পুণ্যার্জনের রাত শবেবরাত

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক, [email protected]

প্রকাশ : ০৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতটি আমাদের এই উপমহাদেশে ‘শবেবরাত’ হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। ইমানদারদের আত্মিক ও নৈতিক উৎকর্ষের জন্য দিনক্ষণ, স্থান, কাল ও যুগ হিসেবে অনেক বরকতময় রজনী ও ইবাদতের সুবর্ণ সুযোগ আখেরি নবী রাসুল (সা.)-এর উম্মতদের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধা প্রদান করেছেন। ইবাদতের এসব উর্বর সময়কে বান্দা যথাযথভাবে ঐকান্তিকতার সঙ্গে কাজে লাগাতে পারলে সামান্য সাধনা, ক্ষুদ্র পরিশীলন ও অনুশীলন দ্বারা প্রশান্তির বারিধারায় সিক্ত হয়ে হাসিল করতে পারবেন আল্লাহর সন্তুষ্টি। এমনই বিশেষ উল্লেখযোগ্য পাঁচটি রাতের মধ্যে একটি রজনী পবিত্র শবেবরাত।

শবেবরাত শব্দটি ফারসি। শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি; শবে বরাত অর্থ মুক্তির রজনী। এর আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’। হাদিসে শবেবরাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্যরাত বলা হয়েছে। আমাদের দেশে এ রাতটি শবেবরাত নামে অধিক পরিচিত। শবেবরাত একটি পুণ্যময় রজনী। তবে এই রজনীর ফজিলত ও আমল নিয়ে আলেমদের মধ্যে ইদানীং বিভিন্ন ধরনের মতানৈক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। যার কারণে শবেবরাত নিয়েও ধর্মপ্রাণ মানুষ বিভ্রান্তির শিকার। কেউ করছেন বাড়াবাড়ি আবার কেউ করছেন ছাড়াছাড়ি। অর্থাৎ প্রথম দল শবেবরাত নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে শবেবরাতকে শবে কদরের কাছাকাছি নিয়ে যান। কেউ আবার শবেকদর থেকে বেশি গুরুত্ব দেন। বিপক্ষের দল শবেবরাতকে রীতিমতো অস্বীকার করেন। তারা শবেবরাতের কোনো ফজিলতকে মানতেই রাজি নন।

আরেকদল আছেন যারা শবেবরাত নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে না, আবার শবেবরাতকে অস্বীকারও করেন না। তারা শবেবরাতকে পুণ্যময় রজনী হিসেবে নফল ইবাদত-বন্দেগিসহ বিভিন্ন নফল আমলের মাধ্যমে বরাতের রজনীতে জাগ্রত থেকে আমল করেন। এটিই হলো উত্তম ও সঠিক পন্থা। কারণ শবেবরাত শবেকদরের সমতুল্য দূরে থাক, মর্যাদা এবং ফজিলতে শবেকদরের কাছাকাছিই নয়। শবেকদর ও শবেবরাতের মাঝে অনেক পার্থক্য। কোরআন শবেকদরকে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করা হয়েছে। এ রাতেই কোরআনুল কারিম অবতীর্ণ হয়েছে। তাই শবেবরাতকে শবেকদরের সমতুল্য বা কাছাকাছি মনে করা রীতিমতো বাড়াবাড়ি। আর শবেকদরের মতো শবেবরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব না থাকলেও শবেবরাতকে অস্বীকার করা কিংবা বিদআত বলারও সুযোগ নেই। শবেবরাতের ফজিলত ও আমল হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তবে শবেবরাত নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যেমন ঠিক নয়, তেমনিভাবে তা অস্বীকার করাও সঠিক নয়। তাই আমাদের প্রেরণা নিতে হবে, প্রতিটি দিন যেন আমাদের জন্য এ ধরনের ইবাদতের উপলক্ষ হয়। আল্লাহতায়ালা বান্দাদের জন্য কিছু মাস পুরস্কার ও মহিমান্বিত করেছেন। চন্দ্র মাসের শাবান মাস তার মধ্যে অন্যতম।

রাসুল (সা.) শাবান মাসকে তার নিজের মাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল বরাতের মতো অত্যন্ত বরকতময় রজনী। যাকে বলা হয় মাহে রমজানের আগমনী বার্তা। শাবান মাস মূলত মাহে রমজানের প্রস্তুতির মাস। প্রতিবারের মতো শাবান মাস মুসলমানদের কাছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহিমান্বিত রমজান মাসের সওগাত নিয়ে আসে। রাসুল (সা.) শাবান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি বেশি নফল রোজা, কোরআন তেলাওয়াত ও সালাত আদায় করে মাহে রমজানের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘রাসুল (সা.) কখনও নফল রোজা রাখতে শুরু করলে আমরা বলাবলি করতাম, তিনি বিরতি দেবেন না। আর রোজার বিরতি দিলে আমরা বলতাম যে, তিনি মনে হয় এখন আর নফল রোজা রাখবেন না। আমি রাসুল (সা.)-কে রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে পূর্ণ এক মাস রোজা পালন করতে দেখিনি। কিন্তু শাবান মাসে তিনি বেশি নফল রোজা রেখেছেন’ (মুসলিম)। অন্যত্রে বর্ণিত আছে- ‘শাবান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে রাসুল (সা.) এত বেশি নফল রোজা আদায় করতেন না’ (বোখারি)। এ সম্পর্কে আনাস (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনার কাছে মাহে রমজানের পর কোন মাসের রোজা উত্তম?’ তিনি বললেন, ‘রমজান মাসের সম্মান প্রদর্শনকল্পে শাবানের রোজা উত্তম’ (তিরমিজি)। মাহে রমজানে দীর্ঘ ৩০টি রোজা পালনের কঠিন কর্মসাধনা সহজ ও নির্বিঘ্নে আদায় করার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে শাবান মাসের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত- ‘রাসুল (সা.)-এর প্রিয় মাসের একটি হলো শাবান। এ মাসে নফল রোজা আদায় করেই তিনি মাহে রমজানের রোজা পালন করতেন।’ (আবু দাউদ)।

রাসুল (সা.) ভাষায় শবেবরাত হলো ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’। অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫তম রজনী। এ রাতের ফজিলত বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। মুআজ ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, শাবানের ১৫তম রাতে আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। মুশরিক ও পরস্পরবিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে হিব্বান, শুআবুল ইমান)। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন শাবানের ১৫তম রাত আসবে, তোমরা এ রাতে নামাজ পড়ো এবং পরবর্তী দিনে রোজা রেখো। (রায়হাকি)। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আল¬াহতায়ালা অর্ধশাবানের রাতে যাবতীয় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন। আর শবেকদরে তা নির্দিষ্ট দায়িত্বশীলদের অর্পণ করেন। (তাফসিরে কুরতুবি)।

শবেবরাত মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য বিশেষ উপহার। তাই এ রাত সম্পর্কে আমাদের বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। রাতটি ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে কাটাতে হবে। এ রাতের নির্ধারিত কোনো আমল না থাকলেও বিশেষ কিছু আমল করা যেতে পারে। যেমন নিজের যাবতীয় গোনাহের জন্য তওবা করে রাব্বুল আলামিনের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করা। নিজের মনের নেক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ও মৃতদের মাগফিরাতের জন্য বেশি বেশি দোয়া করা। নফল রোজা, নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, সালাতুস তাসবিহ, জিকির-আজকার, দোয়া-দুরুদ, তওবা-ইস্তেগফার, দান-সদকা, উমরি ক্বাজা নামাজ, কবর জিয়ারত, দান-সদকাহসহ নফল আমলের মাধ্যমে রাত গুজার করা। এ রাতের নফল নামাজের নির্ধারিত কোনো নিয়ম নেই, বরং অন্যান্য নফল নামাজের মতো দুই রাকাতের নিয়ত করে সুরা ফাতেহার পর যে কোনো সুরা মিলিয়ে যত ইচ্ছা পড়া যেতে পারে।

নফল ইবাদত একাকিত্বে আদায় করাই আল্লাহতায়ালা বেশি ভালোবাসেন। ইখলাসের সঙ্গে স্বল্প আমল ঐকান্তিকতাহীন অধিক আমল থেকে উত্তম। সম্ভব হলে সারারাত জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগি করে পরদিন অর্থাৎ ১৫তম দিনে নফল রোজা রাখার চেষ্টা করা, তবে তা বাধ্যতামূলক নয়। মনে রাখা দরকার, সারারাত জাগ্রত থেকে ইবাদত করা সুন্নত, ওয়াজিব, ফরজ কোনো আমল নয়। তবে ফজরের নামাজ পড়া ফরজ এবং জামাতে পড়া অপরিহার্য। অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যে, রাতভর নফল ইবাদত করে ফজরের নামাজ যেন কাজা না হয়। আল্লাহ আমাদের প্রকৃত ইবাদতের তৌফিক দান করুন।