দেশে যে কয়েকটি সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন তার মধ্যে খাসিয়া সম্প্রদায় একটি। খাসিয়ারা মাতৃতান্ত্রিক সম্প্রদায়, তারা দৈহিক আকৃতির দিক থেকে মন্দোলয়েড। পাহাড়-টিলা, গভীর বন তাদের বসবাসের পছন্দনীয় পরিবেশ। কাঠ বা বাঁশের মঞ্চের উপর বারান্দাসহ এরা ঘর বানায়। ঘরের মঞ্চের নিচেই জুমে উৎপাদিত ফসল রাখার জায়গা। বসতঘরের সঙ্গেই রন্ধনশালা এবং সন্নিকটে থাকে পালিত শূকরের খোয়াড়। জুমে পান-সুপারি, কলা, আনারস, কমলা, তেজপাতা, গোলমরিচ ও শাকসবজি ইত্যাদি চাষ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তাদের মধ্যে কাঁচা সুপারি ও পান খাওয়ার প্রচলন খুব বেশি, তাদের উৎপাদিত পান দেশের কিছু জনপদে জনপ্রিয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। তাদের স্বতন্ত্র আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ধারা অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর উপজেলায়; মৌলভী বাজারের সবকটি উপজেলায়; হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও বাহুবল উপজেলায়; সুনামগঞ্জের তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারা বাজার, ছাতক উপজেলায় খাসিয়াদের বসবাস। নেত্রকোণা জেলার কিছু জায়গায় লিংগাম গোত্র বাস করে। এইসব স্থানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বসবাস গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এলাকায়। একদা জৈন্তা রাজার অধীনে জাফলংয়ের টিলার ওপর তারা পুঞ্জি স্থাপন করে। বর্তমানে খাসিয়া সম্প্রদায়ের যে পুঞ্জি রয়েছে সেখানে, তার মধ্যে বল¬া পুঞ্জি, সংগ্রাম পুঞ্জি ও নকশিয়া পুঞ্জি বিশেষভাবে উলে¬খযোগ্য। একইভাবে জৈন্তায় আছে মোকামপুঞ্জি ও নিজপাট খাসিয়া হাটি। তারা তাদের গ্রামগুলোকে বলে থাকে পুঞ্জি। লেংদু, সিংতে, লিংগাম, পনার, ভুই ও বার এই ছয়টি গোত্রে বিভক্ত খাসিয়ারা একই পুঞ্জিতে একত্রে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করেন। প্রতিটি পুঞ্জিতে তাদের ভূমির পরিমাণ ৫০ থেকে ২৫০ হেক্টর। মাতৃপ্রধান খাসিয়া সমাজব্যবস্থায় নারীদের বিশেষ সম্মান ও আলাদা মর্যাদা রয়েছে। এদের পরিবারের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন নারী, আর নারীরা নিজেদের বাড়িতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস করে থাকেন। বংশ পরিচয় দেয়া হয় মায়ের বংশাণুক্রমে। এদের পোশাক-পরিচ্ছদে বৈচিত্র্যের বর্ণাঢ্য সমাবেশ এবং ঐতিহ্যবাহী হচ্ছে শিরে চূড়াবাঁধা পাগড়ি পরিধান করা। খাসিয়াদের ভাষার নাম খাসি বা খাসিয়া। গান, কবিতা থেকে শুরু করে নাচ, নাটক, শিল্প-সাহিত্যের সব শাখাই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। লোককথা, পৌরাণিক কাহিনি, তন্ত্র-মন্ত্র ইত্যাদি খাসিয়া সংস্কৃতির জীবনবোধে সমৃদ্ধ। এদের অনুষ্ঠানাদি বেশ জমজমাট। বিবাহ ও নানা রকম সাং-বাৎসরিক উৎসবে ওরা দলবদ্ধ হয়ে নৃত্যগীত করে থাকে। তাদের নাচ-গান দৃষ্টিনন্দন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ২৪ নভেম্বর তারা নতুন বছর গণনা শুরু করেন। বর্ষবরণের এই উৎসবকে বলা হয় øেম থাইমি। আগের দিন খাসি সেং কুটøেম উৎসবে বিদায় জানানো হয় পুরনো বছরকে। আরও কিছু উৎসব হচ্ছে শাডসুক মেনসিম, বড়দিন। শতাব্দী প্রাচীন এ খাসিয়া সম্প্রদায়ের আজকাল নেই জুমে কর্ম ব্যস্ততা, গঞ্জে-হাটে তাদের তৈরি পণ্যসামগ্রী ও উৎপাদিত ফসল। নেই তাদের অধ্যুষিত এলাকায় গণউপস্থিতিও। দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে খাসিয়া জনগোষ্ঠী তাদের চিরাচরিত অরণ্যের জুম থেকে, তাদের বাসভূমি থেকে, তাদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি ও রীতিনীতি থেকে? ১৯৬১ সালে আদমশুমারিতে খাসিয়া জনসংখ্যা ছিল ৮০ হাজার জন। ১৯৯১ সালে জনসংখ্যা জরিপ অনুযায়ী মোট সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ২৮০ জন। বর্তমান বাস্তবতা আরও মলীন। এই জাতিগোষ্ঠীর পাশাপাশি তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছেদ, পেশা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, প্রথা, উৎসবও আজ বিলুপ্তির পথে।
কোরপাই, বুড়িচং, কুমিল্লা
facebook.com/moonzeerahcklham