ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আমেরিকার গণতন্ত্র সম্মেলন কতটুকু গণতান্ত্রিক?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমেরিকার গণতন্ত্র সম্মেলন কতটুকু গণতান্ত্রিক?

বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল নির্বাচিত হলে প্রথম বছরেই বৈশ্বিক গণতন্ত্র সম্মেলন আয়োজন করবেন তিনি। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রথম গণতন্ত্র সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হলো। এই গণতন্ত্র সম্মেলন কতটুকু গণতান্ত্রিক সে প্রশ্ন উঠেছে জোরেশোরে। কারণ এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য যে ১১২টি দেশকে নির্বাচন করা হয়েছে, সেসব দেশ নির্বাচনের তেমন কোনো গণতান্ত্রিক যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। অংশগ্রহণকারী দেশ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সামরিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক, ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ এবং নিজেদের কৌশলগত সমর্থনকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

তিনটি বিশেষ মানদণ্ড ঘিরে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো হলো- ১. গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতার সুরক্ষা ও কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা, ২. দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং ৩. মানবাধিকারের সমুন্নয়ন। উল্লিখিত মানদণ্ডে কিন্তু আমন্ত্রিত বেশিরভাগ দেশই উত্তীর্ণ হওয়ার কথা নয়। আসলে এ সম্মেলনটা যতটা না গণতন্ত্রবিষয়ক, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। এ রাজনীতি হলো বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্বের রাজনীতি। মিত্রদের কাছে টানার রাজনীতি। কিছু দেশকে দেখিয়ে দেয়ার রাজনীতি। বাংলাদেশের মতো দেশকে সতর্ক করার রাজনীতি।

বিশ্বরাজনীতিতে এখন আমেরিকার প্রধান প্রতিপক্ষ চীন। পুরোনো শত্রু রাশিয়া তো আছেই। এই দুই দেশই গণতন্ত্র সম্মেলনের তালিকায় বাদ পড়েছে। কিন্তু চীনের প্রবল প্রতিপক্ষ তাইওয়ান এবং রাশিয়ার গলার কাঁটা ইউক্রেনকে আমেরিকা ঠিকই দাওয়াত দিয়েছে। আর তাই তো গর্জে উঠেছে চীন ও রাশিয়া। চীনের অভিযোগ, আমেরিকা গণতন্ত্রকে ‘গণনিধনের অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে। ‘বিভাজন’ ও ‘সংঘাত’ তৈরি তাদের আসল লক্ষ্য। চীনকে একঘরে করে তার উত্থান থামানোর চেষ্টা করছে আমেরিকা। উল্লেখ্য, বাইডেনের গণতন্ত্র সম্মেলনে ডাক পেয়েছিল মানবাধিকারহীন কর্তৃত্ববাদী ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত পাকিস্তান। কিন্তু এ সম্মেলনে অংশ না নিতে পাকিস্তানের ওপর চাপ তৈরি করে চীন। আর তাই তো ‘বিপদের বন্ধু’ চীনকে চটিয়ে সম্মেলনে অংশ নেয়ার সাহস দেখায়নি ইমরান খানের সরকার।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, বিশ্বব্যাপী আমেরিকার যে ভূমিকা তাতে করে তাদের মুখে কর্তৃত্ব, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা শুনলে খটকা লাগে। দুনিয়াজুড়ে রাজনৈতিক মহলে জনপ্রিয় বাক্য হলো, আমেরিকা যার বন্ধু তার আর শত্রুর দরকার হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে দেশে দেশে যতগুলো সামরিক ক্যু ও সরকার উৎখাত হয়েছে এর ৯৯ শতাংশ সংঘটিত হয়েছে আমেরিকার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ হস্তক্ষেপে। অপছন্দের শাসকদের সরাতে আমেরিকা গত ৮০ বছরে বিশ্বে কি-না করেছে? যুদ্ধ বাধানো, বোমা ফেলা, ক্যু, অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ, সরকারের বিরুদ্ধে মিডিয়ার নিরন্তর অপপ্রচার এবং এক সময় সামরিক আগ্রাসনের পথ প্রশস্ত করা ও তা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে আমেরিকা গোটা দুনিয়ায় নিজের অপছন্দের শাসকদের উচ্ছেদ ও উৎখাত করেছে। প্রতিপক্ষ কোনো দেশের অগ্রগতি থামানোর জন্য সেই দেশের এলিট শ্রেণি, বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা বা গুপ্তহত্যায়ও আমেরিকার জুড়ি নেই! এমনকি কৌশলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে লাখ লাখ মানুষকে হত্যার ক্ষেত্রেও আমেরিকা ভূমিকা পালন করেছে।

এমন একটি দেশ কী করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পৃষ্ঠপোষক হয়? আমেরিকার গণতন্ত্র আসলে নিজের স্বার্থ রক্ষার গণতন্ত্র। তারা নিজেদের সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য এখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং বাক-স্বাধীনতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। নিজেদের প্রভাব ও ক্ষমতা বজায় রাখতে এবং অপকর্ম আড়াল করতে এই তিনটি জিনিসের কথা বলে তারা আগ্রাসন চালায়, লুটপাট করে, যুদ্ধ বাধায়। মার্কিন গণতন্ত্র অনবরত এক লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যে লড়াইয়ের লক্ষ্য আমাদের নিজেদের ভেতরের মতানৈক্য দূর করা এবং জাতির আদি স্থপতিরা স্বাধীনতার ঘোষণায় যে আদর্শের কথা বলেছিলেন, তা রক্ষায় পুন: অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া। অন্য কথায়, প্রজাতন্ত্র ধরে রাখতে হলে গণতন্ত্রকামী প্রতিটি দেশের মানুষকে এই লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। গণতন্ত্র গ্যালারিতে বসে দেখার মতো কোনো খেলা নয়, এর জন্য চাই অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি।

বাইডেন প্রশাসনের প্রত্যাশা ছিল, এই শীর্ষ সম্মেলনের ভেতর দিয়ে আমন্ত্রিত দেশগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি তাদের অঙ্গীকার নবায়ন করবে এবং গণতন্ত্র রক্ষার একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন জানাবে। মুখে মুখে সবাই তেমন অঙ্গীকার করেছে বটে; কিন্তু এই ভার্চুয়াল বৈঠকে বায়বীয় সে ঘোষণা আদৌ কোনো গুরুত্ব বহন করে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ যায়নি। প্রথম সন্দেহ সম্মেলনের আয়োজক যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে। আমেরিকায় গণতন্ত্র এ মুহূর্তে বিপুল হুমকির সম্মুখীন। এক বছর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে এখনও সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হয়নি। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টির ৬৮ শতাংশ সমর্থক মনে করে, এই মুহূর্তে যে লোকটি হোয়াইট হাউস দখল করে আছেন, তিনি একজন প্রতারক। নির্বাচনে আসলে যিনি জিতেছেন, তার কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে নির্বাচনে সেই ট্রাম্প আবারও ফিরবেন, এমন কথা খোলামেলাভাবেই বলা হচ্ছে। যার নিজের বাড়ি আগুনে জ্বলছে, সে কী করে অন্যের ঘরের আগুন নেভাবে? যে নিজে রোগী, সে কী করে ডাক্তারের ভূমিকা নেবে?

সমস্যা হলো, সম্মেলনের আমন্ত্রিতদের তালিকা দেখে মনে হয়েছে, বিশ্বের সর্বত্র গণতন্ত্রের সুরক্ষা নয়, আমেরিকা এই সম্মেলন আয়োজন করেছে নিজের দল ভারী করতে। এ কথা বলার কারণ, যুক্তরাষ্ট্র যাদের মিত্র বলে মনে করে, শুধু তাদেরই দাওয়াত পাঠিয়েছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার বৈরিতা তীব্র হচ্ছে, এই বৈরিতায় আমেরিকা আমন্ত্রিত দেশগুলোকে নিজের পাশে চায়।

কুইন্সি ইনস্টিটিউটের ফেলো আনাতোল লিয়েভেনের কথায়, সম্মেলনের উদ্যোগটাই ভ্রান্ত। কেন তা বুঝতে শুধু নরেন্দ্র মোদি এ নামটা উচ্চারণ করাই যথেষ্ট। এ সম্মেলনের একটা উদ্দেশ্য চীনা কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধা, কিন্তু মোদিকে বাদ দিয়ে সে জোট বাঁধা যাবে না। অতএব, মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। কিন্তু মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তার সরকারের কর্তৃত্ববাদী চরিত্র অস্বীকার করলে পুরো সম্মেলনই পরিহাসে পরিণত হয়। আর হয়েছেও তাই। একইভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিজের ছাতির তলায় ধরে রাখতে পোল্যান্ডকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যদিও দেশটি দ্রুত সংখ্যাধিক্যের একনায়কতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। গণতন্ত্র হয়তো মার্কিন বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রে রয়েছে, কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের ঊর্ধ্বে তার অবস্থান নয়।

লিয়েভেনের মতো টাইম ম্যাগাজিনও মনে করে, আসলে এই সম্মেলন ‘ফারস’ ছাড়া আর কিছু নয়। এই সম্মেলনে এমন একাধিক সরকারপ্রধান আমন্ত্রণ পেয়েছেন, যারা খোলামেলাভাবে কর্তৃত্ববাদী। এসব রাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাইডেন প্রশাসন ‘কপটতার’ প্রমাণ রেখেছে।

এই সম্মেলন একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ। আমেরিকানরা ডেমোক্র্যাসিকে ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে দেখে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে গ্লোবাল ডেমোক্র্যাসি, হিউম্যান রাইটস ইস্যুতে তাদের যে ঘাটতি ছিল সে জায়গা থেকে তারা উত্তরণের চেষ্টা করছে। মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে তাদের যে অবস্থান তা বিশ্বব্যাপী প্রচার করতে চাইছে তারা। চীনকে কেন্দ্র করে বাইডেন সরকারের যে গ্লোবাল স্ট্রাটেজি তাও জানান দিচ্ছে এই সম্মেলন।

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, তার অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের অবস্থা। বাইডেন ভেতরের এ সংকট মোকাবিলা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমেরিকা এখনও তাদের সব নাগরিকের ভোটাধিকার দিতে পারেনি। বলে রাখা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আদর্শ হিসেবে গণতন্ত্রের কথা বলার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়ানো, যাতে অন্যরা অনুসরণ করতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত