গাছ আমাদের প্রাণের উৎস

গোপাল নাথ বাবুল, শিক্ষক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জীবজগতে উদ্ভিদ ও প্রাণী পরস্পর নির্ভরশীল। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। অনাদিকাল থেকে উদ্ভিদ ও প্রাণী টিকে থাকার সংগ্রামে একে অপরকে সহায়তা করে আসছে। বিশ্ব প্রকৃতিতে এদের অবস্থান পরস্পরের পরিপূরক। বৃক্ষ নানাভাবে আমাদের কাজে লাগে। খাদ্যের উৎস, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চিত্তবিনোদন এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষ আমাদের খাদ্য দেয়, অর্থ দেয়, ছায়া দেয়, আরও দেয় বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন। সবুজ চারাগাছ থেকে ফলবতী বৃক্ষ এবং বিশাল মহীরুহ থেকে শুকনো খড় বিচালি পর্যন্ত কোনোটাকেই উপেক্ষা করা যায় না। বৃক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের ফল, মিষ্টি রস, ভেষজদ্রব্য, কাঠখড়িসহ অনেক মূল্যবান সম্পদ পাই।

বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপাদনে বৃক্ষের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ফল শারীরিক ও মানসিক পরিপূর্ণতা বিকাশ লাভে সহায়তা করে।

মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে সজীব বৃক্ষের ন্যায় শুকনো কাঠেরও মূল্যবান ভূমিকা রয়েছে। ঘরবাড়ি, দালান-ইমারত ও রাস্তাঘাট নির্মাণে কাঠের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। গৃহস্থালীর আসবাবপত্র ও বিবিধ যানবাহন তৈরিতেও কাঠের ব্যবহার লক্ষণীয়। এছাড়া, বিভিন্ন ধরনের কাঠের ওপর ভিত্তি করে দেশে আসবাবপত্রের তৈরি বৃহৎ শিল্প এবং কাঠমিস্ত্রিদের দ্বারা ক্ষুদ্র ফার্নিচার শিল্প গড়ে ওঠেছে।

সমগ্র বিশ্বে বৃক্ষভিত্তিক বৃহৎ শিল্প যেমন- কাগজ, রাবার, রেয়ন, হার্ডবোর্ড, রেশম, চা, পামঅয়েল, কোকো ইত্যাদি এবং কুটির শিল্প, যেমন- আগর, রেজিন, লাক্ষ্মা, খয়ের, মলু, বাঁশ-বেত শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটেছে। তাল ও খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি হয়। এ রসের ওপর ভিত্তি করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গুড়ভিত্তিক গ্রামীণ শিল্পের প্রসার ঘটেছে। নারিকেলের ছোবড়া দিয়ে গদি, জাজিম, পাপোশ, রশি, ব্রাশ, ঝাড় এবং তাল ও খেজুরের পাতা দিয়ে পাটি, থলে, বেড়া, ঘরের ছাউনি ও কাণ্ড ঘরের বর্গা-খুঁটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। শিমুল গাছের তুলা দ্বারা লেপ, তোশক, বালিশ, সুতা ইত্যাদি তৈরি হয়। বৃক্ষের ডালপালা ও পাতা জ্বালানির প্রধান উৎস। দুনিয়ার সব রোগের ওষুধ রয়েছে উদ্ভিদের মধ্যে। ভেষজ বৃক্ষের শেকড়, ছাল-বাকল, পাতা, ফুল, বীজ ও বিভিন্ন ধরনের ফল, যেমন- আমলকী, হরিতকি, বহেড়া, অর্জুন, নিম ইত্যাদি আয়ুর্বেদিক/হারবাল/ইউনানী ওষুধ তৈরির প্রধান উপাদান। হেকিম ও কবিরাজরা ভেষজ ওষুধ দ্বারা সর্দি-কাশি, জ্বর, ব্যথা, হাড়ভাঙা, আমাশয়, কৃমি, বাত, সাদাশ্রাব, সুতিকা, মেহ-প্রমেহ, ডায়াবেটিস, প্রেসার, জন্ডিস, পাইলস, অ্যাকজিমাসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করেন। ভেষজ ওষুধ দ্বারা গবাদি পশুরও চিকিৎসা হয়। দেশে হামদর্দ, সাধনা, শক্তি, এপি, কুণ্ডেশ্বরীসহ বহু আয়ুর্বেদিক ওষুধ শিল্প গড়ে ওঠেছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকায় মানুষের এসব ওষুধের গ্রহণ যোগ্যতা রয়েছে। হারবাল প্রসাধনীর প্রধান উৎস বৃক্ষ। অনেক গাছের পাতা-ছাল-শেকড়-বীজ দ্বারা জৈব বালাইনাশক তৈরি হয়। বহু মূল্যবান ঔষধি বৃক্ষ বিলুপ্তির কারণে ভেষজ পণ্য আমদানি করতে হয়। তাই ঔষধি বৃক্ষ সংরক্ষণের জন্য সরকারি উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন।

