মতামত

ছাত্র, ছাত্র রাজনীতি ও অভিভাবক

মাহমুদুল হক আনসারী, সংগঠক, গবেষক, কলামিষ্ট, [email protected]

প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ছাত্র ও ছাত্র রাজনীতি সেটি আমাদের দেশে ছাত্রদের মাধ্যমে চলে আসছে। ছাত্রদের মৌলিক কাজ হলো লেখাপড়া করা। স্কুল জীবন শেষ করে সর্বোচ্চ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য তাদের পদার্পণ। অনেক কষ্ট ও সাধনার পর ছাত্ররা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার জন্য উপস্থিত হয়। অভিভাবক মহল তাদের কষ্টার্জিত টাকা-পয়সা দিয়ে তাদের মানুষ হওয়ার জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাকেন্দ্রে প্রেরণ করে। তাদের কাছে অভিভাবকের আকাশ-কুসুম আশা ও ভরসা থাকে। ছাত্ররা মনোযোগী হয়ে পড়ালেখা করবে। মানুষ হয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে দেশ-জাতি-সমাজ ও পরিবারের পাশে দাঁড়াবে। এটিই অভিভাবকমণ্ডলীর আশা ও ভরসা ছিল। ছাত্ররা শিক্ষার্জনের পাশাপাশি সামাজিক খেলাধুলা করবে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে। লেখালেখি ও সৃজনশীল কাজকর্মে সময় ব্যয় করবে। পাশাপাশি গণতন্ত্রকে চর্চা করবে। গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা লালন পালন থাকা চায়।

সে হিসেবে ছাত্ররা গণতন্ত্র চর্চার জন্য ছাত্র রাজনীতি করবেন, সেখানে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। মূল কার্যক্রম হলো- তাদের শিক্ষা সংস্কৃতি লেখাপড়া ও মানবিক গুণাবলি অর্জন করা। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য টার্গেট হলো একজন প্রকৃত মানবতাবাদী মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করা। সেজন্যই এতগুলো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যেই হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানের জন্ম। সে প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাজার হাজার শিক্ষক শিক্ষাদানে নিয়োজিত আছে। শত শত কোটি টাকা এসব কার্যক্রমে প্রতিনিয়ত সরকার এবং অভিভাবকের খরচ হচ্ছে। এর পেছনে বাস্তব উদ্দেশ্য হলো একজন ছাত্র যেনো পশু চরিত্র থেকে বেরিয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে সমাজে অভিভাবকের কাছে ফিরে আসে। সমাজকে যেনো আলোকিত করে আর রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখে। বাংলাদেশ এখন দুনিয়াজুড়ে একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এদেশের মানুষ এখন খেয়েদেয়ে, কাজকর্ম করে বেঁচে থাকার সংগ্রামে সফল হচ্ছে।

সেই সফলতার হাতকে শক্তিশালী করবে নতুন প্রজন্ম আগামীদিনের ভবিষ্যৎ ছাত্রসমাজ। ছাত্র যুবক তারাই দেশের অন্যতম শক্তি। সে শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে সম্মিলিতভাবে দেশের কল্যাণে এগিয়ে নিতে হবে। ছাত্ররা রাজনীতি করুক, সেটি কোনো সমস্যার বিষয় নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রদের অনেক ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাষা দিবস স্বৈরাচারী সরকারের পতন এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করার জন্য ছাত্র রাজনীতির বিকল্প নেই। সেই ইতিহাস সবার কাছেই পরিষ্কার। কিন্তু ক্রমান্বয়ে ছাত্রদের গৌরবময় ইতিহাসকে কলঙ্কিত করছে তথাকথিত একটি গোষ্ঠী। যারা রাজনীতিকে নিজেদের রোজী-রোজগারের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে, ক্ষমতাকে অন্যায়ভাবে পাকাপোক্ত করতে চায়, যারা রাজনীতিকে রুটিরুজির অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করে তারাই আজকে ছাত্রদের অন্যায় কাজে ব্যবহার করছে। ছাত্রদের মধ্যে একটি আদর্শ গ্রুপ রয়েছে। যারা ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে নৈতিক গুণাবলি শিখছে। নেতৃত্ব ও ভ্রাতৃত্ব তৈরি করছে। লেখাপড়ার সঙ্গে ছাত্ররাজনীতির অনুশীলনের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করছে। পক্ষান্তরে আরেকটি পক্ষ ছাত্ররাজনীতিকে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। দুই হাতে অবৈধ অর্থ উপার্জন করছে। কাউকে ক্ষমতায় ধরে রাখার জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থের লোভে ক্ষমতার দাপটে সতীর্থদের ওপর অন্যায়ভাবে জুলুম-অত্যাচার চালাচ্ছে। ক্যাম্পাসকে অন্যায়ভাবে শাসন করছে। রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রী-এমপির ছত্রছায়ায় এসব তথাকথিত ছাত্রনামধারী পদবি ব্যবহার করে ক্যাম্পাসকে রণাঙ্গনে পরিণত করেছে। এই যে কয়েকদিনের মাথায় চট্টগ্রাম-বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এবং ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শাসকদলের ছাত্রসংগঠনের নেতানেত্রীদের মাধ্যমে যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তা গোটা দেশবাসী জানতে পেরেছে। এমন কোনো সংবাদ মাধ্যম নেই, যেখানে এইসব ঘটনা প্রচার হয়নি।

সেসব ঘটনাতে অভিভাবক মহল যা জানতে পেরেছে তা আমার বলার উদ্দেশ্য নয়। আমি বলতে চাই যেসব ছাত্র নেতারা এ ধরনের অমানবিক ও অমানসিক ঘটনা সংঘটিত করেছে, সেটি কোনো বোধ সম্পন্ন ছাত্রের কাজ হতে পারে না। মানুষ হওয়ার প্রতিষ্ঠানে মানুষ হওয়ার জন্য যাওয়া শিক্ষার্থীদের এমন জঘণ্য আচরণ একটি পশুর মধ্যেও পাওয়া যাবে না। আমরা এসব কার্যকলাপে খুবই উদ্বিগ্ন। মানুষ হিসেবে তৈরি হওয়ার জন্য দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে প্রেরণ। সেখানে যখন এমন ধরনের আচরণ ঘটনা কার্যকলাপ অভিভাবক মহল দেখে, তখন কোনোভাবেই তারা শান্ত থাকতে পারে না। কিন্তু এসব কোমলমতি ছাত্রদের রাজনীতির নামে কারা অপরাজনীতিতে ব্যবহার করছে তাদেরই বর্তমান সময়ে চিহ্নিত করা দরকার। নিশ্চয় তাদের আগে পিছে গডফাদার আছে। যাদের ইশারায় ইঙ্গিতে সার্বিক সহযোগিতায় একজন ছাত্রনেতা তার সতীর্থদের ওপর এভাবে পশুর মতো অত্যাচার করতে তৈরি হয়। রাজনীতি রাজনীতির গতিতে চলুক, সেখানে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার সন্তানদের রাজনীতির নামে ব্যবহার করে গুম-খুন-হত্যা-রাহাজানী এবং সতীর্থদের ওপর জাহেলীয়াতের মতো আচরণ করতে, ব্যবহার করতে আমরা দিতে পারি না। আমাদের সন্তানদের আমরাই কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছি।

তাদের রাজনীতির নামে অপরাজনীতিতে ব্যবহার করার আপনি কে? এসব রাজনীতি বন্ধ করুন। আপনার রাজনীতি আপনি করুন। আমাদের সন্তানদের পারলে ভালো কিছু শিখান। যাতে করে তারা ব্যক্তি পরিবার ও সমাজ জীবনকে সুন্দর করতে পারে। অর্থ ক্ষমতা পদ-পদবির লোভ দেখিয়ে কোমলমতি ছাত্রদের জীবনকে শেষ করবেন না। আমি একজন অভিভাবক হিসেবে সাম্প্রতিক ক্যাম্পাসে সংঘটিত সব ছাত্র সংঘাতের গভীরভাবে নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছি। এসব ঘটনার সঙ্গে ইন্ধনদাতা সাহায্যকারী এবং যারাই জড়িত তাদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। অনুরোধ করব ছাত্ররাজনীতির নামে দখলদারিত্ব অপরাজনীতি বন্ধ করার জন্য সবপক্ষকে সবিনয় আবেদন জানাচ্ছি।