ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

২৫ নির্দেশনা পালনে যত্নবান হবেন কি ডিসিরা

শফিকুল ইসলাম খোকন, সাংবাদিক ও গবেষক, [email protected]
২৫ নির্দেশনা পালনে যত্নবান হবেন কি ডিসিরা

একটি পরিবার যেমন কিছু নিয়মনীতির মধ্য দিয়ে চলে, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রও সংবিধান, আইন, নীতিমালা, বিধি দিয়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। আর ওই রাষ্ট্রের প্রধান বা সরকার প্রধানের কিছু সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও মেনে চলতে হয়। একটি রাষ্ট্রের আইন ও সরকারের সঠিক নির্দেশনা প্রয়োগ, বাস্তবায়ন করেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কিন্তু এমন নির্দেশনা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ধরে অনেকাংশে অনিহাই দেখা গেছে। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে ‘আদালতের নির্দেশনা মানছেন না আমলারা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং প্রধানমন্ত্রীর ডিসিদের ২৫ দফা নির্দেশানায় কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে।

২৪ জানুয়ারি সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, গুজব, খাদ্যেভেজাল, সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, জনগণকে সরকারি সেবা প্রধান, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। জনগণ ট্যাক্স দেয় সেবা পাওয়ার জন্য। সেবা দেয়া প্রতিটি সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব। সে জন্য সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে দায়িত্ব পালন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণসহ ২৫টি নির্দেশনা বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জেলা প্রশাসকদের কিছু বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার পরামর্শ দেন। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে। নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্য বাড়াতে হবে। সুইচগেট বা অন্য কোনো কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সেবাপ্রত্যাশীদের সন্তুষ্টি অর্জনই যেন হয় সরকারি কর্মচারীদের ব্রত। প্রধানমন্ত্রী তার ২৫ দফাদার মধ্যে ১৯ দফায় সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং ২০ নং দফায় নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্য বাড়াতে হবে। সুইচগেট বা অন্য কোনো কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

সরকারি তহবিল ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে জেলা প্রশাসকদের। জেলা প্রশাসক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যের দাবিদার। জেলা প্রশাসকরা জেলা পর্যায়ে সরকারের চোখ এবং কান হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও জনসেবায় সরকারের কর্মপরিকল্পনা কতটা সফল হবে তা জেলা প্রশাসকদের যথাযথ পদক্ষেপ ও নজরদারির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। চলতি জেলা প্রশাসক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের ১ বছর আগে। করোনাভাইরাস ও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব যখন ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন এমন এক দুঃসময়ে।

আমাদের গ্রামে প্রবাদ আছে, তা হলো- ‘সালিসি মানি তাল গাছটি আমার’। নির্দেশনা যতই থাকুক না কেন, মানা না মানা তা আমার ব্যাপার; কুষ্টিয়ার একটি আলোচিত ঘটনা, তা হলো আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পরও ১২৩ কোটি টাকার সম্পত্তি ১৫ কোটি টাকায় নিলামে বিক্রির ঘটনায় গত ১১ আগস্ট কুষ্টিয়ার ডিসি মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, এসপি মো. খায়রুল আলম ও সদর থানার ওসি মো. সাব্বিরুল আলমকে তলব করেন হাইকোর্ট। ডিসি সাইদুল ইসলাম ওইদিন আদালতে হাজির হলে তাকে সতর্ক করে বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি কেএম রবিউল হাসানের হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, আপনারা চাকচিক্যময় জীবনযাপন করেন। কীভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করে থাকেন, সেটাও জানি। দুঃখজনক হলেও সত্য, ডিসি অফিসে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারেন না। সাধারণ মানুষ তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান না। আপনাদের অফিসের দরজা-জানালা মোটা পর্দায় আবৃত থাকে। যার কারণে মানুষ আপনাদের ছবি পর্যন্ত দেখতে পান না।’

আদালত বলেন, ‘আপনাকে সতর্ক করছি। এখন থেকে ডিসি অফিসের দরজা-জানালা খোলা রাখবেন, যেন জনগণ আপনাদের চেহারা দেখতে পান। আপনার দরজা-জানালায় ভারী পর্দা ব্যবহার করবেন না। কারণ ডিসি হলো সরকারের হার্ট। আপনাকে জনগণের জন্য সেভাবে কাজ করতে হবে।’

আদালত বলেন, ‘ডিসি অফিসে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। আপনারা একটা দরখাস্ত পর্যন্ত রিসিভ করেন না। এখন থেকে কোনো ধরনের উন্নাসিকতা দেখাবেন না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভালো কাজ করলে দেশ ও জনগণ উপকৃত হবে। কোথাও চুরি-ডাকাতি হচ্ছে, সরকারি সম্পত্তি দখল হয়ে যাচ্ছে- অভিযোগ না পেলে কি আপনি বসে থাকবেন? বসে থাকার সুযোগ নেই।’ এতো বললাম একটি ঘটনা, এরকমের অনেক উদারণই আমাদের দেশে রয়েছে। সম্প্রতি বরগুনার পাথরঘাটার খাস সম্পত্তি ন্যাসবঞ্চিত করে পাথরঘাটা কলেজ প্রকাশ্য দিবালোকে ঘর উত্তোলন করলেও ওই খাস সম্পত্তি মুকশা হিসেবে প্রাপ্য ব্যক্তি বারবার প্রশাসনের নজরে আনার চেষ্টা করলেও কোনো কাজের কাজ হয়নি। ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ইউএনও। এ রকমের একটি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কোনো কাজ সম্পাদিত করতে হলে অবশ্যই সভায় সভাপতির উপস্থিতিতে সিদ্ধান্তের আলোকেই হয়ে থাকে। তাহলে কীভাবে একজন ইউএনও সরকারি খাস সম্পত্তিতে ঘর উত্তোলনের অনুমতি দেয়? আর কীভাবে একজনের সঠিক প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ডিসিআর প্রদান করে? খাল ভরাটি জমি অকৃষি খাসজমি বলে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দেয়ার জন্য পাথরঘাটা পৌরসভা জনস্বার্থ বিঘ্নিত হবেন না মর্মে অনাপত্তিপত্রও দিয়েছেন। তাহলে স্থানীয় সরকারের কাজই বা কি? যেখানে স্থানীয় পর্যায় নাগরিকদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এবং নাগরিক সেবা নিশ্চিতের দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের। তাহলে এ দিয়ে কি বুঝা যাচ্ছে, যেখানে খাস সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব প্রশাসনের এবং প্রাপ্যতার দিক থেকে রেকর্ডিয় ও কবলা সম্পত্তির মালিক, মালিকানা হিসেবে দাবিদার অথচ তাদের প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। নদী রক্ষা কমিশন থেকে ওই সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যাপারে ডিসিকে লিখিতভাবে অবহিত করলেও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। দেশের নদী রক্ষা, জলালয় ও খাস সম্পত্তি সংরক্ষণ এবং নদী দখল রোধে সরকার ও উচ্চাদালতের কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ডিসিরা মানছেন না। আদালতের নির্দেশনার পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব ও কার্যাবলি-২০১১ প্রজ্ঞাপনের ১৫ দফায় সম্পত্তি অধিগ্রহণ এবং হুকুম দখলের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে ডিসিদের ওপর।

পরিশেষে বলতে চাই, একটি গণতান্ত্রিক দেশ গণতান্ত্রিক পন্থায় পরিচালিত হয়ে থাকে আর আইন ও সরকারের সঠিক নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী অর্থাৎ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। আমাদের বিশ্বাস জেলা প্রশাসক সম্মেলন থেকে পাওয়া দিকনির্দেশনাগুলো জেলা পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা সফলভাবে বাস্তবায়ন করলে সরকারের পক্ষে বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা সহজ হবে। স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রশাসন যৌথভাবে নাগরিকদের সবধরনের সেবা নিশ্চিতে একসঙ্গে কাজ করবেন- এটাই একজন নাগরিক হিসেবে প্রত্যাশা করছি। তাতেই দেশবাসীর জন্য বয়ে আনবে স্বস্তি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত