ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সুবর্ণ জয়ন্তী ও ড. আমীরুল ইসলাম

মেহেদী হাসান বুলবুল, বুয়েটের তথ্য ও প্রকাশনা শাখায় কর্মরত, [email protected]
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সুবর্ণ জয়ন্তী ও ড. আমীরুল ইসলাম

২০০১ সালের ৯ ফেরুয়ারি। সবেমাত্র কমতে শুরু করেছ শীত। পুরোনো পাতাগুলো ঝরে পড়ছে গাছ থেকে। এমন দিনে আমাদের গ্রামের একটা নক্ষত্র ঝরে যায়। দিনের মধ্য ভাগে খবর পেলাম আমাদের প্রতিবেশী ‘ডাইরেক্টর’ মারা গিয়েছেন। কিসের ডাইরেক্ট ছিলেন তিনি তা বোঝার মতো বোধ হয়নি তখনো প্রাথমিকের গণ্ডি অতিক্রম না করা আমার। রাত ৮টার সংবাদে তার একটা পোর্ট্রেট ছবি দেখিয়ে করুণ সুরে সংবাদ পাঠিকা সেই মৃত্যুর সংবাদ দিলেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক (মূলত মহাপরিচালক, তখন পরিচালক বলা হতো) ড. আমীরুল ইসলাম মারা গিয়েছেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তার সংক্ষিপ্ত জীবনীও তুলে ধরেন সংবাদ উপস্থাপিকা। তার দু-এক দিন পর মরদেহ আনা হয় নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার অর্জুনতলা ইউনিয়নের অর্জুনতলা গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে। কৃষি, কৃষি প্রযুক্তির সুবাদে আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ড. আমীরুল ইসলামের জীবনীতে একটু চোখ বুলালেই আমরা বুঝতে পারব দেশের আজকের আধুনিক, স্বনির্ভর কৃষির গোড়াপত্তনটা কীভাবে হয়েছিল। কী অবদান ছিল এই প্রতিথযশা বিজ্ঞানীর!

যে জাতির সকালের শুরু হয় চালের তৈরি খাবার দিয়ে এবং রাতের খাবারেও চাই ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত। যে জাতির সন্তানরা বিলেত গেলে দু-তিন দিন ভাত না খেলে তার হৃদয়ে হাহাকার তৈরি হয় একটুখানি ডাল-ভাতের জন্য, সে জাতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে তৈরি হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। দেশের জনসংখ্যা ৭ কোটি থেকে ১৬ কোটিতে পরিণত হয়েছে। নতুন নতুন আবাসন, শিল্পকারখানা, রাস্তাঘাট ও নানান উন্নয়ন অবকাঠামো তৈরি হয়ে কমেছে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ। এরই মধ্যে দেশে বারবার অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলেও কখনও সংকট তৈরি হয়নি খাদ্যে। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে ঠিকই কিন্তু খাদ্যে স্পেশালি ধান-চালে কখনও সংকট তৈরি হয়নি। বরং শ্রীলংকাসহ নানান দেশে রপ্তানি করা গেছে ধান-চাল। দুর্যোগে ধান-চাল নিয়ে প্রতিবেশী দেশের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। কী জাদুর কাঠির বলে ধান-চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ?

এবার ড. এম আমীরুল ইসলামের জীবনীটা একটু জেনে নেয়া যাক। ১৯১৮ সালের জানুয়ারি মাসে নোয়াখালীর সেনবাগে উপজেলার অর্জুনতলা গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪১ ও ১৯৪২ সালে রসায়ন শাস্ত্রে যথাক্রমে বিএসসি অনার্স এবং এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে তিনিই প্রথম রসায়নশাস্ত্রের বিএসসি অনার্স কোর্সে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। তিনি ক্যারিয়ারের শুরুতে All India Corporation-এ চাকরি করার পর ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে থেকে ১৯৪৯ সালে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে পিএইচডি লাভ করেন। ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবপ্রতিষ্ঠিত মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে সিনিয়র লেকচাররার হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫০-১৯৬১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কৃষি রসায়নবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মৃত্তিকা শ্রেণি বিন্যাসের অগ্রদূত। এছাড়া তার আরেকটি উল্লেখ যোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে কৃষকের জমিতে সার নিয়ে পরীক্ষা কার্যক্রম এবং সার প্রয়োগ নির্দেশিকা প্রস্তুত করা। তিনি ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত মৃত্তিকা জরিপ বিভাগের প্রথম পরিচালক এবং মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি মৃত্তিকা সংক্রান্ত আধুনিক জরিপ কাজ শুরু করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিভাগের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। এর পর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭১-৭২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (সে সময় পরিচালক বলা হতো) ছিলেন। চাকরি জীবনের শেষ দু’বছর (১৯৭৭-১৯৭৮) বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বার ছিলেন। তিনি USAID, IFDC, FAO, CIRDAP, UNDP প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন। Advances in Agronomy এবং Soil Science textmn তাঁর গবেষণা প্রকাশনার সংখ্যা ৬০টি। বিভিন্ন বইয়ে তার প্রকাশনা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ধান গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রধান কেন্দ্র ও পথিকৃৎ হিসেবে দেশে-বিদেশে সুপরিচিত প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭০ সালের ১ অক্টোবর যাত্রা শুরু করে এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সংসদীয় আইন ১০, ১৯৭৩ (Parliamentary Act X, 1973)-এর বলে ‘বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)’ নাম ধারণ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব দেন ড. এম আমীরুল ইসলামকে। তার হাত ধরেই ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মূল কাঠামো গড়ে ওঠে।

দেশের বৈচিত্র্যময় কৃষি পরিবেশ অঞ্চলগুলোতে ধান উৎপাদনের সমস্যা ও সম্ভাবনা পর্যবেক্ষণ ও সে বিষয়ে গবেষণার জন্য দেশের বিভিন্ন কৃষি পরিবেশ বর্তমানে অঞ্চলে ১১টি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। যেখানে কাজ করছেন তিন শতাধিক বিজ্ঞানী। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ১০৩টি ইনব্রিড ও ৮টি হাইব্রিডসহ ১১১টি উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে লবণাক্ততা সহনশীল ১০টি জাত, রোপা আমন মৌসুমে খরা সহনশীল ৪টি জাত, জলামগ্নতা সহনশীল ৫টি জাত, পুষ্টিসমৃদ্ধ ৬টি জাত এবং রপ্তানিযোগ্য ৪টি জাত রয়েছে। বিখ্যাত কালিজিরা এবং কাটারিভোগ ধান বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হয়েছে। ধান গবেষণা এবং ধানের জাত উদ্ভাবনে বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট মর্যাদাপূর্ণ ২৬টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। দেশের ধান গবেষণায় এমন সব সাফল্যের সূচনা করেছেন ড. এম আমীরুল ইসলামই।

২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গৌরব ও সাফল্যের ৫০ বছরে উদযাপন ও বঙ্গবন্ধু পিয়ারে ট্রুডো কৃষি প্রযুক্তি কেন্দ্রের উদ্বোধন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ উপলক্ষ্যে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে ব্রি কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা, ধান গবেষণা ও কৃষি প্রযুক্তির সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবে প্রতিযশা বিজ্ঞানী ড. এম আমীরুল ইসলাম নাম।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত