ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কথোপকথন : ডা. হালিদা হানুম আখতার

যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথা

কথা বলেছেন নাসরীন সুলতানা
যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথা

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনে শীর্ষস্থানে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ডা. হালিদা হানুম আখতার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশিষ্ট প্রজনন ও নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। জন্মনিয়ন্ত্রণ, ব্রেস্টফিডিং, মাতৃমৃত্যু ও অসুস্থতা, গর্ভপাত এবং কিশোরী প্রজনন স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ওপর যার ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রম দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে।

বিভিন্ন ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বহু পুরস্কার, সম্মাননা পেয়েছেন। আলোকিত বাংলাদেশের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ডা. হালিদা হানুম আখতার বলেন, সব ছাপিয়ে ‘সেবা সদন’ প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ প্রাপ্তিকেই জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে মনে করেন তিনি। সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেন যুদ্ধকালীন সময় ও পরবর্তী সময়ে সেবা সদনে কাজের অভিজ্ঞতা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা দ্বারা ধর্ষণের শিকার গর্ভবতী মেয়েদের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি উদ্যোগ নেয়। যার নাম ‘সেবা সদন’। এই সদনে কাজ করার দায়িত্ব পড়ে ডা. হালিদা হানুমের ওপর। সেই দায়িত্ব হাসিমুখে পালন করেছিলেন তিনি। একাত্তরে বিদেশে অবস্থান করায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারার আক্ষেপটা এই কাজের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও কমাতে চেয়েছিলেন ডা. হালিদা হানুম আখতার। সেবা সদনে আসা নির্যাতিত নারীদের অপমানে কুঁকড়ে যাওয়া মুখগুলো আজও ব্যথিত করে তাকে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন হালিদা হানুম। সেই সময় অনেক সুযোগ এবং পরিবারের মতামতকে অগ্রাহ্য করে ’৬৯ সালে তিনি পরিবার পরিকল্পনা মোবাইল টিমের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। শুরু হয় মাতৃমৃত্যু কমানো ও নারী স্বাস্থ্য উন্নয়নের লড়াই। কাজে যোগ দেয়ার কিছুদিন পর তাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণে আমেরিকায় পাঠানো হয়। তিনিসহ মোট তিনজনকে তখন বাংলাদেশ থেকে এই প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছিল। ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে আমেরিকায় পৌঁছার পর সেখানে জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কোর্স করার ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। এগুলো শেষ হওয়ার কথা ছিল ১৯৭১ সালের এপ্রিলে।

একাত্তরের দিনগুলো সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডা. হালিদা হানুম বলেন, মার্চ মাসের ২৩ কী ২৪ তারিখ ক্লাস শেষ করে ফিরছি, এমন সময় আমাদের স্যার আতিকুর রহমান জানালেন দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। স্যার ওখানে পিএইচডি করছিলেন। দেশে থাকা পরিবার এবং দেড় বছরের মেয়ের জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠল। আমাদের অবস্থা দেখে সেখানকার কর্তৃপক্ষ আমাদের জানালেন, যুদ্ধের মধ্যে তারা আমাদের দেশে পাঠাতে পারবেন না। একথা শোনার পর উৎকণ্ঠা আর অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। তবে একটা বিষয় লক্ষ করলাম- পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে, এটা শোনার পরপরই প্রশিক্ষণে আমাদের সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি সদস্যরা আলাদা হয়ে যায়! কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল আমাদের মধ্যে। ওখানে পাকিস্তান দূতাবাসের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। তখনও সেখানে বেশ ক’জন বাঙালি কর্মকর্তা ছিলেন। কিছুদিন পর দেখলাম তাদের অনেকেই দূতাবাসের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। বাইরে এসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এক অন্যরকম লড়াই শুরু করেন। এদিকে দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, আমেরিকায় তখন হোয়াইট হাউসের সামনে বাঙালিদের পক্ষে, পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। সমাবেশে আমরাও যোগ দিয়েছি। বিভিন্ন বয়সের আমেরিকান নাগরিকরাও যোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ সমর্থনে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, ফেস্টুন হাতে আমাদের সাহস দিয়েছেন। আমরা বাঙালি তিনজনই দেশে ফিরে আসি ২১ অক্টোবর ১৯৭১। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ঢাকা ছাড়ার পর অনিশ্চিত ভয়ের যাত্রা শুরু হয়। নৌকায় কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল। কয়েকদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিলাম। দেশ স্বাধীন হলো, তবে সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় ফিরতে পারিনি। কয়েকদিন পর ফিরে আসি ঢাকায়। যোগ দিই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আগের কাজের জায়গায়। এর পরই আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় কাজের সুযোগটা আসে।

ডা. হালিদা হানুমের চোখেমুখেও সেই উচ্ছ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। তিনি বলেন, কাজে যোগ দেয়ার পরপরই অফিস থেকে আমাকে বলা হলো, যুদ্ধের সময় সারাদেশে যে নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভবতী হয়েছে, তাদের চিকিৎসার জন্য একটা বিশেষ ক্লিনিক খোলা হয়েছে। ওই ক্লিনিকে আমাকে ডেপুটেশনে পাঠানো হবে। কারণ আমার এসব বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ আছে। এমন প্রস্তাবে আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম বলে বুঝাতে পারব না। মনে হলো, পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে পড়ার কারণে আমি এই সুবর্ণ সুযোগটি পেয়েছি। তখন নিজেকে ধন্য মনে হয়েছে। ধানমন্ডির ৩ নং সড়কের ‘সাদা বাহার’ নামে একটি বাড়িতে ক্লিনিকটি করা হয়েছিল। ড. খালেক নামের একজন এর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। জানুয়ারিতে শুরু হয় সেবা সদনের কার্যক্রম। এমন কয়েকটা ক্লিনিক সারাদেশে তৈরি করা হয়েছিল।

সেবা সদনে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিশিষ্ট এই প্রজনন ও নারী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, সত্যি বলতে সেখানে কী হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে প্রথমে কোনো ধারণাই ছিল না। তবে এখন সেবা সদনে যে কয়েকদিন কাজ করেছি সেগুলোকেই জীবনের সেরা কাজ বলে মনে করি। এখনও মনে আছে, ক্লিনিকে কয়েকটি রুম। প্রতি রুমে ৫-৬টি করে বেড পাতা ছিল। কম বয়সি মেয়েরা এসেছেন। কারোর বাবা, কারোর ভাই, কিংবা কারোর স্বজন তাদের এখানে রেখে গেছে। তাদের কেউ কেউ ৭ মাস, কেউ ৮ মাসের গর্ভবতী। সবার চেহারা বিমর্ষ। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলেই অঝোরে কাঁদত। তাদের কান্না আমাদেরও ভারাক্রান্ত করত।

আধুনিক আর বিশেষ পদ্ধতিতে গর্ভপাত ও প্রসব করানোর মূল কাজটি মূলত করতেন আমেরিকান ও ব্রিটিশ কয়েকজন চিকিৎসক। আমরা ক’জন ছিলাম তাদের সহযোগী। কারণ কাজটি ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। বিদেশ থেকে আসা একজন চিকিৎসকের নাম যতটা মনে আছে, ডা. ডেভিড। অধিকাংশ সময় আমরা রোগীকে ম্যানেজ করা যাকে বলে, সেই কাজটাই করতাম। সেখানে ৪ মাস কাজ করেছি। ৩০-৩২ জনের মতো মেয়ে সেখানে সেবা নিয়েছিল। এর মধ্যে একটি ঘটনা এখনও মনে হলে আমার চোখ ভিজে যায়। একজন কম বয়সি গর্ভবতী (মা) নারীকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। তিনি ক্লিনিকে আসেন খুব অসুস্থ অবস্থায়। তার গর্ভের সন্তান আগেই মারা গিয়েছিল। সে কারণেই অস্বাভাবিকভাবে তার রক্তপাত হচ্ছিল। ফেনা ফেনা রক্ত। ডাক্তারি পড়ার সময় বইতে পড়েছিলাম গর্ভের সন্তান আগে মারা গিয়ে থাকলে এমন ফেনা ফেনা রক্তপাত হয়। সেদিন বাস্তবে দেখেছিলাম। কিছুতেই রক্তপাত থামানো যায়নি। আমার সামনেই মেয়েটা মারা যায়। মেয়েটার মুখটা এখনও চোখে ভাসে। সেবা সদনে আসা মেয়েগুলোর আরেকটি বিষয় আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছিল। শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি ওদের মানসিক কষ্ট যে প্রচণ্ড ছিল, তা তাদের দেখেই বোঝা যেত। গর্ভের শিশুটির প্রতি তাদের কোনো মায়া ছিল না। শরীর থেকে আলাদা করতে পারলেই যেন তারা বাঁচে! সন্তান জন্মের পরও তারা সেই সন্তানের মুখ দেখতে চাইতেন না। হয়তো এই সন্তানকে মন থেকে আপন করতে পারেননি। তাই মা হলেও তাদের আচরণে ছিল অসহায়ত্ব, দূরত্ব একটা ভাব। আমরাও তাদের কিছু বলতে চাইনি। কারণ এই সন্তান তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত। কারণ তারা প্রতিটি মুহূর্তে জানছেন, পাকিস্তান সৈন্যদের ধর্ষণের শিকার হয়ে এই সন্তান জন্ম দিতে হচ্ছে। সমাজে তাদের পরিবারকে এর জন্য হেয় হতে হয়েছে। পেশাগত দায়িত্বের আড়ালে একজন মা হয়ে সেদিন দেখেছি তাদের অপমানের কষ্ট আর যন্ত্রণা।

ওইসব নারীর জীবিত সন্তানদের জন্য কী ব্যবস্থা ছিল সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওইসব শিশুদের বলা হতো যুদ্ধশিশু। তারা জন্মানোর পর শিশুদের নেয়া হতো ‘টেরিজা হোম’-এ। ওই প্রতিষ্ঠানের সদস্যরাই এসে নিয়ে যেতেন। পরে তারা ওই শিশুদের দত্তক দিত নিঃসন্তান দম্পতিদের। সে সময় অনেক বিদেশিও যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিয়েছেন। সন্তান জন্মের পর ওই মেয়েদের অনেকেই আমাদের কাছে জানতে চাইতেন তাদের বাড়ি থেকে কেউ খোঁজ নিয়েছিল কি-না। ফোন করেছিল কি-না। কিন্তু যারা একবার তাদের রেখে গেছে, কেউ আর তাদের খোঁজখবর নেয়নি। তবে তাদের সেই কথাটি বলতে পারতাম না। তাদের আশ্বস্ত করতাম। বলতাম, হয়তো ফোনে পায়নি। চিঠি হয়তো লিখেছে, আসবে। কিন্তু ওরাও বুঝে যেত তাদের আর বাড়ি ফেরা হবে না। আপনজনের কাছে ফেরা হবে না। সত্যি বলতে কী, তাদের আর পরিবারের কাছে ফেরা হয়নি। মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে মানুষ যখন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে, তখন ওই নারীরা নীরবে কাঁদছে, নিজেদের লুকানোর পথ খুঁজছে। কিছুদিন পর তারা অনেকে সুস্থ হয়ে ওঠেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন এই নারীদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিলেন। গঠন করলেন নারী কল্যাণ পুনর্বাসন কেন্দ্র। সেবা সদনটি বন্ধ হওয়ার পর আমিও আগের কাজে যোগ দিই। মুক্তিযুদ্ধে সবাই হয়তো অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেনি। তবে নির্যাতিত এই নারীরা দেশের জন্য যেভাবে যুদ্ধ করেছেন সত্যিকার অর্থেই তারা চিস্মরণীয় হয়ে থাকার, শ্রদ্ধা করার মতো।

ডা. হালিদা হানুমের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা রংপুর শহরে। প্রথমে রংপুর ছেড়ে ঢাকায় আসেন ডাক্তারি পড়ার জন্য। তখন যমুনা বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে ঢাকা আসতে ১৮ ঘণ্টা সময় লাগত! তিনি বলেন, আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব মা-বাবা দু’জনই। মা ডাক্তার ছিলেন বলে মাকে দেখেই ডাক্তার হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। বাবা জমিদারপুত্র ছিলেন। তবে বাবার কথা একটু বেশি স্মরণ করতে হবে। তিনি আমাদের ৫ ভাইবোনকে অনেক সময় দিয়েছেন, অনেক যত্ন করেছেন। আদব-কায়দা শিখিয়েছেন। আমার বেশিরভাগ সময় কাজেই ব্যস্ত থাকতে হয়। অবসর খুব কম। যেটুকু অবসর পাই- অবসরে গান শুনতে পছন্দ করি। ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধব, এক্স কলিগদের সঙ্গে আড্ডা দিই, বেড়াতে যাই। প্রেম মানুষের জীবনে এক বিশেষ অনুভূতি। মনের সুস্থতার জন্য প্রেম খুব প্রয়োজনীয়। প্রেম ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না।

আমাদের দুই কন্যাসন্তান- ফারহানা আক্তার রুহী ও আফসানা আক্তার। তারা উচ্চ শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত এবং প্রবাসী।

আমাদের দেশের মায়েরা আগের তুলনায় সচেতন হলেও এখনও সুবিধা বঞ্চিতদের ৫৩ শতাংশ ডেলিভারি বাড়িতেই করে থাকেন। এ ধরনের হোম ডেলিভারি ৫০ শতাংশ ঝুঁকিপূর্ণ। আমার দীর্ঘ কর্মময় জীবনে সমাজের সুবিধা বঞ্চিত ও নির্যাতিত নারীদের সেবা করার যে সুযোগ আমি পেয়েছি, তা আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি বলে নিজেকে ধন্য মনে করি।

ধন্যবাদ

আপনাকেও ধন্যবাদ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত