অভিমত

ভাষার সন্ধানের মাস ফেব্রুয়ারি

মো. আজিনুর রহমান, শিক্ষক, লেখক ও সমাজকর্মী

প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ফেব্রুয়ারি হলো ইংরেজি সনের দ্বিতীয় মাসের নাম। এই ফেব্রুয়ারি মাসেই আমরা ভাষার সন্ধান করি। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করা হয় বলেই ফেব্রুয়ারি মাস বাঙালি জাতির কাছে অনন্য মাস। বছরের অন্যান্য মাসগুলোতে অন্যান্য কারণে বিশেষায়িত হলেও ফেব্রুয়ারি মাসকে ভাষার কারণেই অধিক মূল্যায়ন করা হয়। ভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটি মাধ্যম। ভাষা না থাকলে মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতে পারত না। ভাষা না থাকলে মানুষ কোনো কিছু নিয়ে লিখতে পারত না। ভাষা না থাকলে কোনো বিষয়ের গবেষণা করতে পারত না। এজন্য সৃষ্টিকর্তা মানুষ সৃষ্টি করে তাদের জন্য ভাষা দিয়েছেন। ভাষার ইতিহাস ইসলামের প্রথম নবী আদম (আ.) থেকে সূচনা হয়। তবে আমরা বাংলা ভাষার উৎস নিয়ে আলোকপাত করব।

যে ভাষা আমরা জন্মের পর থেকে শুনে আসছি, যে ভাষায় নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে চলেছি, সেই প্রাণের ভাষা বাংলা কোথা থেকে এলো? কীভাবে এর উৎপত্তি? আসলে বাংলা ভাষার উৎপত্তি নিয়ে আছে নানা জনের নানা মত। তবে এটা সত্য যে, বাংলা ভাষা একদিনে আজকের পর্যায়ে আসেনি। শত সহস্র বছরের বিবর্তনে এটি আজকের রূপ পেয়েছে। এখন আমরা যে বাংলা ভাষা বলি, এক হাজার বছর আগে তা ঠিক এমন ছিল না। এক হাজার বছর পরেও ঠিক এমন থাকবে না। ভাষা এমনই চলমান প্রক্রিয়া। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটির সমৃদ্ধ হয় এবং নতুন রূপে বিকশিত হয়।

বাংলা ভাষার ইতিহাস জানতে হলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। পিছিয়ে যেতে হবে অন্তত কয়েক হাজার বছর। ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রাচীন ভাষাগুলোকে বলা হয় প্রাচীন ভাষা আর্য। মূলত মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম ছিল এটি। প্রাচীন আর্যভাষার সঠিক কোনো কাঠামো ছিল না। পরে এই আর্যভাষা রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় প্রয়োজনে ব্যবহারকালে পণ্ডিতরা যীশু খ্রিষ্টের জন্মেরও ১ হাজার বছর আগে একটি লিখিত রূপ দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। আর্য ভাষা রূপান্তরিত হয় বৈদিক ভাষায়। সেটি ছিল উঁচু গোত্রের মধ্যেই প্রচলিত। সাধারণ মানুষের কাছে বেদের ভাষা বা বৈদিক ভাষা দুর্বোধ্য মনে হতো। তাই তারা দৈনন্দিন জীবনে আঞ্চলিকতার প্রভাবে পাল্টে যাওয়া আর্য ভাষাতেই মনের ভাব প্রকাশ করতো। শতাব্দীর পর শতাব্দী কাটতে থাকে আর আঞ্চলিকতার প্রভাবে মূল ভাষাটি চাপা পড়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃত ভাষার উৎপত্তি হয়। সাধারণ মানুষের কথ্যভাষা প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। এ প্রাকৃত ভাষাগুলোর শেষ স্তরের নাম অপভ্রংশ অর্থাৎ যা বিকৃত হয়ে গেছে। বিভিন্ন অপভ্রংশ থেকেই উৎপন্ন হয়েছে নানান আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষা। যেমন- বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, পাঞ্জাবী। এই ভাষা বিভিন্ন স্থানে স্থায়িত্ব লাভ করে আঞ্চলিকতায় মায়ের ভাষায় পরিণত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তা রাষ্ট্রভাষায় পরিণত হয়েছে। তবে বাংলা বাংলাভাষাকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা করতে গিয়ে বহু ত্যাগ-তিতীক্ষা পোহাতে হয়েছে। রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করতে হয়েছে।

এমনকি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে গিয়ে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন তারই ফসল। এই আন্দোলন বিশ্বের ইতিহাসে এক নজীর সৃষ্টি করেছে। যা বাঙালি জাতির জন্য স্মরণীয় ইতিহাস। সেই ইতিহাসের ফলাফলকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি এবং ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হবে’ প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। আর এভাবেই বাংলা ভাষার বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া চলতে শুরু করে। বাংলা ভাষার এই চলন বাংলাদেশে চলছে, চলবেই। তবে বাংলা ভাষাকে নিয়ে চর্চার কোনো বিকল্প নেই। বাংলা ভাষার বিকৃতির আলোকপাত আমরা এর আগেই জেনেছি। চর্চাবিহীন বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটে বাংলাভাষা ভিন্নতায় রূপ নেবে। বাংলা ভাষাকে নিয়ে চর্চার মাস শুধু ফেব্রুয়ারির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বারো মাসেই চর্চা করতে হবে। ভাষার জন্য রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের ইতিহাস স্মরণে রেখে বাংলা ভাষার সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। তাই আসুন বাংলা ভাষার প্রতি যত্নশীল ও শ্রদ্ধাশীল হই। বাংলাকে ভালোবাসী, বাংলার জয়গান গাই।