সর্বস্তরে বাংলা ভাষাই ছিল ভাষাসৈনিকদের স্বপ্ন

মহিউদ্দিন আল আমান শাহেদ, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শওকত আলীর সন্তান

প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ভাষাসৈনিকদের এ স্লোগানটিই ছিল তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর গাত্রদাহের অন্যতম কারণ। সেই সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিটি মিছিল, মিটিং, সভা-সমাবেশ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে কেঁপে উঠত। আমার বাবার মুখে শুনেছি এ স্লোগানের নাকি একটি ঐশ্বরিক শক্তি ছিল। স্লোগান দেয়ার সময় নাকি এক ধরনের অসীম সাহস এসে ভর করত শরীরে এবং মৃত্যুভয় দূর হয়ে যেত। যার ফলে বন্দুকের নলের সামনেও ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ হুংকার দিতে বাঙালিরা কখনও পিছপা হয়নি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ধীরে ধীরে গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানের আনাচে-কানাচে সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক বছরের মাথায় আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে ভাষাসংগ্রামীদের মিছিলের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। এছাড়া বহু নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষের ওপর চালানো হয়েছিল, নির্যাতনের স্টিমরোলার। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল, দীর্ঘ পথ। এ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবশেষে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে এবং বিশ্ব দরবারে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করে। নাম জানা না জানা অনেক নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষ ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। যাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহসিকতায় সেদিন ভাষা আন্দোলন সফলতা লাভ করেছিল তাদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- শেখ মুজিবুর রহমান (পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা), শামসুল হক, শওকত আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, কামরুদ্দিন আহমেদ, খালেক নেওয়াজ খান, এমএ ওয়াদুদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ।

কষ্টের ব্যাপার হলো, এত ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করল, সেই বাংলা ভাষা যেভাবে গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই কষ্টার্জিত এই ভাষা তার মর্যাদা হারাতে বসেছে। বিদেশি ভাষা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি দিন দিন আমাদের সমাজে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। যেটা বাঙালি জাতির জন্য অপমানজনক। বিদেশি ভাষার আগ্রাসনে আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা আজ লাঞ্ছিত-বঞ্চিত। তবে, ইংরেজি বা অন্য ভাষার প্রতি আমাদের ঘৃণা নেই। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন সমৃদ্ধ ভাষা বিশেষ করে ইংরেজি ভাষাকে অবহেলা করার কথাও বলছি না। শুধু বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের উন্নাসিকতা দূর করতে হবে।

মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করতে প্রথম প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। ভাষাশহীদরা যে স্বপ্ন দেখেছিল, সেগুলো বাস্তবায়ন এবং তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আমরা অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছি। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ভাষা আন্দোলন আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েছে। একটি অসাম্প্রদায়িক গতিশীল সমাজ নির্মাণের মাধ্যমে সংগ্রামী চেতনা, স্বৈরাচার বিরোধিতা, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় এনে দিয়েছে। আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের মাধ্যমেই ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের প্রথম সোপান।

১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর পর থেকে বিশ্বে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এটির উদ্দেশ্য শুধু বাংলা ভাষা নয়- সারা বিশ্বের প্রতিটি জাতি, উপজাতি, নৃগোষ্ঠীর বিপন্ন ও বিলুপ্ত প্রায় প্রতিটি মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে বসানো। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর কথা আমাদের মনে হয়। পরবর্তীতে এ বিষয়ে খুব একটা আলাপ-আলোচনা হয় না। বিষয়টা একদম ঝিমিয়ে পড়ে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারটি শুধু সরকারের একার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সবাইকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক। বিভিন্ন সময় তিনি তার বক্তব্যে এ ব্যাপারটাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা বিশ্বের সব মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা এবং বিকাশের লক্ষ্যে গবেষণার কথা চিন্তা করে ঢাকাতে প্রতিষ্ঠা করেছেন, বিশ্ব ভাষার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট’। এ জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের গ্রামীণ ও লোকজ ঐতিহ্য চর্চার জন্য আরও প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং সেগুলো শক্তিশালী করতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞান ও অন্যান্য ভাষার পুস্তকাদি বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে বাংলাচর্চার জন্য অনুবাদের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা অত্যাবশ্যকীয় এর জন্য বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, আইন ইত্যাদি বিষয়ে চর্চা করার ব্যবস্থা নিতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও একজন ভাষা সৈনিক ছিলেন। মৃত্যু-পূর্ব পর্যন্ত তিনি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন।

কাজেই কাউকে দোষারোপ না করে আসুন আমরা সবাই যার যার অবস্থান থেকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ব্যাপারে কাজ করি এবং বাংলা ভাষার সমন্বয়ে সুন্দর একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলি।