ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বিতর্কের অবসান হোক

এম. এ. মাসুম, ব্যাংকার ও কলাম লেখক, [email protected]

প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সম্প্রতি ব্যাংকিং ডিপ্লোমা নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যে ব্যাপক তর্কবিতর্ক চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পত্রপত্রিকা এবং ব্যাংক পাড়ায় এ নিয়ে মতপ্রকাশ ও আলোচানা-সমালোচনায় মুখর। এর সঙ্গে ব্যাংকের সঙ্গে সিংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরাও তাদের মতামত দিচ্ছেন। আলোচনাটি শুরু হয়েছে মূলত ব্যাংকিং ডিপ্লোমাকে কেন্দ্র করে গত ৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সার্কুলারকে নিয়ে। সার্কুলারে বলা হয়েছে ব্যাংকের চাকরিতে সিনিয়র অফিসার (জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা) অথবা সমতুল্য পদের পরবর্তী সময়ে সব পদে পদোন্নতি পেতে হলে ব্যাংকিং ডিপ্লোমার দুই পর্বেই পাস করতে হবে। দেশে কার্যরত সব তপশিলি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম কার্যকর হবে। ব্যাংকিং কার্যক্রমে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয়; যেমন ডাক্তার, প্রকৌশলী (পুরকৌশল, যন্ত্রকৌশল, তড়িৎকৌশল), ব্যাংকের প্রচার ও প্রকাশনা এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মরত কর্মকর্তা ছাড়া সবাইকে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অথবা সমতুল্য পদের পরবর্তী সময়ে সব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ডিপ্লোমার উভয় পর্ব পাস করতে হবে।

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা, প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্যাডার, পুলিশ এমনকি ডাক্তারদেরও তাদের চাকরিতে কনফার্ম অথবা পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস করতে হয়। একজন ডাক্তারের এফসিপিএস, এমএস, এফআরসিএস ইত্যাদি উচ্চতর ডিগ্রি থাকলেও বিভাগীয় পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। বিসিএস পাস করার পর প্রশাসন ক্যাডারদেরও বিভাগী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এসব কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত দেশি-বিদেশি উচ্চতর ডিগ্রি থাকলেও তাদের বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস করা বাধ্যতামূলক। তাই কোনো ব্যাংক কর্মকর্তার দেশি-বিদেশি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রি থাকলেও ব্যাংকারদের বিভাগীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

সংশ্লিষ্ট বিভাগের সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পদোন্নতির নীতিমালা এক ও অভিন্ন। কিন্তু ব্যাংকারদের চাকরির নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়া ব্যাংক ভেদে ভিন্নতা আছে। সরকারি সব ব্যাংকে ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটি (বিআরসি) এর মাধ্যমে চাকরির নিয়োগের ব্যবস্থা থাকলেও পদোন্নতির নীতিমালা এক নয়। অন্যদিকে অনেক বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের মতো করে কর্মী নিয়োগ দেয়। তবে কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংকে বিশেষ করে নতুন কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পরীক্ষাই নেয়া হয় না, এমন অভিযোগও পাওয়া যায়। আবার ব্যাংকগুলোর মধ্যে পদোন্নতির নীতিমালার অভিন্নতা নেই। তাই অনেক ব্যাংকার মনে করেন, শুধু ডিপ্লোমা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক না করে সব ব্যাংকের পদোন্নতি প্রক্রিয়াও অভিন্ন হওয়া উচিত। তাহলে ডিপ্লোমা পরীক্ষার বিতর্ক অনেকটা হ্রাস পাবে।

বড় ব্যাংকগুলোতে ব্যাংকিং ডিপ্লোমাধারীর সংখ্যা অনেক থাকলেও ছোট ব্যাংকে ডিপ্লোমাধারীর সংখ্যা কম এবং কর্মকর্তারা এর গুরুত্বও কম দিয়ে থাকেন। কারণ বড় ব্যাংকগুলোতে পদোন্নতির প্রতিযোগিতা বেশি। ছোট ব্যাংকগুলোর জনশক্তি কম থাকায় পদোন্নীতির প্রতিযোগিতা অপেক্ষাকৃত কম, তাই তারা এ ধরনের পরীক্ষার গুরুত্ব কম দিয়ে থাকেন। ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বাধ্যতামূলক করা হলে ছোট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সমস্যা বেশি হতে পারে।

ব্যাংকিং ডিপ্লোমার সমস্যা বহুবিধ। প্রথমটা শুরু হয় কোনো ব্যাংকে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাসকৃত ছাত্রদের প্রথম ঝোঁক থাকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরির প্রতি। তাই একজন নতুন ব্যাংকার ব্যাংকে চাকরিতে ঢুকেই বিসিএসসহ সরকারি অন্যান্য চাকরি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ফলে ব্যাংকি ডিপ্লোমা পরীক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ থাকে না। অন্য ভালো চাকরি না হওয়ায় বাধ্য হয়েই তিনি ব্যাংকে থেকে যান; কিন্তু এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। তারপর বিয়েসাদি করার মাধ্যমে চাকরির পাশাপাশি সংসারের দায়িত্ব ও ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এসময়ে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা দেয়া শুরু করলেও ব্যাংক এবং পরিবারের দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় পরীক্ষায় সেভাবে মনোযোগী হতে পারেন না এবং পাস করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে এবং একসময় হতাশায় পরীক্ষাবিমুখ হয়ে পড়েন। আবার অনেকে আছেন যারা ব্যাংকে যোগদান করার পর কয়েকটি বিষয় পরীক্ষা দিয়ে আর হলে ফেরেন না। পরীক্ষায় অনিয়মিত হওয়ার ফলে তাদের পাস করা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

ব্যাংকিং ডিপ্লোমার বিষয়গুলো তাত্ত্বিকনির্ভর না হয়ে ব্যবহারিক হওয়া উচিত। কিন্তু ডিপ্লোমা অনেক বিষয় ব্যবহারিক না করে অধিক তাত্ত্বিক ও জটিল করা হয়েছে। যেমন হিসাববিজ্ঞান বিষয় অনার্স মাস্টার্সের মতো কঠিন করা হয়েছে, যার ফলে অন্য বিভাগ তো আছেই বাণিজ্য বিভাগ থেকে পাস করেও ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় পাস করতে হিমশিম খেতে হয়। অন্য বিষয়গুলোর অবস্থাও অনেকটা একই রকম। বর্তমানে ডিজিটাল ব্যাংকিং হওয়ায় নতুন প্রজন্ম ডিজিটালের আড়ালে কীভাবে ব্যাংকের অ্যাকাউন্টিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে, তার ধারণা কমই আছে। এসব ব্যবহারিক বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত। আবার পরীক্ষা হলের পরিবেশের অভিযোগ তো অনেক পুরোনো, অনেকটা নকলে ছড়াছড়ি। পরীক্ষা হলের সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের মধ্যে এক ধরনের উদাসিনতা লক্ষ্য করা যায়। তাই সিলেবাসটি যুগপোযুগী এবং ব্যবহারী হওয়া উচিত। বিশ্বের বিভন্ন দেশের ব্যাংকিং ডিপ্লোমার সিলেবাসগুলোকে পর্যালোচনা করে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য সিলেবাস প্রণয়ন জরুরি বলে আমি মনে করি। সেসঙ্গে পরীক্ষা হলের পরিবেশ নিয়ে যেন কোনো প্রশ্ন না ওঠে, সে ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখলে দেখা যায়, অনেক ব্যাংকার নিজেকে পরীক্ষার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছেন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবার অনেকে বলছেন, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাই ব্যাংকিং ডিপ্লোমার প্রয়োজন নেই। বিষয়টি যৌক্তিক নয় বলে মনে করি। ধরে নেই যারা আইবিএ থেকে এমবিএ পাস করেছেন, নিঃসন্দেহে এটি অত্যন্ত কঠিন ও উঁচুমানের ডিগ্রি। এ ধরনের ডিগ্রিতে শুধু ব্যাংকিং নয়, আরও অন্যান্য বিষয়েও উচ্চতর ধারণা দেয়। কিন্তু ব্যাংকিং ডিপ্লোমা সামগ্রিক শুধু তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ব্যাংকিংয়ের জন্য অপরিহার্য একথা অনস্বীকার্য। তাই ব্যাংকিং ডিপ্লোমাকে অন্যান্য ডিগ্রির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা উচিত হবে না। অরেকটি কথা মনে রাখতে হবে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সব দেশেই ব্যাংকারদের জন্য স্বীকৃত পরীক্ষা। অনেকে ব্যাংকিং ডিপ্লোমার বিরুদ্ধে নানা যুক্তি দেখিয়ে নিজেকে নিজে জিততে চেষ্ট করেন, আসলে দিন শেষে তিনি নিজেই নিজেকে হারিয়ে দেন। তাই এসব নেতিবাচক যুক্তি প্রদর্শনের চেয়ে মনোযোগ দিয়ে কিছুদিন পড়ালেখা করলে ডিপ্লোমা পাস অবশ্যই করা সম্ভব।

বর্তমান পদ্ধতিতে একবারে সব বিষয়ে পরীক্ষায় পাসের হার ১ শতাংশও হবে কি-না সন্দেহ আছে। যারা প্রথমবারের মতো পরীক্ষা দেবেন তারা আগামী জানুয়ারির মধ্যে সববিষয় কীভাবে পাস করা অনেকটাই অনিশ্চিত। তাই পরীক্ষা পাসের সময় আরও বাড়িয়ে দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি। একজন নতুন ব্যাংকার ব্যাংকে যোগদানের পর দুই পার্ট পাস করার জন্য কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ বছর সময় দেয়া উচিত। তাছাড়া, প্রতি বিষয়ে পরীক্ষার ফি ১ হাজার ৮০০ টাকা যা অনেক বেশি ধার্য করা হয়েছে। এ ফি অর্ধেকে কমিয়ে আনা উচিত। সেসঙ্গে আইবিবি কর্তৃক আয়োজিত ক্লাসগুলো আরও অর্থবহ করা এবং অধিক অনলাইন ক্লাস চালু রাখা উচিত। আমরা আশা করি ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষা নিয়ে বিতর্ক নয় বরং সংকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণমূলক এবং ব্যাংকিং পেশাদারিত্বের উন্নয়নে সহায়ক হোক।