শিক্ষার্থীর অপ্রত্যাশিত ফলাফল প্রসঙ্গে

রেজাউল করিম খোকন, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক

প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল। আপাতদৃষ্টিতে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা, খামখেয়ালিপনা, অসহযোগিতার ন্যক্কারজনক প্রমাণ পাওয়া গেছে। যা সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের মারাত্মক হয়রানি, মানসিক চাপ ও বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দেশে যখন শিক্ষার প্রসারে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তখন বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের চরম খামখেয়ালি, দায়িত্বহীনতা এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি অসহযোগিতা আমাদের মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। এ প্রসঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থীর ভোগান্তির কথা তুলে ধরছি। সে গত ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীন একটি স্বনামধন্য কলেজ হতে অংশগ্রহণ করে।

সম্প্রতি ঘোষিত ফলাফলে উক্ত শিক্ষার্থী মেয়েটি যে গ্রেড লাভ করেছে, তা ছিল তার এবং তার পরিবারের জন্য সম্পূর্ণরূপে অপ্রত্যাশিত। অপ্রত্যাশিত ফলাফলে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, তাকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায় গোটা পরিবার। ভুক্তভোগী উক্ত শিক্ষার্থী তার প্রাপ্ত ফলাফল মেনে নিতে পারেনি কোনোভাবেই। পরীক্ষার মার্কশিট হাতে পেতেই দেখা যায়, মোট ৬টি বিষয়ের পরীক্ষার মধ্যে একটি বিষয়ে শিক্ষার্থীকে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে। অনুপস্থিত দেখানোর কারণে তার ফলাফলপত্রে উক্ত বিষয়ে কোনো ফলাফল আসেনি। ফলে তার সার্বিক ফলাফলে এর প্রভাব পড়েছে। অপ্রত্যাশিতভাবে নিম্নতর গ্রেড লাভ করেছে সে, যা মোটেও তার প্রাপ্য নয়। অনুপস্থিত দেখানো বিষয়টির দুটি পত্রের লিখিত এবং ব্যবহারিক পরীক্ষায় সে অংশগ্রহণ করেছে। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে সে উপস্থিতির স্বাক্ষরও করেছে। অথচ তার অংশ নেয়া বিষয়ে অনুপস্থিতি দেখিয়ে ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে তার প্রকৃত ফলাফল না এসে নিম্নতর গ্রেডের ফলাফল এসেছে। এতে ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থী নিজে চরম হতাশা, অনিশ্চয়তা, মানসিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। পাশাপাশি তার পরিবারের সবাই, অভিভাবকদের মারাত্মক হয়রানির মধ্যে পড়তে হয়েছে। যখন তার সহপাঠি অন্যান্য শিক্ষার্থীরা তাদের প্রত্যাশিত ফলাফল লাভের সাফল্য উপভোগ করছে, তখন তাকে একধরনের হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত হতে হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীসহ আরও কয়েকজন পরীক্ষার সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গৃহীত পরীক্ষার কাগজপত্র পরীক্ষাকেন্দ্রে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-শিক্ষকদের অবহেলা, গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে নথিভুক্ত হয়নি। যে কারণে তারা উক্ত বিষয়ের দুইপত্রে লিখিত ও ব্যবহারিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সত্ত্বেও তা মূল ফলাফলে যুক্ত হয়নি বরং বাদ পড়ে গেছে। এতে করে তাদের ফলাফল অপ্রত্যাশিতভাবে নিম্নতর গ্রেডে এসেছে।

আমাদের প্রশ্ন, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-শিক্ষকদের এ চরম দায়িত্বহীনতার, গাফিলতি ও অবহেলার কারণে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের যে মানসিক হয়রানি, হতাশা, যাতনার শিকার হতে হলো- তার দায় কে নেবে? আমি যে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর কথা উল্লেখ করেছি তার পরিবার, অভিভাবক শিক্ষিত এবং সচেতন হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি বোর্ড কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত করেছেন বলে এ ব্যাপারে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অনুসন্ধানের পর ভুক্তভোগীর দাবির যৌক্তিকতা বিবেচনায় এনে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেছেন কর্তৃপক্ষ। এখন প্রশ্ন, যদি কোনো শিক্ষার্থীর অভিভাবক তেমন শিক্ষিত, সচেতন কিংবা সামাজিকভাবে প্রভাবশালী না হয়, তাহলে পরীক্ষাগ্রহণকারী সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও বোর্ড কর্মকর্তার অবহেলা, গাফিলতির কারণে তাদের সন্তান তেমন ভোগান্তির শিকার হয়, প্রত্যাশিত ফলাফল লাভে ব্যর্থ হয়, তাহলে তা আড়ালেই রয়ে যাবে? তারা তাদের প্রাপ্য ফলাফল লাভে ব্যর্থ হয়ে অনিশ্চিত এক জীবনের দিকে ধাবিত হবে? এরকম বহু ঘটনার বিবরণ আমরা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখতে পাই। এধরনের ঘটনার শিকার বহু শিক্ষার্থীর সম্ভাবনাময় শিক্ষাজীবন চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে এরই মধ্যে।

শিক্ষাকার্যক্রম একটি নিবিড় পরিচর্যার বিষয় সন্দেহ নেই। এখানে গাফিলতি, দায়িত্বহীনতা, অবহেলা, অব্যবস্থাপনার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারও নেই। যারা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে, চরম হতাশা, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, মানসিক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করছে, তাদের অবশ্যই বিচার ও জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার বলে মনে করি। বর্তমান আধুনিক সমাজব্যবস্থায় মানবসম্পদকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকলেও মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহার ঘটিয়ে একটি দেশ বিপুল সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। জাপান, তাইওয়ান ও কোরিয়া তার উজ্জ্বল উদাহরণ। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের ছড়াছড়ি নেই। তবে মানবসম্পদকে যথার্থ শিক্ষায় শিক্ষিত, দক্ষ, অভিজ্ঞ করে তুলতে না পারলে, আগামী দিনগুলোতে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব হবে। একজন মেধাবী শিক্ষার্থী যদি শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ও শিক্ষকের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা, খামখেয়ালির কারণে পরীক্ষায় তার পরিশ্রমলদ্ধ উপযুক্ত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থ হয় এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সবার সচেতনতা, কামনা করছি। শিক্ষার প্রসারে সংশ্লিষ্ট বোর্ড কর্মকর্তাদের আরও দায়িত্বশীল এবং স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে সতর্ক ও মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।