ছাদকৃষি এবং পতিত জমিতে চাষ করে উৎপাদন বাড়ানো সময়ের দাবি

কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম, উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]

প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

একবার ভাবুন, আপনি বাজারে গেলেন সবজি কিনতে; কিন্তু চাহিদা মতো পেলেন না! আবার আদরে সন্তানের জন্য তাজা ফল কিনতে গেলেন, সেটাও পেলেন না! এরকম পরিস্থিতি বাংলাদেশে বর্তমান পেক্ষাপটে কাল্পনিক মনে হলেও এ ঘটনা আজ সম্মুখীন যুক্তরাজ্য। ব্রিটেনে তিনটির বেশি টমেটো কেনা নিষেধ ‘যুক্তরাজ্যের সবজি বাজারে সংকট, একসঙ্গে বেশি পরিমাণ কিনতে বারণ দোকানিদের’ সম্প্রতি জাতীয় দৈনিকে এরকম শিরোনাম চোখে পড়ছে।

যুক্তরাজ্যে এমন পরিস্থিতিতে আজিম মাহমুদ তার ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘ব্রিটেনে আসার পর থেকে গত ২৫ বছরে আমি অভাব কী জিনিস তা দেখিনি। এদের বাজারে সবকিছু এত বেশি পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে যে, মানুষকে আমি অনেক অপচয় করতে দেখেছি। এমন কি করোনার সময়ও মানুষ শুধু বাজার করেছে এবং খেয়েছে। এ প্রথম ব্রিটেনের বাজারগুলোতে সবজির সংকট দেখলাম’। তার স্ট্যাট্যাসে সহজেই বোঝা যায়- আজ যুক্তরাজ্যে চিত্র। 

মহামারি আর যুদ্ধের সংকটে সাড়ে তিনটি বছর পার করা এই পৃথিবীর চলতি বছরটাও যে অর্থনৈতিকভাবে ভালো যাবে না, সেই পূর্বাভাস বিশ্ব সংস্থাগুলো দিয়ে আসছে। সেই আশঙ্কায় দেশে দেশে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সঞ্চয়ের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বারবার দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বলে সতর্ক করে আসছেন দেশবাসীকে। সত্যি সত্যি যদি তেমন বিপদ আসন্ন হয়, তা সামাল দিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।

যদিও দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে বলে সরকার ও নীতি-নির্ধারকরা বিভিন্ন সময়ে দাবি করে আসছে। সে বিষয়ে যুক্তিতর্ক না করে আমাদের বুঝতে হবে- এ দেশ অনেকটাই বিশ্ব বাজারের ওপর নির্ভরশীল। তাই  বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি কিছুটা ব্যাহত হলেই তা দেশের ভেতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরই মধ্যে ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের কারণে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী দাম বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছে। সেজন্য চাষের আওতায় আনা হচ্ছে অনাবাদি জমি। একই সঙ্গে এক ফসলি জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাছাড়া কম সময়ে ফসল ঘরে তোলা যায়, এমন নতুন জাত উদ্ভাবনের বিষয়ও বিবেচনায় আনা হয়েছে।

ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের টান এবার খাবারের পাতে এসে পড়েছে। যা বাড়ির পাশে পড়ে থাকা জমিতে আবাদ এবং ছাদ কৃষি বিষয়টি এনেছে সামনে। সরকারও এমন পতিত জমি খুঁজে চাষ শুরুর কার্যক্রমে নেমে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময় তার বক্তব্যে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব উৎপাদনের মাধ্যমে চাহিদা মেটানো ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। খাদ্য সংকট মোকাবিলায় ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল সর্বপ্রথম দেশের প্রতিটি ইঞ্চি জমিকে চাষাবাদের আওতায় আনতে প্রত্যেককে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী শুধু আহ্বান জানিয়েই থেমে থাকেননি। সরকারি বাসভবনে কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন। মাটি ও ফসলের সংস্পর্শে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। গণভবনের বিশাল আঙিনায় গড়ে তোলা গবাদিপশুর খামারে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কবুতর যেমন আছে, তেমনই বিভিন্ন ধরনের ধান, শাক-সবজি, ফুল-ফল, মধু ও মাছ চাষ করছেন। দেশের খাদ্য পরিস্থিতি কিছুটা স্বস্তিদায়ক রাখতে প্রধানমন্ত্রীর শখের কৃষি সবার জন্য শিক্ষণীয় ও অনুপ্রেরণাদায়ক হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।  

