ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অব্যবস্থাপনা ও দুর্ঘটনা রেলযোগাযোগ উন্নয়নে অন্তরায়

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ, অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক
অব্যবস্থাপনা ও দুর্ঘটনা রেলযোগাযোগ উন্নয়নে অন্তরায়

বিগত কয়েক বছরে যেসব খাতে বাংলাদেশের আশাব্যঞ্জক উন্নয়ন হয়েছে যোগাযোগব্যবস্থা তারমধ্যে অন্যতম প্রধান। শহর বাদ দিয়ে যদি শুধু গ্রামগঞ্জের কথাই ধরি তাহলে বলতে হয়, সড়ক যোগাযোগে গ্রাম এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে খাল-নদী ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়ায় দেশজুড়ে নদীপথ হয়ে গেছে সঙ্কুচিত। আগে গ্রামাঞ্চলে যোগাযোগের একমাত্র নৌপথই ছিল ভরসা। প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে হলে দীর্ঘ সময় ধরে পায়ে হেঁটে অথবা নৌকায় চড়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হতো। কিন্তু আজ আর সেই অবস্থা নেই। দেশের বেশিরভাগ এলাকায় পাকা রাস্তা হয়েছে। সেইসব রাস্তা দিয়ে গ্রাম গ্রামান্তরে চলে যাওয়া যায় মোটসোইকেলে অথবা থ্রি-হুইলার যেকোনো যানবাহনে। এমনকি সুপরিসর রাস্তা যেখানে রয়েছে, সেখানে মোটরগাড়িতে চড়ে নিশ্চিন্তে যাতায়াত করা যায়। যাতায়াতের ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের উন্নয়নও দেশের মানুষের মনে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা শহরে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মিত হওয়ায় ব্যাপক উন্নতি হয়েছে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে। সম্প্রতি পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সারা দেশের মানুষের যাতায়াত, এমনকি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। আগামী দিনে সেতুতে রেলযোগাযোগ স্থাপিত হলে সম্ভাবনার দুয়ার আরও উন্মুক্ত হবে। অতি সম্প্রতি রাজধানীতে সীমিত পরিসরে মেট্রোরেল চালু হওয়ায় জনবহুল রাজধানী শহরের বিশেষ একটি অংশের মানুষ বিশেষ উপকৃত হয়েছেন। উত্তরার একটি অংশ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত আজ মাত্র বিশ মিনিটে মেট্রোরেলে আসা-যাওয়া করা যায়। এতটুকুু পথ সড়কপথে চলাচলে দেড়-দু’ঘণ্টা সময় লেগে যেতো। মেট্রোরেল যোগাযোগের পরিধি বেড়ে গেলে গোটা রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। রেলযোগাযোগ যে একটি দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা অতি পুরনো এবং নানা কারণে এর তেমন উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। পুরনো রেললাইন, বগি দিয়ে দীর্ঘকাল ধরে রেলযোগাযোগকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে, যা উন্নত বিশ্বের তুলনায় একেবারে সেকেলে। এছাড়া রেলদুর্ঘটনা এবং কিছু অনিয়ম ও অব্যবস্থা রেলওয়েকে পিছিয়ে রেখেছে। ট্রেনের টিকিট পেতে ভোগান্তি, টিকিট পেয়েও আসন না পাওয়া, ট্রেনের ছাদে যাত্রী বহন, ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের শেষ নেই। এছাড়া অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে। এক বেসরকারি সূত্রমতে জানা যায়, গত তিন বছরে এ ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। আহত হয়েছে ৩ হাজার। এ ছাড়া রেললাইনের ওপর বসা ও রেললাইন দিয়ে চলাচলের কারণে ১ হাজার ৯৭৬ জন, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ১৪৬ জন এবং অন্যান্য কারণে ২৯৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। অব্যবস্থাপনা, কর্তৃপক্ষের দুর্বল নজরদারি, পথচারীদের অসতর্কতার কারণে কখনও রেলপথ মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়। রেল পুলিশের তথ্যে জানা যায়, জিআরপির রেলরুটে ট্রেনেকাটা পড়ে. দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা বা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে ২০১৮ সালে ১০০২টি, ২০১৯ সালে ৯৮০টি, ২০২০ সালে ৭১৩টি, ২০২১ সালে ৬১৮টি, ২০২২ সালে ৫৫০টি এবং রেললাইনের পাশ ৩৮৬৩টি লাশ পুলিশ উদ্ধার করে। ২০২২ সালে অরক্ষিত রেললাইনে ৬০৬টি দুর্ঘটনায় ২০১ জন নারী, পুরুষ এবং শিশু আহত হয়েছে।

