাল জলরাশির ঢেউ আছড়ে পড়ত নদীর দুই তীরে। নির্মল স্বচ্ছ পানিতে স্রোতের গতি, কলকল শব্দ মানুষকে কাছে টানত। দুরন্ত কিশোরের দল ঝাঁপিয়ে পড়ত নদীর বুকে। স্রোতে গা ভাসিয়ে মিতালি করতোয়া নদীর সঙ্গে। হাজার জাতের মাছ ধরার উৎসব হতো। মাঝি-মাল্লারা ভাটিয়ালি, জারি, সারি গান গেয়ে নৌকা বাইত। প্রতি বছর বর্ষার শেষে নৌকা বাইচের আয়োজন হতো। চলত নৌকা ও স্টিমার। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই পু-্রনগর গড়ে ওঠে করতোয়ার কোল ঘেঁষেই। দেশের বিভন্ন প্রান্ত থেকে সওদাবাহী শত শত নৌকা ভিড়ত পু-্রনগরের তীরে। সুদূর খুলনা থেকে নারকেল, ইলিশ আসত। এখন থেকে যেত কাঁচা তরকারিসহ অনেক কৃষিপণ্য। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচার-প্রসার ঘটে এই নদীকে কেন্দ্র করেই।

দীর্ঘদিনে মরে যাওয়া নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে এক যুগ আগে প্রকল্প নেয়া হয়। নানা জটিলতার কারণে সেটি বাস্তবায়ণ হয়নি। ফলে করতোয়া এখন দখলদারদের অন্যতম লক্ষ্য। নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে ব্যক্তিমালিকানায় প্রতিষ্ঠিত শিল্প, আবাসিক ভবন, হাসপাতাল ও মার্কেট।

নদী আমাদের দেশের হৃৎপিণ্ডের ধমনীর মতো। করতোয়া বাঁচলে বাঁচবে বগুড়া, নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ। ঐতিহাসিক করতোয়া নদীতে প্রাণ ফিরে আসুক, সবার ভেতর পরিবেশগত সচেতনতা বৃদ্ধি হোক। দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে না যাক করতোয়া নদীর অস্তিত্ব- এই হোক প্রত্যাশা।