বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ড. আবদুল আলীম তালুকদার, কবি, শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল; যা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্বসংস্থা ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের মহামূল্যবান দলিল (ডকুন্টোরি হেরিটেজ) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তার সঙ্গে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিও) এ ভাষণটি সসম্মানে সংগৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রকারান্তরে জাগিয়ে তুলেছিল বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন। আজো ভাষণটি শুনলেই শরীরের ভেতর কেমন যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তনুমনে রক্তধারা টগবগিয়ে ওঠে। প্রেরণা জোগায় স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হবার।

বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা যা একদিনে অর্জিত হয়নি; এর জন্য অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, ত্যাগ-তিতীক্ষা ও লাখ লাখ প্রাণের বিসর্জন দিতে হয়েছে। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত বাঙালি জাতিকে এই দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অসম সাহসিকতার সঙ্গে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তা ছিল মূলত : বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। যুগে যুগে বিশ্বের নানা দেশের মহান জননেতাদের আর্ত-পীড়িত মানুষের মৌল-মানবিক অধিকার, শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস ও আন্দোলন-সংগ্রামের বিষয়ে কালজয়ী ভাষণ প্রদত্ত হলেও ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালি জাতির চির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাভের পূর্বক্ষণে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ প্রদান করেন তা ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কারণ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে যেমন ছিল ৭ কোটি বাঙালির বাঁচার প্রশ্ন তেমনি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সরাসরি রোষাণলে না পড়ে প্রয়োজনে সংগ্রামের পরিকল্পনা তুলে ধরা।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চে প্রদত্ত ভাষণের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হলে একটু পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যেকোনো উপায়ে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ১ মার্চ এ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এ সংবাদে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ববাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ পটভূমিতেই ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুলসংখ্যক লোক একত্রিত হয়; পুরো ময়দান পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে। উপস্থিত জনতা এবং সার্বিকভাবে সমগ্র জাতির উদ্দেশে শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন। ৭ মার্চে রেসকোর্সের ভাষণের পরে নিউইয়র্কের দ্য নিউজ উইক ম্যাগাজিন ৫ এপ্রিলে প্রকাশিত সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ বলে আখ্যায়িত করে।

৭ মার্চের ভাষণকে বলা যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক দিকনির্দেশনা। পাকিস্তানিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের টালবাহানা দেখেই আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গ বুঝতে পেরেছিলেন যে, কোনোভাবেই আওয়ামী লীগকে জাতীয় পরিষদে সরকার গঠন করতে দেবে না পশ্চিমা শাসকরা। এমতাবস্থায়, দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী দিশেহারা হওয়া শুরু করে। নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সরাসরি স্বাধীনতার ডাকও দিতে পারছিল না, আবার পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র মুখ বুজে সহ্য করাও ছিল কঠিন। সেজন্যই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে একটি নির্দেশনামূলক ও যুগান্তকারী ভাষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব-পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ আক্রমণাত্মক কর্মসূচি পালনের ঘোষণা এবং দেশব্যাপী ধর্মঘট পালনের আহ্বান করে। তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানান। শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণের সার্বিক বিষয় ও উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এবং বাঙালির অধিকার নিয়ে সব সময় উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাস নিয়ে দেশের এবং দেশের মানুষের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতেন। তার সেই বিশ্বাস থেকেই তিনি ৭ মার্চের বক্তৃতা প্রদান করেন। কারণ তৎকালীন সময়ের আন্তর্জাতিক পটভূমিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম একটি নতুনরূপ ধারণ করে এবং তার এ আন্দোলন গোটা বিশ্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর এই ৭ মার্চের আন্দোলন স্বাধীনতাকামী বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের রূপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর এই আরাধ্য স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করেছিল ৭ মার্চের ভাষণের এবং বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী ও বুদ্ধিদীপ্ত দিকনির্দেশনার উপর।

আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর অবদান। তার অনন্য সাধারণ বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভাস্বর ওই ভাষণে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে একসূত্রে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- ছিল মূলত নিপীড়িত-নিষ্পেষিত বাঙালির পক্ষে স্বাধীনতার ডাক। ইতিহাস সৃষ্টিকারী সেই জ্বালাময়ী ভাষণের ধারাবাহিকতায় ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহুকাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন-সাধ- স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তৎকালীন সময়ে দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি আমাদের প্রিয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তখন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ঘোষণা প্রদান করেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। এসব কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত।

পরিশেষে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সূচারুভাবে বিশ্লেষণ করলে এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিকটি সমান্তরালভাবে চোখে পড়ে। শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সে ভাষণটি প্রদান করেননি। বাঙালি সেদিন তার মাধ্যমে তাকে কেন্দ্র করে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল। তাই, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ও বাণী ছিল বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার নিয়ন্ত্রক। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অপ্রতিম ভাষণের গুরুত্ব সব দিক বিবেচনায় অনন্য এবং অসাধারণ কারণ এ ভাষণের মাধ্যমে তিনি সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন; যা তার মতো নরশার্দুল ক্যারিশমেটিক জনগণ নন্দিত নেতার দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল।