লেখক-প্রশাসক সম্পর্ক সুমধুর হোক
মো. মাঈন উদ্দিন, সেকশন অফিসার, রেজিস্ট্রার দপ্তর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
চলছে ফেব্রুয়ারি মাস। ভাষার মাস। ভাষার মাস মানেই বইয়ের মাস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে ভাষা ও বই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ভাষার মাসেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় মাসব্যাপী বইমেলা। যার নাম দেয়া হয়- অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলাদেশে বইয়ের পাঠক সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে। এই যে পাঠক সংখ্যা বাড়ছে- এর কারণ কী? এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, তরুণ সমাজের সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তারা বুঝতে পারছে, বন্ধু হিসেবে বইয়ের চেয়ে ভালো বন্ধু আর নেই। মানুষের মধ্যে হিংসাবিদ্বেষ, লোভ-লালসা, অনেক অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতা থাকতে পারে; কিন্তু বইয়ের তা নেই। তাই বই-ই মানুষের একান্ত এবং নিঃস্বার্থ বন্ধু। একটি ভালো বই-ই পারে মানুষের কুপ্রবৃত্তি দূরীভূত করতে। বইয়ের পাঠক সংখ্যা বাড়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো, এদেশের তরুণ সমাজের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়ছে। ফলে আগে যেখানে অধিকাংশ তরুণ পড়তেই জানত না, এখন সেখানে প্রতিটি তরুণই প্রায় শিক্ষিত, সচেতন। আগে যেখানে দামি-দামি গহনা দিয়ে আলমিরা সাজানো হতো, আজকাল সেখানে দামি-দামি গহনার পরিবর্তে ভালো বই স্থান করে নিচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে ভালো খবর।
অবশ্য অনেকেই মনে করেন ডিজিটালাইজেশনে ছোঁয়ায় বইয়ের পাঠক সংখ্যা কমছে। আমি তা মনে করি না। যদি তাই হতো তাহলে, প্রতিবছর নতুন বই প্রকাশের পরিমাণ বাড়ত না, বাড়ত না মেলার পরিধি। শুধু পাঠক সংখ্যাই বাড়ছে তা না। পাঠকের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে লেখক সংখ্যাও। বাংলা ভাষায় লিখিত বইয়ের মেলা আজকাল শুধু বাংলাদেশেই হচ্ছে তা নয়, বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে তা ইন্ডিয়া, অস্টেলিয়া, আমেরিকাসহ অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। এই যে বইয়ের পাঠক বাড়ছে, লেখক বাড়ছে, কিংবা বইমেলা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও হচ্ছে, এসবই খুশির খবর। এই খুশির খবরের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই কিছু কষ্টদায়ক খবর মাঝেমধ্যে দেখা যায়।
এই যে, বইমেলায় বই আসছে, এই বইগুলো কীভাবে করা হয়। নিয়ম হচ্ছে, লেখক পা-ুলিপি সাজাবেন। সেই পা-ুলিপিগুলো প্রকাশকের হাতে যাবে। প্রকাশক সেগুলো যাচাই-বাছাই করে মানহীন পা-ুলিপি ফেরত দেবেন আর মানসম্মত পা-ুলিপি বই আকারে প্রকাশ করবেন এবং যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী লেখককে তার প্রাপ্য পাওনা প্রদান করবেন। এই তো? কিন্তু তা কি হচ্ছে? ডিজিটালাইজেশনের যুগে সামাজিক যোগযোগমাধ্যম ফেইসবুকের কল্যাণে আজকাল মানুষ অনায়াসেই নিজের মনের গহিনে লোকয়িত কথাটিও অন্যকে জানাতে পারছে নিঃসংকোচে, অনায়াসেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে ইদানিং অনেক লেখকে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রকাশকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন- প্রকাশকরা টাকা নিয়ে বই প্রকাশ করছেন না, অনেক লেখক বিশেষত নতুন লেখক বিভিন্নভাবে প্রকাশক দ্বারা চরমভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এক লেখক আমাকে জানালেন তার ভোগান্তির কথা। তিনি একটি প্রকাশনিতে বই প্রকাশ করার জন্য বলেছিলেন।
প্রকাশক তার কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা দাবি করেন। কিছুদিন পর এ প্রকাশক লেখককে বললেন অতিরিক্ত আরও ২ হাজার টাকা দিতে হবে। দিলেন। কিছুদিন পর প্রকাশক তাকে বললেন, তাও হচ্ছে না, সব কিছুর খরচ বেড়ে গেছে; তাই আরও ৩ হাজার টাকা দিতে হবে। অবশেষে তিনি মোট ২০ হাজার টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করেছেন। বিনিময়ে তিনি ১০০ বই পেয়েছেন। তাও অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে! আরেক লেখক জানালেন, তিনি তিন-চার বছর আগে বাংলা বাজার এক প্রকাশকের কাছে বই প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। চুক্তি ছিল ১৫ হাজার টাকা দিতে হবে, মোট ৫০০ বই প্রকাশ হবে আড়াইশো লেখক পাবে, বাকি আড়াইশো প্রকাশকের কাছে থাকবে। কিন্তু ওই প্রকাশক পরে তার কাছ থেকে আরও ২ হাজার টাকা নেয় অতিরিক্ত খরচের কথা বলে। সে যায় হোক। কথা ছিল, প্রকাশকের কাছে থাকা বইগুলো বিক্রি করে যে টাকা হবে, তার একটি অংশ লেখককে দেয়া হবে রয়্যালিটি হিসেবে। লেখক আক্ষেপ করে জানালেন, ওই শেষ। এরপর প্রকাশক তাকে রয়্যালিটি দেবে তো দূরের কথা, লেখক ফোন করলে প্রকাশক বাজে ব্যবহার করেন। আরেকজন লেখক আছেন, যিনি মোটামুটি জনপ্রিয় লেখক। তিনি অনেক দিন ধরে বই প্রকাশ করছেন। তিনি জানালেন, তার আক্ষেপের কথা। তিনি বললেন, প্রকাশক আমাকে যে রয়্যালিটি দেয় তা যৎসামান্য। এমনকি বইমেলায় কতকপি বই বিক্রি হলো তার সঠিক হিসাব নিয়েও প্রকাশকরা লুকোচুরি করে। সরকারি-বেরসরকারি প্রজেক্টে আমার কতকপি বই কখন নিল এই হিসাবও প্রকাশক দেয় না। রয়্যালিটির স্লিপে অন্যের স্বাক্ষর করে লেখকের স্বাক্ষর বলে চালিয়ে নেয়। আপনি কোনো ব্যবস্থা নেন না কেন? প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আসলে লেখকরা প্রকাশকদের কাছে জিম্মি। প্রকাশকরা এক ধরনের টাউট। এদের সঙ্গে চাপাচাপি করলে বরং নিজেরই মান যাবে। আমরা লেখকরা যে এর জন্য একদমই দায়ী না তা নয়, অনেক লেখক আছেন, যাদের লেখা একদমই মানসম্পন্ন নয়, কোনো জাতীয় এমনকি স্থানীয় কোনো পত্রিকায় এদের একটি লেখাও ছাপা হয়নি। এমন লেখকও চায় তার একটি বই বের হোক। যে কোনো উপায়ে। টাকার বিনিময়ে হলেও। আবার অনেক অতিউৎসাহী ব্যক্তি রয়েছেন, যারা তাদের আদুরে স্ত্রীর প্ররোচনায় স্ত্রী কিংবা অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ের নামে একটি বই হোক- এমনটা চায় আর এই সুযোগটাই নেই ওই সব অসাধু প্রকাশকরা। এই হলো তিমির রাতের হতাশার কথা এবার আলোর ফেরিওয়ালাদের প্রসঙ্গে আসি। লক্ষ্য করেছি, অনেক প্রকাশক তাদের পোষ্টে জানিয়েছেন তারা টাকার বিনিময়ে বই প্রকাশ করেন না। মানসম্পন্ন পা-ুলিপি পেলে তারা নিজেদের বাজেটে বই প্রকাশ করেন। এগুলো উৎসাহব্যঞ্জক খবর। তাই আমি বলতে চাই- অনেক স্বনামধন্য প্রকাশনী নিজ খরচে মানসম্মত বই বের করে অনেক নতুন লেখক সৃষ্টিতে বিশাল ভূমিকা রাখছেন।
অপরদিকে এও আমি জানি, অনেক প্রকাশক-প্রকাশনী মানসম্মত-মানহীন পা-ুলিপি বই আকারে প্রকাশ করতে লেখকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। তারা লেখকদের ছাই দিয়ে ধরে বাইন মাছের মতো চামড়া ছিঁড়ে নেয়। ক্ষেত্রবিশেষে টাকা নিয়ে বই প্রকাশ করে না। আমি মনে করি, বই প্রকাশের ব্যাপারে লেখকদের আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত, বিশেষ করে নতুন লেখকদের। সেইসঙ্গে বাংলা একাডেমির উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে যথাযথ চিন্তাভাবনা করা একান্ত জরুরি। আমি এও মনে করি, লেখকরা সঠিক নিয়ম মেনে প্রকাশকদের পা-ুলিপি দেবেন। প্রকাশকরা নির্ধারিত নিয়মে মানসম্মত পা-ুলিপিগুলো বাঁছাই করে যথাযথ পন্থায় লেখকের বই প্রকাশ করবেন। স্বচ্ছতা বজায় থাকবে বই প্রকাশের। লেখক-প্রকাশক তিক্ত সম্পর্ক নয়; তাদের সম্পর্ক হবে মধুর। সুমধুর।