শহরাঞ্চলের মানুষ যেন ছাদ কৃষিতে বেশি মনোযোগী হয়, সে বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। ছাদ কৃষি সম্প্রসারিত হলে সেখান থেকে উৎপাদিত পণ্য একদিকে যেমন মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদা মেটাবে, ঠিক তেমনিভাবে পরিবেশকে বাস উপযোগী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বুয়েটের বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। ঢাকা শহরের ৭০ ভাগ জায়গা দখল করে আছে ফাঁকা ছাদ। এই ছাদগুলোকে অনায়াসেই সবুজ করা যায়। আর তাতে নগরীর প্রতিটি বাড়ির ছাদ হয়ে উঠতে পারে একখণ্ড সবুজ বাগান। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে ছাদের বাগান থেকে নিজের পারিবারিক ফল-মূল, শাক-সবজির ছাহিদা মিটিয়ে আয় করাও সম্ভব। স্যাটেলাইট যুগে শিশুদের মানসিক বিকাশেও এধরনের বাগান ভূমিকা রাখছে। যে কেউ দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে সামান্য সময় ব্যয় করেই করতে পারে, একটি সুন্দর সবুজ ছাদ বাগান।

একটু দৃষ্টিপাত করা যাক। প্রধানত শহরাঞ্চলই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান কর্মক্ষেত্র। জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ দলে দলে শহরমুখী হচ্ছে। বাড়ছে শহরাঞ্চলের জনসংখ্যা। ফলে প্রয়োজনের তাগিদে কেটে ফেলছে গাছপালা নষ্ট হচ্ছে সবুজ প্রকৃতি। খেলার মাঠ, সবুজ মাঠ, পার্ক, খোলা জায়গা পরিবর্তিত হচ্ছে ধীরে ধীরে ইট-কংক্রিটের চত্বরে, প্রকৃতি হচ্ছে বিপন্ন। ইট-কাঠের ভবনের বদলে দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে ইস্পাতের কাঠামো ও কাচে মোড়ানো বহুতল ভবন। সূর্যের আলো এ ধাতব ও কাচের কাঠামোর একটিতে পড়ে অপরটিতে প্রতিফলনের দরুন তৈরি হয় অসংখ্য হিট আইল্যান্ড বা তাপ দ্বীপ। ফলশ্রুতিতে সে নির্দিষ্ট এলাকার তাপমাত্রা আশপাশের এলাকার তুলনায় সামান্য বেড়ে যায়। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব ভবনে যদি বাগান স্থাপন করা হয়, তাহলে গাছের পৃষ্ঠদেশ এ তাপ শুষে নেয় এবং গাছের গাছের দেহ থেকে যে পানি জলীয়বাষ্প আকারে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যায়, তা সে নির্দিষ্ট স্থানের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে নিয়ে আসে। যা ছাদের বাগান বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে ঘরের তাপমাত্রা প্রায় ১.৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস করতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ন্যাপট-২-এর অর্থায়নে উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি প্রকল্পের (আইডি-১৫৩) আওতায় ছাদ বাগান নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যদিও ছাদ বাগানের কোনো নীতিমালা নেই। আশার কথা হলো, বাসাবাড়ির ছাদে বাগান করলে ১০ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স মওকুফ করার ঘোষণা দিয়েছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। যদিও নাগরিকরা পাচ্ছে না করছাড়। গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গাছপালার মাধ্যমে সবুজায়ন কর্মসূচির অংশ হিসেবে রুফ গার্ডেন সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। অবকাঠামো তৈরিতে যে পরিমাণ জমি নষ্ট হচ্ছে, তা কিছুটা পুষিয়ে নেয়া যাবে ছাদ বাগানের মাধ্যমে।

ছাদে বাগান করার সময় প্রথমেই ছাদের আয়তন অনুসারে কাগজে-কলমে খসড়া ম্যাপ করে বিভিন্ন স্থাপনা ও ভবনের কলামগুলো চিহ্নিত করে নিতে হবে। ছাদে স্থায়ী বাগান করতে হলে প্রথমেই দুই ইঞ্চি পুরু করে অতিরিক্ত একটি ঢালাই দিয়ে নেট ফিনিশিং দিতে হবে। ছাদের উপর ভবিষ্যতে আরও ছাদ দেয়ার সম্ভাবনা থাকলে স্থায়ী বেড না করে টব বা ড্রামে বাগান করাই উত্তম। বড় বা ভারি গাছগুলো ছাদের বিম বা কলামের নিকটবর্তী স্থান বরাবর স্থাপন করতে হবে। ছাদ যেন ড্যাম্প বা স্যাঁতস্যাঁতে হতে না পারে, সে জন্য রিং বা ইটের ওপর ড্রাম অথবা টবগুলো স্থাপন করলে নিচ দিয়ে আলো বাতাস চলাচল করবে এবং ছাদও ড্যাম্প হতে রক্ষা পাবে। ছোট টবের জন্য উপযোগী ফল গাছ যেমন- লেবু, ডালিম, কামরাঙ্গা, করমচা, সফেদা, মিশরীয় ডুমুর, চেরিফল, কমলা, বারোমাসি আমড়া, আতা ইত্যাদি। যা খুব সহজেই ছাদে চাষ সম্ভব। মাঝারি আকারের উপযোগী গাছ যেমন- থাই মিষ্টি তেঁতুল, পেয়ারা, জামরুল, আংগুর, বাতাবী লেবু, আম, অরবরই, আমলকি, মালটা ইত্যাদি। আর বড় টবের উপযোগী গাছ যেমন- যে কোনো কূল জাতীয় গাছ, জঁলপাই, কতবেল, বেল, বারমাসি কাঁঠাল, জাম, পেঁপে, কলা ইত্যাদি ।

ছাদে খুব অল্প পরিশ্রমে যেসব শাক-সবজির চাষ করা যায় তাহলো- করলা, টমেটো, করলা, ঢ্যাঁড়শ, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, পুঁইশাক, চালকুমড়া, কলমিশাক, মুলা, কাঁচামরিচ, ক্যাপসিকাম, ধনেপাতা, কচু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বরুকলি, গাজর, ডাটা, লালশাক ইত্যাদি। এইসব শাক-সবজির জন্য তেমন কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন পরে না। তবে নিয়মিত এবং পরিমিত পরিমাণে পানি দিতে হবে। বীজ লাগানোর আগে মাটি প্রসেসের সময় জৈব সার প্রয়োগ করতে হয়। পরবর্তী সময়ে মাঝে মাঝে মাটি কিছুটা খুঁচিয়ে সামান্য খৈল পচা পানি দিতে হবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় যে যেখানে পারি, বেশি করে সবজি চাষ করি। এ ক্ষেত্রে আনাবাদি জমিতে, পতিত জায়গায়, রাস্তার পাড়ে, পুকুরপাড়ে, নদীরপাড়ে, টিনেরচালে, বাড়ির আঙিনায়, ভাসমানপদ্ধতিতে। এছাড়া, পরিবেশ রক্ষা ও নগরীর তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে বাড়ির ছাদে, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, ফুটপাত, পার্ক, সরকারি খাস ভূমি প্রতিটি পর্যায়ে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে উদ্যান ফসল ও বাহারি ফুল গাছের সমন্বয়ে তৈরি করতে হবে সবুজ নগরায়ণ। এতে করে পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি পারিবারিক পুষ্টি, মানসিক শান্তি ও অর্থনৈতিক আয়ের উৎস হিসেবে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।