শুধু আইএমএফের ঋণ নয়, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানিও বাড়াতে হবে

মো. মাঈন উদ্দীন, অর্থনীতিবীদ, [email protected]

প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতি বেশ কিছু ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ব্যাংকিং খাত, মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ, ডলার সংকট ও সুদের হার। অব্যাহতভাবে কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ডলারের বিপরীতে টাকার মানও নিম্নমুখী এবং দেখা দিচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায় আয়-ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি। সরকারের সার্বিক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, ব্যয় মেটাতে সরকার ঋণনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়ছে। যা ভারসাম্য অর্থনীতি রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা। অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় আইএমএফের কাছে বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে। আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) বিভিন্ন প্রতিনিধি দল ঋণ আলোচনা চূড়ান্ত করার জন্য কয়েকবার এ দেশে সফরও করে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদন ও তুলে ধরেন। ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে অ্যাকশন প্লান ও তুলে ধরা হয়। এই সব বাস্তবায়নের জন্য এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। সর্বশেষ আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা অনুমোদন করে। প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৭ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করেছে। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিলে এসব অর্থ জমা হয়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে। ৩ হাজার ২৬৯ কোটি ডলার। এর আগে ছিল ৩ হাজার ২১৯ কোটি ডলার। আইএমএফ বাকি ৪২২ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার ৬ কিস্তিতে ছাড় দেবে। ৬ মাস পর পর কিস্তি পাওয়া যাবে। ২০২৬ সালে পুরো ঋণ পাওয়া যাবে। আইএমএফ এর এই ঋণ পাওয়াতে আরও অন্যান্য সংস্থা যেমন, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা থেকেও ঋণ পাওয়া সহজ হবে। আইএমএফের ঋণ পেতে এরই মধ্যে সরকার গ্যাসের দাম দু’দফা বাড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম এক দফা ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সারের দামও বাড়ানো হয়েছে। ফলে পণ্য মূল্য আরও বেড়েছে। মানুষের ভোগান্তি দিন দিন বাড়ছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। আমদানি ব্যয়ের প্রবল চাপে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। অব্যাহতভাবে রিজার্ভ কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য শংকার কারণ। ডলারের উপর চাপ বাড়ায় সামনে টাকার দাম আরও কমে যাবে। টাকার মান কমে গেলে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে আমদানি ব্যয় ও পণ্য মূল্য বেড়ে যাবে। এটা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আইএমএফের ঋণ ছাড় কতটুকু স্বস্তিদায়ক হবে তা দেখার বিষয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এ ঋণ পাওয়া অর্থনীতির জন্য সাময়িক সুখকর হলেও এটা পূর্ণ সমাধান বয়ে আনবে না। এ ঋণের সঙ্গে যে শর্ত/পরামর্শ রয়েছে তা দেখতে হবে। এখানে আমাদের আর্থিক খাত গুরুত্ব পেয়েছে। কর-জিডিপি বাড়াতে হবে। সংস্কার করতে হবে ব্যাংক খাতকে। নামিয়ে আনতে হবে খেলাপি ঋণ। আইএমএফের ঋণের টাকা সঠিকভাবে সঠিক কাজে ব্যবহার না করলে সমস্যা সমাধান তো হবেই না বরং দেশ গভীর গর্তে নিপতিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে আইএমএফ যে পরামর্শ দিয়েছে, তা পরিপালনে ব্যর্থ হলে ঋণ আটকেও যেতে পারে। এ ঋণের সঙ্গে তিন খাতের সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো- রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবপদ্ধতি ঠিক করা, জিডিপির তুলনায় অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের হার বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। এ ছাড়া জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে পদ্ধতি কার্যকর করা। আয়কর আইন সংসদে পাস করা। আদায়ের অযোগ্য খেলাপি ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন করা, কর ছাড়ের ওপর বিশদ নিরীক্ষা করা ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল-দাম সমন্বয় করা, বাজেট থেকে সঞ্চয়পত্রকে আলাদা করা, ব্যাংক খাতে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ তুলে নেয়া, নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ও সুদের হারের নির্দিষ্টসীমা প্রত্যাহার করা ইত্যাদি। আইএমএফ থেকে ঋণপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আইএমএফ এসব শর্তে পতিত হলো। আসলে বিদেশি এসব ঋণ অর্থনীতির জন্য সুষ্ঠু সমাধান নয়। ঋণের টাকা দিয়ে সমস্যা কিছুটা সমাধান হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ সমাধানের জন্য নীতি ও পদক্ষেপ নিতে হবে। ঋণ যাতে কাজে লাগে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আর্থিক খাতকে সুনির্দিষ্ট কাঠামোয় সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গত সেপ্টেম্বর ২২ এ তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে বর্তমানে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। ১ বছরের ব্যবধানে তা বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের কারণে দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা দিন দিন নাজুক হচ্ছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহকদের বিরুদ্ধে কালক্ষেপণ না করে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ধারা দেশের ব্যাংক খাত, ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থাৎ সার্বিক অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। ঋণ যাতে কুঋণ না হয়, সে ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে যথেষ্ট সজাগ থাকা উচিত। ঋণ যাতে খেলাপি না হয়, সে জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। খেলাপি ঋণের মামলা নিষ্পত্তিতে যুগোপযোগী আইন প্রয়োজন। রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে ব্যাংকারদের কাজ করার সুযোগ দেয়া উচিত। অর্থঋণ আদালতে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আইএমএফ খেলাপি ঋণ কমানোর ব্যাপারে যে পরামর্শ দিয়েছে তা কমানোও একটি ব্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে দেশ প্রেমিক ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসা উচিত। সরকার বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীদের নানা সুবিধা দিয়ে থাকলে ও ব্যবসায়ীরা সেভাবে এগিয়ে না আসায় খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিসহ ব্যাংক খাতে নানা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। টেকশই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অর্থনীতিতে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন থাকলেও দেশের অভ্যন্তরে যে সম্পদ রয়েছে, তার সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহার যদি স¦চ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে কাজে লাগানো যায়, তাহলে দেশের অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। বর্তমানে মেট্রোরেলসহ যে মেগা প্রকল্পগুলো রয়েছে তার বড় অংশ বিদেশি ঋণ নিয়ে হচ্ছে। যার কারণে দেশে কয়েক বছরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০২১-২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ১১১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে। অনুদানও ঋণ ধারাবাহিকভাবে পেয়েছে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে আমাদের বৈদেশিক ঋণ জিডিপি অনুপাত ছিল ১৭ শতাংশ। আইএমএফের হিসাবে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি যে পর্যায়ে রয়েছে তা টেকশই করতে, অবকাঠামো উন্নয়ন ঘটাতে, বাজেট বাস্তবায়ন করতে, বিদেশি ঋণের বিকল্প নেই, তবে বিদেশি ঋণ নিয়ে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো না যায়, অর্থনীতিকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে দাঁড় করানো না যায়, তাহলে ঋণে দেশ নিঃস্ব হয়ে যায়। যেমন : মিসর ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশও তার উদাহরণ। অর্থনীতিকে টেকশই করতে হলে উচ্চহারে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পাশাপাশি জবাবদিহিতাও থাকা চাই। মাথাপিছু আয় যদি দ্বিগুণও হয়, আর দরিদ্র বেকারত্ব ও অসমতা যদি বেড়ে যায়, তাহলে তাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে বলা সমীচীন হবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া। যেখানে মানুষের মৌলিক চাহিদা মিটবে, ন্যায়বিচার পাবে, সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটবে, জবাবদিহিতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে থাকবে। ফলে দেশীয় বা বিদেশি ঋণ হোক তার যথাযথ ব্যবহারও সেখানে থাকবে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নের বড় ঘাটতি হলো প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারা। বর্তমানে অর্থনীতিতে অস্থিরতা ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা, ব্যাংক খাতের নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি তা শুধু বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে নয় বরং তাতে জবাবদিহিতা ও কাঠামোগত দুর্বলতার অভাব ও কম দায়ী নয়। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি তা কমাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে হবে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে আনয়নের জন্য প্রবাসীদের উৎসাহিত করতে হবে। হুন্ডি রোধে বৈধপথে রেমিট্যান্স আনতে প্রবাসীদের দৌড়গোড়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলকে যেতে হবে। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সব ধরনের বিলাসী পণ্য আমদানি কমাতে হবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপের কারণে আমদানি কমেছে বটে; কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রায় পেমেন্টের পরিমাণ তেমন কমেনি। অভ্যন্তরীণ ব্যয় বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকিও কমাতে হবে। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। রপ্তানি বাড়ানোর জন্য শুধু পোশাক খাতের ওপর নির্ভর না করে সম্ভাবনাময়ী রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা উচিত। চামড়া, বস্ত্র, হোম টেক্সটাইল, পাদুকা শিল্পের রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার জন্য উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ও পর্যায়ক্রমে উচ্চ আয়ের দেশ হতে হলে অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক খাতেও মজবুতি আনতে হবে।