স্বাধীনতার পটভূমি এবং ঐতিহাসিক ৭ মার্চ

ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির অধিকার আদায়ের সূচনা হয়। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের শাহাদতবরণকারী- শফিক, রফিক, জব্বার, বরকত-এর রক্তে স্বাধীনতার বীজ রচিত হয়। ১৯৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিছু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে।

প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে কোনোভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ১ মার্চ এ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এ সংবাদে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতা কাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তা বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ ভাষণ, এ ভাষণে রয়েছে বহুমাত্রিক বিশেষত্ব মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে’ উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রিব, তখন এরপর বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তার চূড়ান্ত আদেশ, ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এ ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান তিনি। ১২টি ভাষায় ভাষণটি অনুবাদ করা হয়। নিউজউইক ম্যাগাজিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হয়। পুরো ময়দান পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে। এই জনতা এবং সার্বিকভাবে সমগ্র জাতির উদ্দেশে শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ এতদিন শুধু বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামে এক অনন্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত ছিল। ২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষে ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টরি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ) ৭ মার্চের ভাষণসহ এখন পর্যন্ত ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে।

এ প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একে ইতিহাসের প্রতিশোধ হিসেবে তুলনা করেছেন। কারণ স্বাধীন দেশে দীর্ঘসময় এই ভাষণের প্রচার নিষিদ্ধ ছিল।

UNESCO’র বিশ্ব স্বীকৃতির মাধ্যমে তা এখন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। বঙ্গবন্ধুর দেয়া ১ হাজার ১০৮টি শব্দ সংখ্যার ভাষণটি বিশ্বের প্রথম ও সর্বশেষ মুখে উচ্চারিত ক্ষুদ্রতম কালজয়ী মহাকাব্যের অনুপম দৃষ্টান্ত।

জাতির ক্রান্তিকালে স্বাধীনতাকামী ৭ কোটি মানুষের প্রতি এ ভাষণ রাখতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু যে যুক্তিপূর্ণ অথচ আবেগময়, সংরক্ষিত অথচ সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিতপূর্ণ অথচ অর্থবহ বাক্য ব্যবহার করেন। বাংলাদেশের মানুষকে তা আজও একাত্তরের মতো সমভাবে উদ্দীপ্ত করে তোলে। এ ভাষণের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতির বিশ্ব ইতিহাসে নতুন এক শিখরে পৌঁছে যায়। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতা ও গেরিলাযুদ্ধের দিকনিদের্শনা। এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ বর্জ্র নিনাদে আসন্ন মহামুক্তির আনন্দে বাঙালি জাতি উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। যুগ যুগ ধরে শোষিত বঞ্চিত বাঙালি ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষ্যে।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার পথ ধরেই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্র আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

৭ মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শক্তির উৎস। এ ভাষণই পৃথিবীর অন্যান্য বিখ্যাত নেতাদের ভাষণের সঙ্গে ধ্রুবতারা হয়ে আজীবন দীপ্ত্যমান হয়ে বিরাজ করবে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে। আজ স্বাধীন বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পদাপর্ণ করেছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশ গড়তে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের বিকল্প নেই।