ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

একুশের চেতনা হোক মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার চেতনা

ড. মো. শওকত হোসেন, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
একুশের চেতনা হোক মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার চেতনা

আমরা যাকে জ্ঞান বলি তা মূলত এক ধরনের বোধ বা অনুধাবন। জ্ঞানের যথার্থতা নিয়ে অনেক দার্শনিক প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু যখন যে ধারণাকেই আমরা জ্ঞান বলছি, সেটিকে আমরা কমবেশি মেনে নিচ্ছি, বিশ্বাস করছি এবং তার ভিত্তিতেই আমাদের মধ্যে গড়ে উঠছে কিছু বোধ বা মানসিক অনুধাবন ও বোঝাপড়া। সেই বোঝাপড়া কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে হোক, বাস্তব প্রমাণ-পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে হোক, অথবা নিতান্তই কোনো অনুকরণ-অনুসরণের মাধ্যমেও হতে পারে। আমরা কোনো কোনো অনুধাবন বা জ্ঞানকে অধিক পরিমাণে গ্রহণ করি, আবার কোনো কোনো অনুধাবন বা বোধের ধারণাকে আমরা অপেক্ষাকৃত কম মানুষ গ্রহণ করি। এভাবেই জ্ঞান আমাদের গ্রহণ যোগ্যতার ভিত্তিতে অনেক ক্ষেত্রে আপেক্ষিক অবস্থায় নিপতিত হয়। সে যাই হোক, তথাপিও এই বিশ্ব-সভ্যতা মানুষের বোধ বা অনুধাবনের ভিত্তিতেই এগিয়ে চলছে। অর্থাৎ জ্ঞানের মাধ্যমেই বিকশিত হচ্ছে মানব সভ্যতা।

মানব সভ্যতার অগ্রগতির কোনো ভৌগোলিক বা জাতিগত সমতার চিহ্ন নেই। কোনো কোনো জাতি অতি প্রাচীনকালেই জ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছে, আবার কোনো কোনো জনপদে জ্ঞানের আলো অপেক্ষাকৃত আধুনিককালেও অত্যন্ত ক্ষীণ অবস্থায় উদ্ভাসিত হয়েছে। এসবের কারণ কী? কারণ বাহুবিধ। এক্ষেত্রে কোনো সরল সমীকরণ বা চটজলদি উত্তর প্রদান করা সমীচীন নয়, সম্ভবও নয়। তবে এসব জটিল আলোচনা স্থগিত রেখে একেবারেই কাণ্ডজ্ঞানের ভিত্তিতে এ জটিল জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়ের একটি দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক।

মানুষের যেকোনো বোধ বা অনুধাবনই চিন্তন। চিন্তনের মধ্য দিয়েই বোধ তথা জ্ঞানের প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়। অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি যা কিছুই আমরা ব্যবহার করি চিন্তা দিয়েই তাকে আমরা অনুধাবন করে জ্ঞানের মর্যাদায় আসন দিই। তাহলে বোঝা যায় যে, জ্ঞান হলো এক ধরনের চিন্তন। এর সঙ্গে একটি কথা যুক্ত করতে চাই, তাহলো যেকোনো চিন্তনেরই একটি ভাষিক রূপ বা ভাষাগত অবয়ব থাকে। সোজা কথায়, আমরা চিন্তা করতে হলে কোনো না কোনো ভাষার মাধ্যমেই করতে হয়। আর জ্ঞান যেহেতু একধরনের চিন্তন, তাই জ্ঞানের জন্যও ভাষার প্রয়োজন। ভাষার সঙ্গে চিন্তা ও যুক্তির এই সম্পর্ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক বিবেচনার বিষয়। গ্রিক ভাষায় যাকে লোগস (Logos) বলা হয় তার অর্থও একাধারে চিন্তা, ভাষা ও যুক্তি।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা যদি জ্ঞানচর্চা করতে যাই বা চিন্তা ও যুক্তিকে অনুশীলন করতে যাই, তাহলে কোন ভাষায় করব? ভাষা ছাড়া যেহেতু জ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, তাই ভাষার নির্বাচন বা ভাষা-মাধ্যম এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে। মানুষের সহজ ও স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, সে সর্বদা স্বকীয় উপকরণই ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যার যা আছে তা নিয়েই সে কাজ করতে ভালো বোধ করবে- এটাই স্বাভাবিক। তাই চিন্তা, বোধ, অনুধাবন প্রক্রিয়া তথা জ্ঞানচর্চার খুবই স্বাভাবিক মাধ্যম হলো মাতৃভাষা। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তার মতে, ‘শিক্ষায় মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের মতো’। মাতৃদুগ্ধ যেমন সন্তানের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে উত্তম উপকরণ, তেমনি মাতৃভাষাই হলো যে কোনো মানুষের জন্য সহজ ও স্বাভাবিক জ্ঞানচর্চার মাধ্যম। কোরআনে উল্লেখ আছে যে, ‘সব নবী-রাসুলকেই তাদের মাতৃভাষায়ই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে, যাতে করে তারা বিষয়গুলো সহজে অনুধাবন করতে পারেন।’ নিজে ভালোভাবে অনুধাবন করতে না পারলে অন্যকেও সেই বিষয় বোধগম্য করানো সহজতর হয় না।

আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের একটি বিরাট অংশ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার মাধ্যম থেকে বঞ্চিত। প্রাক-প্রাথমিক অবস্থা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষা-পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ভিনদেশি ভাষা প্রধানত ইংরেজি ভাষার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইংরেজি মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন ইত্যাদি শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলন করে আমাদের কোমলমতি শিশু-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশকে ইংরেজি মাধ্যমে চিন্তা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। কিছু মাদরাসায়, বিশেষ করে, কাওমী মাদরাসা বলে আজকের দিনে যেসব মাদরাসা পরিচপালিত হচ্ছে, সেখানে আরবি ভাষায় চিন্তা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমাদের সন্তানদের মধ্যে যারা উচ্চশিক্ষায় বিশেষায়িত কিছু বিদ্যার পঠন-পাঠন করছে, যেমন চিকিৎসাবিদ্যা, প্রকৌশল বিদ্যা, নৌ-বিদ্যা, কৃষিবিদ্যা, বুনন-প্রকৌশল বিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষার শাসন থেকে তারা মুক্ত হতে পারছে না।

বাংলা ভাষায় এসব বিদ্যাচর্চা করাকে কেউ কেউ অসম্ভব মনে করেন। তাদের যুক্তি হলো ওইসব বিশেষ বিদ্যার জ্ঞান দেশীয় উৎস থেকে আসেনি, তাই এসবের চর্চা করাও তাই মাতৃভাষায় তথা বাংলা ভাষায় সম্ভব নয়। এই অজুহাতের বিপক্ষে একটি প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক, তা হলো : ওইসব বিষয়ের জ্ঞান কি শুধু বিশেষ একটি ভাষায়ই উৎপত্তি হয়েছে? গ্রিক, আরবি, জার্মান, ফরাসি, চীন ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর চর্চিত জ্ঞান আমরা ইংরেজি ভাষায় যদি চর্চা করতে পারি, তাহলে বাংলা ভাষায় কেন এর পঠন-পাঠন করা সম্ভব হচ্ছে না? ইংরেজি ভাষা বিভিন্ন ভাষার চিন্তা-সম্পদকে তাদের নিজেদের মাতৃভাষায় ভাষান্তর করে নিজ জাতির সন্তানদের সেই জ্ঞানকে মাতৃভাষায় চর্চা করতে সুযোগ দিচ্ছে। এতে করে তাদের নিজেদের মনন বিকাশে অগ্রগতি আসছে। কিন্তু আমরা আমাদের প্রাণের ভাষায় জ্ঞানচর্চা করতে পারছি না। জ্ঞানের ভাষা আমাদের জন্য আলাদা। আর সে কারণেই আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেয়া বিদ্যা বা গুরুদের দেয়া বিদেশি ভাষার বিদ্যা আমাদের চিন্তাচর্চা, বোধচর্চা তথা জ্ঞানচর্চায় সঠিকভাবে আত্মস্থ হচ্ছে না। আমাদের শিক্ষার্থীরা স্বকীয়ভাবে নিজের মতো করে চিন্তা করতে পারছে না। তাই জ্ঞানের বিকাশ এমনকি অর্জিত তথ্যের সঠিক অনুধাবন ও প্রয়োগ কাম্য মাত্রায় দেখা যাচ্ছে না।

বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষার পরে এবার যদি আমরা এদেশের সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকেও লক্ষ্য করি, সেখানেও অনেকটা একই রূপ আমরা দেখতে পাই। এখানেও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিদেশি ভাষা বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য বিদ্যমান। আমাদের অনেক অধ্যাপকই বিদেশ থেকে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে এদেশে এসে তাদের অর্জিত বিদ্যাকে মাতৃভাষায় অর্থাৎ বাংলায় শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছেন, অথবা কুণ্ঠাবোধ করছেন। কেউ কেউ এমন ভাব দেখাচ্ছেন যে, বাংলায় এগুলো প্রকাশ করা যথার্থ নয়, অথবা সম্ভব নয়। এ সম্পর্কে একটি কথা না বললেই নয়, তাহলো কেউ যদি সত্যি সত্যিই কোনো বিদ্যা বুঝে থাকেন, তাহলে তিনি সেই বিদ্যাকে তার মাতৃভাষায় যথার্থভাবেই উপস্থাপনের যোগ্যতা থাকার কথা। যদি না থাকে, তবে তার বিদ্যায় ত্রুটি আছে বলে মনে করা হয়তো অসঙ্গত হবে না। বিদেশি ভাষায় চর্চিত জ্ঞান অর্জন করতে হলে সংশ্লিষ্ট ভাষায় দক্ষতা প্রয়োজন হয়, এটা স্বীকার করেও বলতে হয় যে, সেই জ্ঞান যদি আত্মস্থ হয়ে থাকে, তবে নিজের মাতৃভাষায় অবশ্যই তা প্রকাশযোগ্য হবে। কোনো পণ্ডিত যদি তা না করে ওই বিদেশি ভাষায়ই তা প্রকাশ করতে চেষ্টা করেন তা অনেকটা তোতা পাখির মতো কিছু শেখানো বুলি আওড়ানোর মতো হবে। আর ওই বুলি বা বক্তব্যের প্রতি স্বদেশীয় শিক্ষার্থীদের চিন্তা বা বোধ একাত্ম হতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। আমাদের উচ্চ শিক্ষিত পণ্ডিতরা অনেকেই বাংলায় পড়াতে যেমন অক্ষমতা প্রকাশ করেন, লেখার ক্ষেত্রেও তেমনটি করেন। বাংলা যেন জ্ঞানের ভাষাই নয়, এ ভাষায় যেন জ্ঞান প্রকাশ করা যায় না- এমন অক্ষমতা অথবা ভণিতায় বন্ধ হয়ে উঠছে আমাদের গোটা বিদ্যাচর্চা।

আমরা ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মাতৃভাষা চর্চার বুলি আওড়াই। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা থেকে মাতৃভাষাকে যেভাবে কোণঠাসা করে ফেলা হচ্ছে- তার প্রতি যথার্থ গুরুত্ব দেই না। এমনকি, এই দায় এড়ানোর জন্যই হয়তো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করতে আমরা বেশ সম্মানিত বোধ করি। এ দিনটিকে আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদা দেয়া অবশ্যই গর্বের। তবে জাতীয় স্বার্থের প্রতি পর্যাপ্ত নজর দিয়েই আমাদের সর্বজাতির কল্যাণ চিন্তা করতে হবে। একুশের চেতনাকে তাই হতে হবে মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার চেতনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত