ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভাষার মাসে সবকিছু ভাসা ভাসা

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]
ভাষার মাসে সবকিছু ভাসা ভাসা

ফেব্রুয়ারি মাসকে আমরা ভাষার মাস বলে থাকি। কারণ এ মাসেই ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অভিসিক্ত করতে আন্দোলনরত কয়েকজন ভাষাপ্রেমিক জীবন দিয়েছিলেন। যদিও ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল ভারত ভাগের সঙ্গে সঙ্গেই। ১৯৫২ সালে আন্দোলন চূড়ান্তরূপ লাভ করেছিল রাজপথে রক্তদানের মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব-বাংলা বা পূর্ব-পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। তৎকালীন এ অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ গণদাবিকে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী উপেক্ষা করার চেষ্টা করতে থাকে। গণআন্দোলন দমাতে নানা রকম নির্যাতন শুরু করে দেয়। কিন্তু বাংলার মানুষ একাট্টা হয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে।

এতে নিহত হন সালাম, জব্বার, বরকত, রফিকসহ বেশ কয়েকজন। আহত হন অনেকে। তবে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় পুলিশের গুলিতে শফিউর রহমান শফিক ও রিকশাচালক আওয়াল। ২২ ও ২৩ পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ২৩ তারিখে ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ বর্বর নির্যাতন চালায়। কিন্তু আমরা ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছি এবং পরবর্তী সময়ে এ দিবসটিই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক। ভাষার জন্য একটা জাতি যে, জীবন দিতেও কুণ্ঠা বোধ করে না, সে জাতির নাম বাঙালি জাতি। বাঙালির সেই বীরত্বগাঁথা ইতিহাসকে স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখতেই ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তদানীন্তন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ও ১৯৫৪ সালে ৭ মে মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয় ২১৪(১) The State Language of Pakistan shall be Urdu and Bengali যদিও আইয়ুব খানের সামরিক সরকারও উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আন্দোলনের মুখে আইয়ুবের স্বপ্নও পূর্ণ হয়নি। ১৯৫৯ সালে ৬ জানুয়ারি সামরিক শাসকগোষ্ঠী এক সরকারি বিবৃতিতে উর্দু ও বাংলা এই দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পুনরুল্লেখ করা হয়। বাঙালির আন্দোলন কখনও বৃথা যায়নি। ন্যায্য দাবির আন্দোলন কখনও বৃথা যেতে পারে না।

ভাষা আন্দোলনের পথ রেখেই স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠে। এ ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সীমাহীন ত্যাগ করতে হয়েছে। ত্যাগের ফসল আমরা কতটা ভোগ করতে পেরেছি বা পারছি তা আজও পরিষ্কার নয়। আবেগ তাড়িত হয়ে শুধু ফেব্রুয়ারি মাসকেই ভাষার মাস হিসেবে চিহ্নিত করে আসছি। বাংলা ভাষার গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। সে ইতিহাসের প্রতি আমরা কতটা দায়বদ্ধ সে প্রশ্নটি স্বাভাবিক কারণেই সামনে এসে যায় আমাদের আচার-আচরণের কারণে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই প্রথম আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাভাষার পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেন জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে। অথচ আমরা তার এ অবদান সার্বজনীনরূপে বিকশিত করতে ব্যর্থ হয়েছি। আজও একদল বাংলাভাষী মানুষ বঙ্গবন্ধুর অবদানকে শিকার করছে না। এমন কি তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জাতির পিতা কিংবা বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবেও স্বীকৃতি দিচ্ছে না। তারা সদম্ভে রাজনীতি করছে। যারা বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানছে না প্রকারন্তে তারা বাংলাদেশকে অস্বীকার করছে- এই অস্বীকৃতি রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল হলেও রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারছে না। তা হলে আমাদের এই স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে? এত উন্নয়ন, এত অগ্রগতির গল্প বলে লাভ কী? যেখানে রাষ্ট্রদ্রোহীরা অর্থ-বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে রাষ্ট্রকে, বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে চলেছে অনবরত তারপরও আমাদের মাথা তাদের কাছে অবনত! ফেব্রুয়ারি আসলেও আমরা মাতৃভাষা নিয়ে মাতামাতি করতে আরম্ভ করি। মাসটা চলে গেলেই আবার ফিরে যাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। বাংলাভাষার মর্যাদার কথা বলা হলেও আমরা আমাদের নামটিও বাংলায় রাখতে কার্পণ্য করি। আধুনিক এই বিজ্ঞান সভ্যতায় দিনে দিনে ভাষা সংস্কৃতি বিলীন হতে চলেছে, আমরা কী সেটা ভেবে দেখেছি? আমরা নিজেরাই অপদস্ত করছি, নিজেরাই নিজেদের সঙ্গে প্রতারণা করে চলছি। সর্বত্র মাতৃভাষার ব্যবহার ও প্রচলনের কথা তো শুধু স্লোগানেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষা শিখতে কোনো বাধা নেই কিংবা কোনো অপরাধ নয়; কিন্তু মাতৃভাষাকে দিতে হবে অগ্রাধিকার। জাপান, কোরিয়া, ইতালিয়ান নাগরিকরা নিজেদের ভাষায় প্রতি যতটা দরদি, আমরা বাঙালিরা ততটা দরদি হতে পারিনি আজও। আন্তর্জাতিকভাবে তার বিনিময়ের মাধ্যমে হিসেবে ইংরেজিকে ব্যবহার করি। কিন্তু কেন? আমরা কী পারি না বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করতে? বিদেশি কূটনৈতিকবর্গ বাংলা বুঝেন না, যদি আমরা আমাদের ভাষা ব্যবহারে অনঢ় থাকি, তবে বিদেশি কূটনৈতিকরাও বাংলা শিখতে বাধ্য হবে।