সড়কপথে যানবাহন ও রেললাইনে ট্রেন আলাদা দুটি পথ ধরে চলে। শুধু লেভেলক্রসিংয়েই এ দু’ধরনের যানবাহনের সাক্ষাৎ হয়। কাজেই রেললাইনের ট্রেন ও সড়কে চলা যানবাহনের মধ্যে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অথচ এসব লেভেলক্রসিংগুলো অরক্ষিত থাকার কারণেই বারবার ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে, বাংলাদেশের ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। এরমধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। এর মধ্যে ৯৬১টি লেভেলক্রসিং সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এসব লেভেলক্রসিংয়ে নেই কোনো গেটম্যান। রেলকর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ অবৈধ লেভেলক্রসিং তৈরি করে। অনেক জায়গায় বেআইনিভাবে রেললাইন অতিক্রম করে যে যার প্রয়োজনে রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে। লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেন এসে পৌঁছার আগাম সংকেত পাওয়ার ব্যবস্থাও নেই সব জায়গায়। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাইকে রেললাইন পার হতে হচ্ছে। অথচ রেলওয়ে ১৮১৯ অধ্যাদেশ অনুযায়ী অনুমতি ছাড়া কেউ রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটলেও ২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। লেভেলক্রসিংয়ের আশপাশে গড়ে উঠেছে বস্তি, বাজারসহ নানা অবৈধ স্থাপনা। রেলপথের ওপর অবৈধভাবে রাস্তা নির্মাণ করে থাকে সরকারের নানা সংস্থা। বিভিন্ন এলাকার অসচেতন জনগোষ্ঠী নিজেদের বাড়ির রাস্তা সোজা করতে রেললাইনের ওপর দিয়ে এখানে-সেখানে অবৈধভাবে এপ্রোচ সড়ক তৈরি করে। রেললাইনের ওপরই প্রতিদিন পণ্য বেচাকেনা করতে জড়ো হয় অসংখ্য মানুষ।

১৮৬১ সালের ব্রিটিশ আইনে এখনও চলছে বাংলাদেশের রেল। এই আইনের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী রেললাইনের দুইপাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোকবিহীন কোনো সাধারণ মানুষ বা গবাদিপশু প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। এ এলাকায় সবসময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। এখানে কাউকে পাওয়া গেলে ওই আইনের ১০১ ধারায় গ্রেপ্তার করা যাবে। গবাদি পশু আটক করে তা বিক্রয় করে অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দেয়ার কথাও বলা রয়েছে এ আইনে। কিন্তু এ আইন যেমন বেশিরভাগ মানুষ জানে না, তেমন এ আইনের প্রয়োগও নেই বললেই চলে। রেলের জমি দখল করে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় রেল লাইনের দুপাশ ঘেঁষে গড়ে ওঠা অসংখ্য বস্তি, দোকানপাট এমনকি হাটবাজার গড়ে উঠেছে। বস্তিতে বসবাসকারীদের অনেকেই চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ নানাবিধ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন ট্রেনে যাতায়াতকারী যাত্রীরাও। তাদের হাতে সর্বস্ব খোয়ানো ছাড়াও রেলপথ ব্যবহারকারীদের প্রাণ যাচ্ছে। এক সময় আখাউড়া-সিলেট রেল সেকশনের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বড়ছড়া রেলব্রিজ ভেঙে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস নিচে পড়ে উল্টে ৪ জন যাত্রী নিহত এবং দুই শতাধিক যাত্রী আহত হয়। জোড়াতালি দেয়া রেললাইন, ওঠে যাওয়া ব্যালাস্ট, অতি পুরান ভাঙা কাঠের স্লিপার, লাটবল্টু বা ডগস্পাইকের বদলে কাঠের গোজ লাগিয়ে মেরামত করা নড়বড়ে ব্রিজের ওপর দিয়ে চলা ১৭টি কোচে সহস্রাধিক যাত্রী যা কিনা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত। ২০১৬ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রেলসেতুর গার্ডারের নিচের মাটি ধসে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া হাটহাজারীতে রেলসেতু ভেঙে তেলবাহী ট্যাঙ্কার নিচে পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও রয়েছে। একটি ট্রেনদুর্ঘটনায় রেললাইন, ট্রেনের বগি, যন্ত্রাংশ ছাড়াও যাত্রীদের মালামালের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুর্ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পর রেললাইন সচল করে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে তুলতে অনেক সময় লেগে যায়। এ দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দেশে রেললাইনের প্রয়োজনীয় উপকরণ চুরি হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। রেললাইনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারেরও অভাব রয়েছে।

বিশ্বের মানুষের কাছে যাতায়াতের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত রেলপথ। শুধু যাত্রী পরিবহনই নয়, মালামাল পরিবহনের জন্যও বিশ্বব্যাপী রেলপথকেই সর্বাগ্রে বেছে নেয়া হয়। ট্রেনে চেপে অধিক সংখ্যক যাত্রী দ্রুততম সময়ে নিরাপদে অতিক্রম করতে পারে। ট্রেনের ভাড়াও তুলনামূলকভাবে কম। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিরাজমান নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থার কারণে রেলযোগাযোগের তেমন প্রসার লাভ করছে না। যাত্রীসেবা মানের কোনো রকম উন্নয়ন না ঘটায় বাংলাদেশ রেলওয়ে অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে। অব্যাহত ট্রেন দুর্ঘটনা বন্ধ করতে লেভেলক্রসিংয়ের সংস্কার, রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা সব অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজার অনতিবিলম্বে উচ্ছেদ করা জরুরি। বর্তমান রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামোগত উন্নয়নকল্পে রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি, সিগনাল ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নিয়মিত সংরক্ষণ ও মেরামত করা অত্যাবশ্যক। রাজধানীতে প্রায় ৩০টির অধিক লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণগুলোতে অনতিবিলম্বে ওভারপাস বা আন্ডারপাস নির্মাণ করা আবশ্যক। রেলওয়েকে প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ লেভেলক্রসিংয়ে শুধু ‘সতর্কীকরণ’ সাইবোর্ড ঝুলিয়ে দায় এড়িয়ে গেলে চলবে না। ট্রেন আসার সময় রেলগেটে সাইরেন বা সতর্কীকরণ হুইসেল বাজিয়ে গেটম্যানকে সজাগ করে তুলে আগত বাসকে সাবধান করতে হবে। লেভেলক্রসিংয়ে প্রশিক্ষিত গেটম্যানের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির পাশাপাশি রেলওয়ে ট্রাফিক পুলিশের কর্মতৎপরতা নিশ্চিত করা জরুরি। যাত্রীদের টিকিট প্রদানের ব্যাপারে অনিয়ম বন্ধ করাসহ যাত্রী ছাউনি ও প্ল্যাটফর্মের উন্নয়নও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেভেলক্রসিংয়ের সংস্কারসহ ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দক্ষ চালক নিয়োগ, রেলবিভাগের সর্বস্তরে যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত জনবলকাঠামো সুদৃঢ় করা আবশ্যক। অনতিবিলম্বে অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ করে বৈধ লেভেলক্রসিংগুলোতে প্রশিক্ষিত গেটম্যান নিয়োগ করতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে রাজধানীতে মেট্রোরেলের প্রসারের পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বরিশাল বিভাগের যোগাযোগ বিস্তারে দক্ষিণাঞ্চলের অসম্পূর্ণ রেললাইন স্থাপনের কাজ সমাপ্ত করে ট্রেনযোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দেশের সুষম উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি রেলওয়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশনে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণসহ যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন করা গেলে ট্রেনে যাত্রা নিরাপদ হবে এবং রেলযোগাযোগের ভবিষ্যৎ প্রসার ও সার্বিক উন্নয়নও দ্রুততর হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত