আপনাদের ভাবনা

ভাষা ও সাহিত্য

আলী আহসান

প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মনের অব্যক্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-কষ্ট প্রকাশ করার মাধ্যমে সাহিত্য সৃষ্টি হয়। ভাষার সুনিপুণ ব্যবহারের ফলেই আমাদের হৃদয় কখনও হাসে, কখনও কাঁদে, কখনও বা আবার হাসি-কান্নার মিশ্রণে মনের মধ্যে এক গুমট ভাব সৃষ্টি করে। আবেগের সঙ্গে ভাষার এক শক্তিশালী সংযোগ রয়েছে।

পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৭ হাজার ১১১টি ভাষায় আজ কথা বলা হয়। ভাষা রক্ষার্থে অনেক জাতিই সচেতন থাকলেও পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বাঙালি জাতিই ভাষার জন্য রক্তদান করেছে। একটি জাতির ভেতরকার কথা সে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতে হলে নিজস্ব ভাষাচর্চা অপরিহার্য বিষয়। এখানে প্রত্যেক জাতিই তাদের মনের মধ্যকার কথা নিজ ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নিজ ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বলা গেলেও কথার মধ্যে সেই আবেগ পাওয়া যায় না। গ্রাম্য মায়ের হাজারো সন্তান এই শহরে জীবন ও জীবিকার জন্য সংগ্রাম করে প্রতিনিয়ত। সেখানে কর্পোরেট জীবনে মানুষ বাংলা ও ইংরেজি ভাষার মিশ্রণে একধরনের করপোরেট ভাষা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। যে ভাষা দ্বারা সেই ব্যক্তি কর্মক্ষেত্রে নিজেকে স্মার্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে। কিন্তু এই গ্রাম্য মায়ের সন্তান যখন তার প্রিয় বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে, তখন কিন্তু সে মায়ের শেখানো ভাষাতেই কথা বলে, যার ফলে সেই সন্তানটি কোনো কিছু না বললেও গলার কাঁপা স্বরে গ্রাম্য, কথিত অশিক্ষিত মা অনেক কিছুই বুঝে ফেলে।

আমাদের এই করপোরেট শহর জীবনে অনেককেই ভণিতা করে কথা বলতে দেখা যায়। জনসম্মুখে বা বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় অনেকে তো বাংলা কথা বলতে অনেক লজ্জাবোধ করে। নিজেকে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করে তুলে পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করার মাধ্যমে কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি নিজের অহমিকা সমাজে জাহির করে। এক্ষেত্রে বলে রাখা দরকার, নিজের মায়ের শেখানো বুলি ও ভাষা শহীদদের প্রতি যাদের সম্মানের অপ্রতুলতা তাদের লজ্জা হওয়া দরকার।

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। তবে, তার মানে শুধু এই নয় যে, আমাদের দিন-রাত বাংলা ভাষা চর্চা করতে হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে পুরো বিশ্ব এখন একটি মাত্র গ্রামের ন্যায় সংযুক্ত হয়েছে। ফলে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত অন্য দেশের অন্য ভাষার মানুষের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি। তাদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে আমাদের অবশ্যই তাদের উপযোগী ভাষাচর্চা করতে হবে। তার মানে এই না যে, বিশ্ব অর্থনৈতিক বাজারে আমরা অন্য ভাষা সংস্কৃতির প্রয়োগ করে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ভুলে যাব। যেই ব্যক্তি পুঁজিবাদী জীবন ব্যবস্থার মোহ মায়ায় পড়ে নিজ ভাষা সংস্কৃতি ভুলে যায়, সেই ব্যক্তি নিজ মাকে ভুলে যায় এবং সে তার শেকড়কে অস্বীকার করে।

এমন যদি কোনো এক সময় আলাদীনের চেরাগের দৈত্য আমাদের মাঝে এসে হাজির হয় আর আমাদের মনের অব্যক্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা ইচ্ছা শুনতে চায়, তবে অনেকেই অনেক ধরনের আধ্যাত্মিক শক্তি পাওয়ার কথা জানাবে। কেউ কেউ হয়তো বলবে দৈত্য আমাকে এমন শক্তি দাও, যাতে করে আমি মানুষের মনের মধ্যকার কথা শুনতে ও পড়তে পারি। ঠিক এসব মানুষের জন্য মহামূল্যবান উপকরণ হলো বই। কারণ বই মানুষের আত্মার কথা বলে। সেটা যেকোনো ভাষায় লিখিত হোক না কেনো, তা একজন লেখকের মনের ভেতরের হাজারো কথার প্রকাশ। একজন সাহিত্যিক সমাজের মধ্যে ঘটে যাওয়া হাজারও ঘটনাকে প্রথমে প্রত্যক্ষ করেন এবং পরবর্তী সময়ে সেসব সামাজিক নানান সংকট তুলে ধরেন ও তার প্রতিকার ব্যবস্থার কথাও বলে, তবে সেটা অনেক সময় লেখকরা সরাসরি বলে আবার কখনও সাহিত্য প্রতীক ব্যবহার করে বলে। কিন্তু সমাজ নিয়ে কথা বলে। কারণ একটি সমাজের বিবেক হলো একজন সাহিত্যিক। কাজেই, আমাদের এই ভাষার মাসে, বই মেলার মাসে আমরা বেশি বেশি বই পড়ার চর্চা গড়ে তুলি। নিজ দেশ ও বিশ্বের শেকড় সন্ধানী হয়ে উঠি।

শিক্ষার্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]