আর কত প্রাণ গেলে থামবে অসতর্কতার অগ্নিকাণ্ড?

আশিক খান, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]

প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশে অগ্নিকাণ্ড এখন মনে হয় নিত্যদিনকার ঘটনা। একেকটা অগ্নিকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই শোনা যাচ্ছে, আরেকটা ভয়াবহ বিস্ফোরণের কথা। সাম্প্রতিক সময়ে মগবাজারে ঘটা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন, নারায়ণগঞ্জের পোশাকশিল্পে অগ্নিকাণ্ড, রাজধানীর নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানে আগুন লেগে শত শত দোকান ও বই পুড়ে ছাঁই হওয়া, চট্টগ্রামের কন্টেইনার ডিপোতে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি, এর প্রত্যেকটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের অসতর্কতা, অব্যবস্থাপনা, অবহেলা এবং উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনার অভাব। অতি সম্প্রতি রাজধানীর সাইন্স ল্যাবে ঘটা অগ্নিকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা গুলিস্তান। দুর্ঘটনা মানব জীবনের নিত্যদিনকার সঙ্গী যার কিছুটা প্রাকৃতিক আর কিছু মানবসৃষ্ঠ। একদম পরিপূর্ণ দুর্ঘটনাকে এড়িয়ে সমাজ হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে অগ্নিকাণ্ডের পরিমাণ যে হারে বেড়ে চলেছে তা বেশিরভাগই সংশ্লিষ্ট মানুষের অসতর্কতা ও রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনার ফলেই ঘটছে। রাজধানীতে বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে ঘটে। রাস্তার দু’পাশে টঙের মতো গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ, হোটেল ও বিভিন্ন দোকানপাট যাতে নেই আগ্নি নির্বাপণের পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থা।

এছাড়া এগুলোর বেশিরভাগই নির্মাণে সরকারি কোনো বিধিনিষেধ মানা হয়নি। অথচ প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সামনেই চলছে এ অপরিকল্পিত অবকাঠামো। মনে হয় দেখার কেউ নেই! আবার এসব দোকানপাট, হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে অবাধে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা হয় গ্যাস সিলিন্ডার যার থেকেই সূত্রপাত হতে দেখা যায় এসব দুর্ঘটনার। নির্মাণ পরিকল্পনা না মেনেই শহরে গড়ে উঠছে ছোট বড় সব কারখানা, গার্মেন্টস শিল্প। কখনও ব্যবসায়িক প্রসারে অবকাঠামোগত সম্প্রসারণও দেখা যায়, এসব অপরিকল্পিত বহুতল ভবনের। মনে হয় কোনো এক দৈব বলে রাতারাতি গড়ে ওঠে, এসব প্রতিষ্ঠান যাতে আবার ধারণ ক্ষমতার অধিক লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়। হঠাৎ যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়, শুধু তখনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আসে বিষয়টা। বিল্ডিংগুলোতে থাকে না প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, থাকে না জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রস্থানেরও কোনো ব্যবস্থা।

তাই দ্রুততম সময়ে বের হওয়ার কোনো রাস্তা না থাকায় আটকা পড়েই মারা পড়ে বেশিরভাগ মানুষ যার উদাহরণ আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক গুলশানে আগুন, বনানীর এফআর টাওয়ার ইত্যাদি জায়গায় আগুন লাগার ঘটনাগুলোর মাধ্যমে। আবার আগুনে দগ্ধ হওয়া থেকে বাঁচতে বহু মানুষের লাফ দিয়ে পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করা আমরা দেখেছি। এগুলো কোনো নিছক ঘটনা নয় বরং বিগত কয়েক বছর ধরেই আমরা বিষয়গুলো দেখে আসছি। ঘটনাচক্রে চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী পরিস্থিতি সামাল দিতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। আর ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রের তরফ থেকে জানানো হয় সমবেদনা, কখনও বা সামান্য কিছু আর্থিক সহায়তা। তারপর? পরিস্থিতিকে ভুলে যাওয়া। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! আরেকটা মহাদুর্ঘটনা যে আসবে না, তা কে জানে! আসলে এত অব্যবস্থাপনা আর শুভঙ্করের ফাঁকির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়তি। প্রতি বছর ছোট-বড় এসব দুর্ঘটনায় দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হয়। দেশের অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়।

জনজীবনে মানুষের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রা ব্যর্থ হয়, এমনকি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডও ধোঁয়াশা ও শঙ্কায় পতিত হয়। আর এদিকে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো হয় স্বজনহারা। পুড়ে ছাই হয় সুঠাম দেহের কোনো যুবক বা তরুণী। বাবার কাঁধে ওঠে সন্তানের লাশ, বিধবা হন স্ত্রী, সন্তানহারা মায়ের আর্তচিৎকারে ভারি হয় আকাশ। জীবিকার একমাত্র অবলম্বন সন্তানকে হাড়িয়ে আহাজারি রোনাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি করে তোলেন বৃদ্ধ বাবা-মা। আবার ইদানীং দেখা যায় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে ঘটনাস্থলে অবস্থানরত মানুষের অসতর্কতাও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেয়। কেউ রাস্তা আটকে মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে, কেউ বা অযথাই ভিডিও করে আবার কেউ কেউ এমনিতেই রাস্তা আটকে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকে দেখার জন্য। আর এ অযথা ভিড়ের কারণে সঠিক সময়ে ঢুকতে পারে না ফায়ার সার্ভিস ও দমকল বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মীরা। এইতো গেল বছরেও থার্টি ফার্স্ট নাইটের আতশবাজি ও ফানুসের আগুন থেকে ঘটে গেল বড় আকারের অগ্নিকাণ্ড। এমন ঘটনাও কম নয়। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানকে ঘিরে বড় বড় নগরীর রাস্তাঘাট আলোকিত হয়ে ওঠে, সেইসঙ্গে আতসবাজি আর বড় বড় ফুলকার আগুনে ছেয়ে যায় আকাশ। আর এই আগুনের কুন্ডলি থেকে আছড়ে পরে শহরের বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারেও যদি প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা ও জনগণের তরফ থেকে সতর্কতা না আসে, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে আরও বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটা মাত্র সময়ের ব্যাপার। সময় এসেছে, ঘটনাপ্রবাহ আমাদের বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা কত বেশি! এখনি যদি এর স্থায়ী কোনো সমাধানে না যাওয়া যায়, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে দেশের চলমান উন্নয়ন ও সাধারণ মানুষের ভাগ্যরথি। সমস্যা সমাধানে নিতে হবে স্থায়ী সমাধান।

অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে। টেকসই লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করতে হবে ভবিষ্যতের সব স্থাপনা। সমূলে মূলোৎপাটন করতে হবে অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত সব স্থাপনার। প্রত্যেক গার্মেন্টস কারখানা থেকে শুরু করে অন্যন্য প্রতিষ্ঠান, অফিস, বহুতল ভবন ও জনবহুল এলাকায় নিশ্চিত করতে হবে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। এছাড়াও অগ্নিনির্বাপণে দেশের ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলারও যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। বারবার ঘটছে অগ্নিকাণ্ড।

কিন্তু দমকল বাহিনী যেন তাদের পুরোনো কিছু যন্ত্র ও ব্যবস্থা নিয়েই প্রস্তুত থেকেছে। সময় পাল্টেছে, দুর্ঘটনার মাত্রায়ও এসেছে পরিবর্তন। এখন একটা অগ্নিকাণ্ড মুহূর্তের মধ্যেই বড় আকারে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারে। বড় বড় বহুতল ভবনগুলোতে আগুন লাগলে আমরা দেখি তা ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তাহলে কি এটা বলা যায় না যে, আমাদের ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে’ দক্ষ জনবল ও প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে?

তাই আধুনিক সময়ের এ দুর্ঘটনাগুলো মোকাবিলা করার জন্য আমাদের ফায়ার সার্ভিসকে আরও উন্নত ও কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত করা এখন সময়ের দাবি। সর্বপরি সচেতন হতে হবে দেশের নাগরিক সমাজকে। অন্যথায় এভাবে শত শত নিরীহ মানুষের জীবনের মূল্য দিয়েই খেসারত দিতে হবে ভবিষ্যতের দুর্ঘটনাগুলোর।