জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ বিচিত্র রকম কাজ করে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপের পেছনে মূল উদ্দেশ্য থাকে অর্থ উপার্জন। বর্তমানে বিশ্বাস করা হয় যে, অর্থের মাধ্যমে ভালোভাবে বেঁচে থাকা যায়। তবে জীবনের মূল লক্ষ্য শুধু ভালোভাবে বেঁচে থাকা নয়। যাদের কাছে ভালোভাবে বেঁচে থাকাটাই একমাত্র ও মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় তারা আজও চারকোণা এক বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ এবং তারা কখনও মুক্তির স্বাদও পেতে চায় না। তবে এসব কিছুকে ছাপিয়ে যারা নিজ শেকড় অন্বেষণ করে, তাদের কাছে অর্থনৈতিক মুক্তির থেকে বড় বিষয় হলো মানসিক মুক্তি। বিভিন্ন রকম সুস্থ বিনোদনমাধ্যম, ভ্রমণ, খেলাধুলা, বইপড়া ইত্যাদি মানসিক মুক্তি দিতে সহায়তা রাখে।
প্রাত্যহিক জীবনে মানুষের কিছু সৌখিন অভ্যাস থাকেই যা ব্যক্তিকে মানসিক শান্তি দিয়ে থাকে। এদিক দিয়ে বিবেচনা করা হলে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ অভ্যাস হলো বই পড়া। পড়ার মাধ্যমেই আমাদের এই আধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে। একসময় মানব জাতি ছিল গুহাবাসী তাদের কোনো ভাষা ছিল না। তাদের মধ্যে কোনো সুশৃঙ্খল আচার কানুন, নিয়মনীতি ছিল না? পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধর্মের আবির্ভাব এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থেরও আবির্ভাব ঘটে। মানুষ এসব ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ার ফলেই জগত ও জীবন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানচর্চা শুরু করে এবং পরবর্তী সময়ে মানুষের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা দেখা যায়। কারণ জীবন ও জগতের চিন্তা মানুষের মাঝে এক ধরনের জীব-বাৎসল্য ও বিবেকবোধ জাগ্রত করে। ফলে মানবসভ্যতার পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, যেই জাতি যতো বেশি পড়ুয়া, সেই জাতি ততো বেশি বিবেকবোধ সম্পন্ন, মননশীল, রুচিশীল, অহিংস এবং সর্বোপরি সভ্যজাতি। বইয়ের প্রত্যকেটি অক্ষরে গ্রথিত রয়েছে মানবজাতির ইতিহাস হাজারো প্রেরণার মন্ত্র। বই পড়ার মাধ্যমেই আমরা আমাদের অতীত ইতিহাস, বিশ্ব ইতিহাস, কিংবদন্তি জানতে পারি। যা আমাদের ভবিষ্যৎ কাজ করতে প্রেষণা জোগায়।
প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই প্রতিহিংসা, হত্যা, ধর্ষণ, অর্থপাচার, দুর্নীতিসহ নানান রকম অমানবিক ক্রিয়াকলাপ দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের এই দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সমাজের শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেক মানুষই এসব ক্রিয়াকলাপে জড়িত থাকতে দেখা যায়। খেয়াল করলে চোখে পড়বে অশিক্ষিত সম্প্রদায় থেকে আমাদের সমাজে শিক্ষিত সম্প্রদায় বেশি অপরাধ করে থাকে বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকে।
কাজেই এখন প্রশ্ন থেকে যায় যে, শিক্ষিত সম্প্রদায় তো বই পড়ে তবে কেনো তারা ধর্ষণ, হত্যা, অর্থপাচার, ব্যাংক লুট, মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অপরাধ করে? এক্ষেত্রে বলাই বাহুল্য যে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের যে শিক্ষিত পড়ুয়া সমাজ গঠন হয়েছে তাদের বেশিরভাগেরই মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলে পরিক্ষায় প্রথম শ্রেণির সনদ প্রাপ্তি। যার ফলে আমাদের শিক্ষিত সমাজ বই পড়লেও বইয়ের মূল সারমর্মটা আয়ত্ত করতে পারছে না। বইয়ের বিদ্যা পরীক্ষার নম্বর পাওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে তা শিক্ষার্থীদের মননে প্রবেশ করে না। কাজেই বর্তমান শিক্ষার্থী সমাজ বই পড়ে সনদপ্রাপ্ত শিক্ষিত হলেও সুশিক্ষিত হতে পারছে না। ফলাফল সমাজে ধর্ষণ, অন্যায়-অত্যাচার, মাদকে আসক্তসহ নানান রকম অপরাধে যুক্ত হচ্ছে।
সর্বোপরি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এরূপ নানা সংকট হতে মুক্ত হতে হলে বই পড়া যেমন জরুরি তেমনি বইয়ের অভ্যন্তরীণ আদর্শ নীতি মননে ধারণ করতে হবে। কারণ আলো যেমন চারপাশের অন্ধকার দূর করে দেয়, তেমনি বইও একজন অপরাধীর মনের অন্ধকার দূর করে তার মধ্যে বিবেকবোধ জাগ্রত করে বিবেকবান করে তুলে। অন্যায় অপরাধে জর্জরিত এই সমাজকে সুন্দর সুশীল সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বইপড়ুয়া সুশিক্ষিত বিবেকবান মানুষের খুবই প্রয়োজন। ভাষাশহীদের ওপর সম্মান রেখে ফেব্রুয়ারির এ বইমেলার মাসে আমাদের সবার মধ্যে এ প্রত্যয় তৈরি হোক-
‘আমরা শিক্ষিত নয় সুশিক্ষিত হবো,
সমাজে কল্যাণ বয়ে আনব।’