একুশে বইমেলা : বাংলাদেশের এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব

জুয়েল ত্রিপুরা

প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রত্যেক বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পুরো বাঙালি জাতির এক জাতীয় চেতনার মাস। বাঙালি সত্তার মর্মমূলে গাঁথা মহান একুশে ফেব্রুয়ারি তথা ভাষা আন্দোলনের অমর স্মৃতি ‘একুশে বইমেলা’ বাঙালির সংগ্রামী চেতনা ও সংস্কৃতি স্বাতন্ত্র্যেরই এক তাৎপর্যপূর্ণ অনুষঙ্গ। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এই বইমেলা চলে। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এ বইমেলা একসময় বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে শুরু হলেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে প্রাণের বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আগের বছরগুলোর ন্যায় এবারও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবছরের বইমেলার মূল প্রতিপাদ্য ‘পড় বই গড় দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’।

অমর একুশে বইমেলা বর্তমানে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া এ বইমেলাকে সামনে রেখে ফেব্রুয়ারি মাসে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটে যায়। একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করেই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠাসহ অন্যান্য হাজারো প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মযজ্ঞ বেড়ে যায়। মেলায় লেখক, পাঠক ও প্রকাশকের সম্মিলন ঘটে। বই নিয়ে চলে নানা আলোচনা ও পর্যালোচনা। বই ঘিরেই এই প্রাণের সম্মিলন সত্যিকার অর্থে আমাদের অহংকারের বিষয়। এ বইমেলায় বাংলা ভাষাভাষী লেখকের প্রকাশিত নতুন ও পুরাতন বইয়ের সঙ্গে আমাদের যেমন পরিচয় ঘটে; তেমনি দেশের অন্যান্য অধিবাসীদের নিজস্ব জীবনধারার সৃজনশীল চিন্তা ও চেতনা সম্বলিত বইয়ের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে সবার। এ মেলায় বই প্রকাশনা ছাড়াও বই সম্পর্কিত আড্ডা, মঞ্চ নাটক, গান ও আবৃত্তি প্রভৃতি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার মূল অবলম্বন বই। আর এ বই প্রকাশের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে আসছে অমর একুশে বইমেলা।

বই হলো জ্ঞানার্জনের প্রধানতম মাধ্যম। আধুনিক এ ডিজিটাল যুগেও ছাপানো বইয়ের কদর একটুকুও কমেনি; বরং বুদ্ধিবৃত্তিক ও মুক্ত মননশীল জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসেবে বইয়েরই ভূমিকা বেশি। লৌকিক সেতুবন্ধনে শিল্প-সাহিত্য-সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীবন-জগতের নান্দনিক দর্শনের সঙ্গী বই। বই কোনো আনুষঙ্গিক অনুষঙ্গ ছাড়াই নির্ভরশীলতার এক আস্থাশীল আশ্রয়। এদিক থেকে অমর একুশে বইমেলা শিল্প-সাহিত্য-সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীবন-জগতের সেতুবন্ধনে আবহমানকাল ধরে কাজ করে যাচ্ছে।

পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য দেশের একটি প্রধান ঐতিহ্য হলো বইমেলা। তবে এ বইমেলা তখনই পূর্ণতা পায়, যখন লেখকের মুক্ত-মননশীল চিন্তার ভাষা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ লাভ করে। কিন্তু মাঝেমধ্যে মুক্তচিন্তার বাক-স্বাধীনতাকেও রুদ্ধ করা হয় রাজনৈতিক কোন্দল, ধর্মবিদ্বেষ নামে। যেটি বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়। স্বাধীন মতপ্রকাশের অগ্রদূত বুদ্ধিজীবী ও লেখক ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর বইমেলার বাইরে সন্ত্রাসী হামলা চালানো, ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে বইমেলা চলাকালীন মুক্তমনের লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা প্রভৃতি দুঃখজনক ঘটনা আমাদের মুক্ত-চিন্তার মতপ্রকাশকে আজও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে হয়। প্রত্যেক মানুষ নিজ স্বাধীন দেশে বাক-স্বাধীনতার অধিকার যে আমরা পায়, তা আজও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। তবুও অমর একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব আমাদের দেশে উত্থান ঘটেছে তা সত্য প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হিসেবে রেনেসাঁস ঘটবে প্রত্যেকের চিন্তা ও মননে। করোনাকালীন দুর্যোগ অতিক্রম করে এবছরের বইমেলায় পাঠকের সম্মিলন আশাব্যঞ্জক হবে?

শিক্ষার্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]