বৃক্ষরাজি বাতাস থেকে কার্বন শোষণ এবং অক্সিজেন ত্যাগের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। একটি বয়স্ক বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে। বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডের অধিক বিষাক্ত গ্যাস শোষণ ও ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। শত শত টন কার্বন শোষণের মাধ্যমে বায়ুর দূষণরোধ ও তাপদাহ দুপুরে প্রস্বেদনের মাধ্যমে বাতাসে প্রায় ১০০ গ্যালন জল নির্গত করে পরিবেশ শীতল রাখে। বৃক্ষরাজি শব্দ দূষণও রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে।

গত ১ ফেব্রুয়ারি এক প্রতিবেদনে গবেষকরা গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা কমাতে শহরাঞ্চলেও বেশি বেশি গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ, গাছ তাপপ্রবাহের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত মৃত্যুর হার এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে। শহুরে পরিবেশ ৩০ শতাংশ গাছে আচ্ছাদিত করতে পারলে ০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমে যাবে।

এক তথ্যে দেখা যায়, ২০১৫ সালে ইউরোপের ৯৩টি শহরে উচ্চ তাপমাত্রায় ৬ হাজার ৭০০ জনের অকাল মৃত্যু ঘটে। গবেষকদের মতে, এই ধরনের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে শহুরে পরিবেশ গাছে আচ্ছাদিত করার কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে ইউরোপের শহুরে পরিবেশের মাত্র ১৫ শতাংশ এলাকা গাছে আচ্ছাদিত। বার্সিলোনা ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল হেল্থ-এর গবেষক ও প্রধান লেখক তামার ইংম্যান জানিয়েছেন, এ গবেষণাটিই প্রথম শহরগুলোতে উচ্চ তাপমাত্রাই অকাল মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি এর সমাধান হিসেবে বলা হয়েছে, শহর গাছে আচ্ছাদিত করেই শুধু এসব মৃত্যু প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এর মধ্যেই জানি, শহুরে পরিবেশে উচ্চ তাপমাত্রা নেতিবাচক স্বাস্থ্যের ফলাফলের সঙ্গে জড়িত। কারণ, হৃদযন্ত্রের ব্যর্থতা ও হাসপাতালে ভর্তি এবং অকাল মৃত্যু- সবই উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমাদের লক্ষ্য আরও টেকসই, স্থিতিস্থাপক ও স্বাস্থ্যকর শহুরে পরিবেশ। এজন্য কৌশলগতভাবে নগর পরিকল্পনায় সবুজ অবকাঠামোর সুবিধা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, এই অতিরিক্ত তাপ প্রধানত গাছপালার অভাবে সৃষ্টি হয়। জলবায়ু পরিবর্তন এরই মধ্যে সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গত বছর ইউরোপ উষ্ণতম গ্রীষ্ম এবং দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর হিসেবে রেকর্ড গড়েছে। বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহ রেকর্ড সর্বোচ্চ মাত্রা পরিগ্রহ করেছে। গবেষকরা দেখেছেন, ২০১৫ সালের জুন থেকে আগস্টের মধ্যে ২০ বছরের বেশি বয়সি মানুষের মৃত্যুর হার রেকর্ড গড়েছে। বিশ্লেষণে ধরা পড়েছে, ২০১৫ সালের গ্রীষ্মকালে ইউরোপের শহরগুলোর তাপমাত্রা আশপাশের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি ছিল।

এছাড়াও সবুজ বৃক্ষের মনোরম দৃশ্য ও নির্মল বাতাস সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ সব মানুষের চিত্তবিনোদনের আকর্ষণীয় উপাদান। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যে কোনো দেশের ২৫ শতাংশ ভূমিতে বনজঙ্গল থাকা দরকার। বাস্তবে সে পরিসর দিন দিন কমছে। সর্বত্র শুধু মানুষের প্রাবল্য। তার একান্ত নিজস্ব প্রয়োজন মেটাবার তাগিদে প্রকৃতির বাদবাকি সদস্যদের প্রতিনিয়ত ক্ষতি করে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশে উল্লেখযোগ্য হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বসতি স্থাপন এবং শিল্পায়নের ফলে বিপুল হারে আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস ও বন নিধন হচ্ছে। ফলে পৃথিবীর বহু দেশের মতো আমাদের দেশেও বৃক্ষ নিধনের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। গাছপালা ও বনজঙ্গল কমে যাওয়াতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন হয়েছে। ক্রমাগত ও নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তনের ফলে খাদ্য সংকট, জ্বালানি সংকট ও নির্মাণসামগ্রীর অভাব তীব্র আকার ধারণ করেছে। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে নিম্নের বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা মানব সম্প্রদায়েরই করণীয়। আমরা যে বন্যার উৎপাত সামলাই তার একটি কারণ; কিন্তু অবাধে বন ধ্বংস। এই যে পরিবেশ পরিবর্তন আর অসহ্য গরম বেড়েই চলেছে গাছ জলভূমি, পুকুর, দিঘি ভরিয়ে উন্নয়ন তার প্রধানতম কারণ। দেরি অনেক হয়ে গেছে ঠিকই। তারপরও বলব, যে বৃক্ষ আমাদের এত উপকারে আসে তার প্রতি আমাদের যত্নবান হওয়া উচিত। বৃক্ষ কর্তন নিয়ন্ত্রণ করে নতুন নতুন গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিকেরই কর্তব্য।