নিঃসন্দেহে আমাদের অঙ্গীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশে ক্রমেই এমন উদ্যোগ নিতে হবে সব বাঙালিকে মানব বিকাশে বাংলা ভাষার পথটিকে সঠিকভাবে অণুসরন করতে হবে; অবশ্য এ কথা মনে রেখে যে, এ বিষয়ে অন্যান্যদের কাছ থেকেও আমাদের শেখার আছে। আমরা যদি ভাষার ক্ষেত্রে অনঢ় থাকি, তাহলে মানবিক মূল্যবোধ আপনা আপনিই বিকাশের পথ খুঁজে পাবে। এই দৃষ্টান্ত ও প্রেরণা বিশ্বকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করবে। বিশ্ব আমাদের যা দিয়েছে, সে ঋণও আমরা যথোপযুক্তভাবে পরিশোধ করতে পারব। অবশ্য ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এখন এটি শুধু আশা। এই আশাটিকে জাগিয়ে রাখতে হবে। এই আশাই আমাদের মনকে আলোয় উজ্জীবিত করবে, হৃদয়ে শক্তি জোগাবে, দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাবার সামর্থ্য এনে দেবে। আমাদের প্রয়োজন লৌকিক ও রাজনৈতিক শিক্ষার সঙ্গে আধ্যাত্মিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন। এ আধ্যাত্মিক শিক্ষার বাহন মাতৃভাষা। শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য যেমন শিক্ষার প্রয়োজন, তেমনি মনুষত্ব বিকাশের জন্য প্রয়োজন আধ্যাত্মিক শিক্ষা। মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ না থাকলে আধ্যাত্মিক শিক্ষা অর্জন সম্ভব নয়। যে ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি, তার সার্থকতায় মনোযোগী হওয়া খুবই জরুরি। আমাদের আত্মবিকাশের একমাত্র মাপকাঠি মাতৃভাষা বাংলা। সব কিছুই ভাসা ভাসা থাকলে চলবে না। পরিষ্কার হতে হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই জয় বাংলা, স্লোগানটি জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করা হলো আওয়ামী লীগ ব্যতীত কেউ তো এ স্লোগান ব্যবহার করছে না। যে স্লোগানে আমাদের চেতনাকে উচ্চতর সত্যে উপনীত করেছে, যে স্লোগান শক্তি সঞ্চারে ভূমিকা রেখেছে- সেই স্লোগানকে যারা অবজ্ঞা করছে, তারা কি আদৌ স্বাধীনতা মানে? স্বাধীনতা না মানার অর্থই হচ্ছে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করা- যা দেশদ্রোহিতার শামিল। ভাসা ভাসা চেতনাবিদায় হোক ভাষার মাসে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত