শিক্ষাব্যবস্থা ও তার প্রভাব আদি থেকে অন্ত

এ, টি, এম আবু আসাদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও সমাজচিন্তক, [email protected]

প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানবজাতির প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক স্বয়ং মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানা তায়ালা। বনু আদমের পিঠ থেকে তাদের সন্তানদের বের করার পর আল্লাহ তাদের একত্রিত করে নারী-পুরুষে ভাগ করলেন, তাদের কথা বলার ক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ সুবহানা তায়ালা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আলাস্তু বি রব্বিকুম’, আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তখন সব রুহু একত্রে বলেন, হ্যাঁ, আপনি আমাদের প্রতিপালক! এরপর আল্লাহ বললেন, তোমরা জেনে রাখ, আমি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। আমার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। সত্বর আমি তোমাদের কাছে আমার রাসুলদের পাঠাব, আমার কিতাবগুলো নাজিল করব। তারা তোমাদের আমার সঙ্গে কৃতপ্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। আমার আয়াতগুলো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করবেন, তোমরা নবীদের আনুগত্য করো, নাফরমানি করো না। এভাবে মহান স্রষ্টা আমাদের শিক্ষা দিলেন, তিনিই আমাদের প্রভু ও সবকর্মের স্রষ্টা। তিনি মাটি থেকে নিজ দু’হাতে আদি পিতা আদম (আ.)-কে দৈহিক অবয়ব প্রদান করেন এবং তাতে রুহ ফুঁকে দেন। আদমকে দুনিয়ার সব কিছুর নাম শিক্ষা দিলেন। সবকিছুর নাম বলতে পৃথিবীর সূচনা থেকে লয় পর্যন্ত ছোটবড় সবকিছুর ইলম ও তা ব্যবহারের যোগ্যতা তাকে দেয়া হলো। আদমের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তাকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন। অতঃপর মহান স্রষ্টা ফেরেশতাদের ওইসব বস্তুর নাম জিজ্ঞাসা করেন, তারা উত্তর দিতে না পারায় আদমকে একই প্রশ্ন করলে তিনি স্বয়ং আল্লাহ সুবহানা তায়ালা শিখিয়ে দেয়া জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রশ্নের জবাব দেন। এরপর আদম (আ.) থেকে আমাদের প্রিয় শেষ নবী (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসুল মানব জাতির শিক্ষক এবং তাদের সিলেবাস হলো, সে সময়ে প্রেরিত আসমানি গ্রন্থগুলো। এভাবেই চলতে থাকে সৃষ্টির শুরু থেকে। দুনিয়াবি প্রয়োজনীয়তার নিরিখে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি হয়, তবে সব শিক্ষার কেন্দ্র ছিল ধর্ম, শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল একটি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা। অর্থাৎ ইসলামি যুগের শুরুতে, মধ্যযুগে এবং অতি সাম্প্রতিককালেও ঔপনিবেশিক যুগের আগ পর্যন্ত মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ছিল কোরআন, হাদিস ও রাসুল (সা.)-এর সিরাতের বা ফিকাহর ওপর। সাবেক সচিব, ইসলামি স্কলার মরহুম শাহ আবদুল হান্নান তার এক লেখনীতে বলেছেন, বৌদ্ধদের ইতিহাসে দেখা যায়, একই সত্যের পুনরাবৃত্তি। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষা প্রদান করা হতো, তারও মধ্যে দেখা যায় শিক্ষাব্যবস্থার মূলে ছিল চরিত্র গঠন বা বৌদ্ধ ধর্মের নৈতিকতা। এর সঙ্গে ভারতে প্রচলিত অন্যান্য বিদ্যাকেও শামিল করে নিয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মের প্রামথিক যুগের দিকে তাকালে দেখা যায় বিদ্যা শিক্ষার মূল ছিল বেদ, বেদ মানেই বিদ্যা।

এর সঙ্গে যুদ্ধবিদ্যা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও অন্যান্য শাস্ত্র যোগ করা হয়েছিল প্রয়োজনকে সামনে রেখে। খ্রিষ্টানদের অতীতে গেলে দেখা যায়, তাদের শিক্ষাও ছিল গির্জাকে কেন্দ্র করে। প্রতিটি গির্জায় একটি কলেজ বা শিক্ষালয় ছিল; সেখানে যা পড়ানো হতো তার মূলভিত্তি ছিল বাইবেল। এ থেকে একথাই প্রমাণিত হয়, ১৮০০ শতাব্দীর শেষভাগে যখন মুক্তবুদ্ধির (এনলাইটেনমেন্ট) আন্দোলন শুরু এবং যার সন্তান হিসেবে সেকুলারিজমের উদ্ভব হয়- তার আগ পর্যন্ত মানবজাতির শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ধর্মভিত্তিক। তার ফল এই দাঁড়িয়েছিল যে, বিভিন্ন বিদ্যার ক্ষেত্রে জানার পরিমাণ কমবেশি থাকলেও মানুষ নৈতিক দৃষ্টিতে ভালো ছিল, যে ধর্মেরই হোক না কেন- মানুষ ছিল দানশীল, মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন। আজকের মতো অমানুষ ছিল না। আঠারো শতকের শেষে মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের জীবন দর্শনে পরিবর্তন সূচিত হয়। যে কারণেই হোক এ আন্দোলনের বেশির ভাগ নেতারাই ছিলেন নাস্তিক বা ছদ্মবেশি নাস্তিক। মানব ইতিহাসে এই প্রথম তারা এ দর্শন নিয়ে এলেন যে, রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কাজ থেকে ধর্মকে বিদায় দিতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক ব্যাপারে ধর্মের কোনো ভূমিকা থাকবে না। ধর্ম থাকতে হলে কারও অন্তরে থাকবে, যদি সে রাখতে চায়। এ আন্দোলনের মূল বক্তব্য ছিল ওহি নয়, যুক্তিই হবে জীবনের ভিত্তি। যে কারণেই হোক এ আন্দোলন ইউরোপের তৎকালীন নেতৃত্বকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়; এটি মোটামুটি গৃহীত হয়ে যায় এবং ক্যাথলিক ব প্রটেস্টান্ট চার্চ এটাকে বাধা দিয়ে কুলাতে পারেনি। এর ফল হয় ভয়াবহ- প্রথম কুফল হলো, শিক্ষা থেকে ধর্মকে আলাদা করা হলো। এভাবে যে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠে, তার প্রভাবে মানুষ স্বার্থপর, ভোগবাদী, নীতিহীন হয়ে উঠে। এ শিক্ষা থেকে যে জেনারেল, পলিটিশিয়ান, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ তৈরি হলো, তাদের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হলো যে, জনসমাজের জন্য ধর্মের প্রয়োজন নেই, চাই সেটা পার্লামেন্ট, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচারনীতি, যা-ই হোক না কেন। এ ব্যক্তিগত ধারণা থেকে সামাজিক আচরণ তৈরি হয়। অর্থনীতির ক্ষেত্রে সোশ্যাল ডারউইনিজম প্রবেশ করে, যার মূলমন্ত্র হলো; সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট অর্থাৎ যোগ্যরাই টিকে থাকবে। যারা যোগ্য নয়, তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। এখানে দয়ামায়ার কোনো স্থান নেই, যা ছিল খ্রিষ্টান ধর্মবিরোধী, ইসলাম ধর্মবিরোধী। কারণ খ্রিষ্টান ধর্মে রয়েছে প্রতিবেশীর ভালোবাসার কথা, রয়েছে চ্যারিটির কথা আর ইসলামে রয়েছে ইনফাক ফি সাবিলিল¬াহ বা আল¬াহর পথে ব্যয়। ফরজ জাকাত ছাড়াও আত্মীয়ের হক, প্রতিবেশীর হক, সার্বিকভাবে বান্দার হক আদায়ে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের ফলে যে পুঁজিবাদ চালু হয় প্রায় ৫০০ বছর আগে, তাও বাস্তবে এত নীতিহীন ছিল না খ্রিষ্টান ধর্মের নীতিবোধের কারণে। এক সময় পুঁজিবাদ সেকুলারিজমের সঙ্গে মিলিত হয়ে শ্রমিক শোষণ শুরু হয়। শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে, যার সৃষ্টি আজকের মে দিবস। প্রতিযোগিতামূলক মার্কেট চালু হয়, ফলে অর্থনীতিতে অমানবিকতা, নীতিহীনতা তৈরি হয়, তাদের ভাষায়, অর্থনীতি একটি অবিমিশ্র বিজ্ঞান এতে কোনো নীতিবোধ থাকবে না, প্রকৃতির মতো স্বাভাবিক নিয়মে চলবে। এটি হয়েছে অতি লোভ ও অতিলোভের আকাঙ্ক্ষা থেকে। রিবা (সুদ) এটাকে সাহায্য করেছে। সুদ না থাকলে এমনটি কখনোই হতো না। মুক্তবুদ্ধি ও সেকুলার শিক্ষার আরেকটি ফল হলো- তারা মুখে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ভ্রাতৃত্বের কথা বলল অথচ সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানরাই দুনিয়া বিজয়ে বের হয়ে গেল। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানী, স্পেন, হল্যান্ড প্রায় সারা দুনিয়া দখল করে নিল। আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আফ্রিকার প্রায় ১০০ শতাংশ এবং এশিয়ার প্রায় ৭০ শতাংশ দখল হলো। এটা করতে গিয়ে তারা পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হলো এবং ওইসব দেশের স্থানীয়দের সঙ্গে পর্যন্ত যুদ্ধ করল। তারা লুট করল বিশ্বকে, ব্রিটিশরা আমাদের বাংলাকে লুট করল। তার মানে হচ্ছে সেক্যুলারিজম শিক্ষাব্যবস্থায় তৈরি হওয়া লোকরা মানুষকে চরমভাবে শোষণ করল। এরপর তারা বলল, আমরা তাদের সিভিলাইজড করেছি। যারা নিজেরা আনসিভিলাইজড তারা অন্যকে কীভাবে সিভিলাইজড করবে? তারা লড়াই করতে করতে দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধও করল; কিন্তু বিশ্বে শান্তি আনতে পারল না। সেক্যুলার শিক্ষার আরেকটি ফল; পরিবার প্রথাকে ধ্বংস করে ফেলা। তাদের মতে পরিবারের গুরুত্ব নেই, এটা নারীকে দাবিয়ে রাখার একটি প্রতিষ্ঠান তাদের দাস বানানোর জন্য। তাদের ওকালতি হলো পশুর মতো জীবনযাপন করা।

আর তাই আজকে অশ্লীলতা পাশ্চাত্যকে গ্রাস করে ফেলেছে, তার ছোঁয়া এখন আমাদের দেশেও। এ উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী, তার এক লেখনিতে বলেছেন, ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ভারতবর্ষে মুসলমানদের ৭০০ বছরের শাষণামল অবধি এখানের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ধর্মভিত্তিক। অর্থাৎ ইসলামের সূচনা থেকে ব্রিটিশ পিরিয়ডের আগ পর্যন্ত বিদ্যালয়গুলোতে একসঙ্গে দ্বীনি ও জাগতিক উভয় ধারার শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ছিল। ইন্ডিয়ান শিক্ষা কমিশন চেয়ারম্যান (১৮৮২) উইলিয়াম হান্টারের বর্ণনা অনুযায়ী ইংরেজ আসার আগে উপমহাদেশে ৮০,০০০ মাদ্রাসা ছিল। তখন কোনো মুসলমানের অশিক্ষিত থাকা অকল্পনীয় ছিল। ১৭৫৭ সালে বিট্রিশরা নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে বাংলার রাজত্ব দখল করার পর মসজিদ মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দ লাখারাজ ও ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করে নিলে মুসলমানরা অসহায় হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা হারানোর কঠিন দিনগুলোতে কলকাতার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ইংরেজ গভর্নরের অনুমতি নিয়ে ১৭৮১ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশদের শর্ত ছিল প্রিন্সিপাল হতে হবে ইংরেজ। কলকাতা আলিয়া প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০০ বছর পর ১৮৬৬ সালে দেওবন্ধ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর দিল্লির ক্ষমতাহারা মুসলমানদের ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন নেমে আসে, তার মোকাবিলায় স্বশস্ত্র আন্দোলনের পরিবর্তে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে দেওবন্ধ মাদ্রাসা। আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার দর্শন ছিল সরকারি পৃষ্ঠোপোষকতা নিয়ে দ্বীনি শিক্ষার বিস্তার সাধন আর দেওবন্ধ নামক কওমী মাদ্রাসার অস্তিত্বের দর্শন ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে দ্বীনি শিক্ষা ও চেতনার পরিচর্যা। আগেই বলেছি সেক্যুলার শিক্ষার সন্তান ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ দখল করে। পর্যায়ক্রমে তারা এখানে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করে। অষ্ঠাদশ শতাব্দী এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইউরোপিয়ান মিশনারিজ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৩৫ সালে উচ্চ শিক্ষায় ইংরেজি মাধ্যম চালু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ম্যাট্রিক ও উচ্চশিক্ষায় ইংরেজিকে আবশ্যিক সাবজেক্ট করা হয়। ১৮৩২-১৮৫৫ এর মধ্যে বাংলাদেশে ১২টি জেলা স্কুল ও ৩টি কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে এদেশে আলিয়া মাদ্রাসা, কওমী মাদ্রাসা ও স্কুল তিনটি ধারার শিক্ষাব্যবস্থা ব্রিটিশ আমলেই চালু হয়। হজরত মাওলানা মুফতি তকী উসমানী, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তার বক্তব্যে বলেন, ‘ভারত বর্ষে যে তিন ধারার শিক্ষা প্রচলিত ছিল তা স্বাভাবিক কোনো ধারা ছিল না; বরং তা ছিল ব্রিটিশ প্রবর্তিত ধারার প্রতিফল বা তাদের চক্রান্ত রুখতে বিকল্প মাধ্যম অবলম্বন মাত্র। তিনি আর বলেন, প্রতিটি মোমিনের জন্য আলেম হওয়া ফরজে আইন নয়; বরং ফরজে কিফায়া, শরীয়তের বক্তব্য এমনই। অর্থাৎ কোনো এলাকায় বা রাষ্ট্রে যদি প্রয়োজন অনুপাতে আলেম হয়ে যায়, তাহলে অন্যদের সে দায়িত্ব রহিত হয়ে যায়।

কিন্তু দ্বীনের মৌলিক ইলম হাছিল করা ফরজে আইন, প্রত্যেক মুসলমানের ওপর তা ফরজ। ব্রিটিশরা আসার আগে বিদ্যালয়গুলোতে সবার জন্য ফরজে আইন ইলমের ব্যবস্থা ছিল, এতে কোনো বিভাজন ছিল না। মুসলমান মাত্রেই সে ফরজে আইন ইলম হাছিল করত। আর যে দ্বীনি ইলমে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে চাইত, তার জন্য থাকত ভিন্ন এন্তেজাম। আর যে জাগতিক বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চাইত, তার জন্য থাকত পৃথক ব্যবস্থা’। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। আগে জ্ঞান আহরণ ও বিদ্যা অর্জনের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি এরকম ছিল, অর্থাৎ জ্ঞান একটি মহৎ গুণ। এর উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণে অংশগ্রহণ করা। এর মাধ্যমে যদি কিছু জীবিকাও হয়ে যায়, তবে তা হত গৌণ পর্যায়ের। মূখ্য ছিল মূলত মানবতার সেবা। কিন্তু আজ দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে গেছে পুরোই উল্টো। অর্থ উপার্জন জ্ঞান-বিদ্যার মূল উদ্দেশ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। এখন দৃষ্টিভঙ্গি হলো, এ পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করো, যাতে মানুষের পকেট থেকে বেশি থেকে বেশি পয়সা হাতিয়ে নেয়া যায়। তোমার জ্ঞান ও বিদ্যা তখনই ফলপ্রসূ ও উপকারী বলে গণ্য হবে, যখন তুমি অন্যদের চেয়ে বেশি পয়সা আয় করতে পারবে। ফলশ্রুতিতে যা হয়েছে, সবাই অর্থের পেছনে ছুটছে। না দেশের স্বার্থের প্রতি ভ্রুক্ষেপ, না সমাজ ও জাতির কল্যাণ চিন্তা। আর না সৃষ্টির সেবায় নিয়োজিত হওয়ার কোনো ফিকির। রাত-দিন একটাই চিন্তা, কীভাবে টাকা কমানো যায়, হারাম-হালালের তোয়াক্কা নেই! নীতি-নৈতিকতার খবর নেই! স্বাধীনতার পর ভারত বর্ষের শিক্ষাব্যবস্থাটাই আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাই। অর্থাৎ স্কুল, আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসা সিস্টেম। সেকেণ্ডারিতে আছে, সাধারণ, টেকনিক্যাল/ভকেশনাল ও আলিয়া মাদ্রাসা। এরপর ব্রিটিশ কারিকুলাম এর ইংলিশ মিডিয়াম এবং সর্বশেষে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এর শিক্ষাকে ইংবেজী ভার্সনে প্রদানের জন্য কিছু ইংলিশ ভার্সন স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের অজুহাতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাটাছেঁড়া কম হয়নি! স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে কুদরতী খুদা শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, ২০০৩ সালে মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষা কমিশন এর রিপোর্ট বাস্তবায়ন এর চেষ্টা করা হয়েছে এবং সবশেষে ২০০৯ সালে গঠিত শিক্ষা কমিশন এর রিপোর্ট বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। বর্তমানে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে যেসব ভুলত্রুটি হয়েছে, তা সংশোধন করা হচ্ছে বলে শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বলেছেন। এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ বিবেচনায় এনে, সর্বসাধারণের মতামত নিয়ে যেন ভুলত্রুটি সংশোধন করা হয়, যাতে সংবিধানের মতো পাঠ্যপুস্তককে বারবার রদবদল বা কাটাছেঁড়া করতে না হয়। আমাদের সময় স্কুলে ১০০ নম্বরের ইসলাম শিক্ষা ছিল, আমরা ধর্মের মৌলিক কিছু বিষয় সেখান থেকেই শিখেছি। বর্তমানে ১০০ নম্বরের ধর্মশিক্ষা বাদ দেয়া হয়েছে। আমি শিক্ষাবিদ নই, তবে শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে দেশ-বিদেশের একাধিক শিক্ষাবিদ বা স্কলারের লেখনি পড়ে জেনেছি যে, নৈতিক শিক্ষার জন্য ধর্ম ছাড়া আর কোনো ভিত্তি নেই। আর তাই স্কুল পর্যায়ে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হলে ইসলাম ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় ঘটিয়ে করতে হবে যেখানে ১০০-২০০ নম্বরের ফরজে আইন শেখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এটা করতে হবে আমাদের সামাজিক অবক্ষয় রোধের জন্য, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থাও রাখতে হবে। আমাদের আলিয়া ব্যবস্থায় যদি ভালো আলেম তৈরি না হয়, তবে এ ব্যবস্থাকে স্কুল সিস্টেমের সঙ্গে একীভভূত করা যায় কি-না ভাবা দরকার। উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ব বিখ্যাত জামেয়া কারাউয়ীন, মরক্বো, জামেয়া যাইতুনিয়া, তিউনিসিয়া, জামেয়া আল-আযহার এর প্রাথমিক ব্যবস্থা ও মালয়েশিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটির মতো শিক্ষা প্রোগ্রাম সাজানোর মাধ্যমে ইসলাম ও আধুনিক শিক্ষার মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে এ শিক্ষা প্রোগামকে আমাদের মতো করে সাজাতে হবে। এরুপ ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে চালু না করা পর্যন্ত প্রচলিত কওমি শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা দূরিকরণ পুর্বক এ শিক্ষাকে ধারণ ও সংরক্ষণ করা যায় এবং দেশের অন্তত ১-২ শতাংশ ছাত্রছাত্রীকে বিশেষজ্ঞ আলেম/ইসলামি স্কলার বানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মুসলিম উম্মাহ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কল্যাণার্থে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাই।