ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

খ্যাতির নেশায় মাতোয়ারা

এ, টি, এম আবু আসাদ, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও সমাজ চিন্তক, [email protected]
খ্যাতির নেশায় মাতোয়ারা

আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্বব্যাপী একটি প্রতিযোগিতা চলছে। নিজেকে সবার কাছে পরিচিতি করানোর প্রতিযোগিতা। জীবনের যে কোনো দিকে হিরো, অপ্রতিদ্বন্দ্বী, শ্রেষ্ঠ, তুলনাহীন, কিংবদন্তি হওয়ার প্রতিযোগিতা। নিজের নাম ফোটানোর প্রতিযোগিতা। কেউ শ্রেষ্ঠ হতে চায় সম্পদে; অমুক গ্রুপের কর্ণধার, অধিপতি, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক, শ্রেষ্ঠ ধনীদের তালিকায় নাম ইত্যাদি শুনতে খুব ভালো লাগে এবং এতে সুখ বোধ করে আমাদের অনেকেই। কেউ মার্সিডিজ বেঞ্চ-পোরশে গাড়িতে চড়ে নিজেকে গর্বিত মনে করে। নাচেগানে, অভিনয়ে, শিল্পে শ্রেষ্ঠ হওয়ার প্রতিযোগিতার তো কোনো সীমা নেই। কেউ কেউ কিল-ঘুসি (বক্সিং) মারামারি করে বিশ্ব জয় করে। এটা অমানবিক ও খেলা নামের কলঙ্ক। যে কোনো কাজে শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়ে পত্রিকার শিরোনামে বা গিনিজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম উঠাতে পারলেই যেন জীবনের পরম প্রাপ্তি, পরম তৃপ্তি, পরম সফলতা। কেউ কেউ পাগলামি কাজ করেও সারা বিশ্বের কাছে পরিচিতি পেতে চায়। সবচেয়ে লম্বা নখ, সবচেয়ে লম্বা চুল, সবচেয়ে লম্বা গোঁফ ইতাদি রেখে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম উঠাতে পেরে নিজেকে হিরো মনে করে, এমন লোকের অভাব নেই বিশ্ব সমাজে। এর পেছনে তারা মেহনত ও করছে জীবনভর। কেউ আবার পোকা-মাকড়/কীটপতঙ্গ খেয়েও শ্রেষ্ঠ বনে যায়। পত্রিকার শিরোনামে দেখলাম, ‘আস্ত বিমান খেয়ে বিশ্ব রেকর্ড’। মিশেল লোটিটো নামে ফ্রান্সের এক নাগরিক লোহা-লক্কড় খেতে খেতে একসময় আস্ত বিমান পর্যন্ত খেয়েছেন। একজনের রেকর্ড আরেকজন ভেঙে আবার সংবাদের শিরোনাম হয়। আজীবন পরিশ্রম করে রেকর্ডের খাতায় নিজের নাম লেখালেন, কিছুদিন পর দেখলেন আরেকজন আপনাকে টপকে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। যে গিনিজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম লেখানোর জন্য বিশ্বময় মাতোয়ারা, সেটা শুরু হয়েছিল ১৯৫৫ খ্রি: সনে। বছর ভিত্তিতে উক্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। তাদের উদ্দেশ্য হলো ‘listing world records both of human achievements and extremes of the natural world; গিনেস বুকের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখলাম আজব কাহিনি- একজন তার হাতের ১০ আঙুলের নখ কয়েক ফুট লম্বা করে, একজন তার জিহ্বা লম্বা করে আর একজন চোখের ভ্রু কয়েক ফুট লম্বা করে রেকর্ডের খাতায় নাম লিখিয়েছে। চিন্তা করুন! এটা কি মানুষের অর্জন? যদি অর্জনই হয়- তবে এটা বিশ্ববাসীর কি উপকারে আসবে? অথচ এসব প্রতিযোগিতার পেছনে ছুটে লোকগুলো কি তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পেরেছে? লোকগুলো সুস্থ মস্তিষ্কের বলে ভাবার কোনো কারণ নেই। মানুষকে তার স্রষ্টার কথা ভুলিয়ে খ্যাতির নেশায় মাতোয়ারা করার ক্ষেত্রে গিনেস বুকের ভূমিকা অনস্বিকার্য। আসলে মিডিয়ায় প্রচার না পেলে এমন সব অবান্তর, অমানবিক, অযৌক্তিক কার্যক্রমে মানুষ নিজেকে জড়াতো না। মিডিয়ার প্রচারেই এসব কাজ করে মানুষ পুলকিত বোধ করছে। মাসের পর মাস অক্লান্ত পরিশ্রম অর্থ ব্যয় ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হিমালয়ের চূড়ায় উঠে মানুষ কি পায়? ধরুন, আপনি সাইকেল চালিয়ে বিশ্বভ্রমণ করে সংবাদের শিরোনাম হলেন, শুধু সুনাম কুড়ানোর উদ্দেশ্যে জীবনের কয়েকটা বছর ব্যয় করলেন। আপনি নামাজ-রোজা, হজ জাকাত বাদ দিয়ে, পিতামাতা, পরিবার আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীর হক আদায় না করে সাইকেলের ওপর জীবনের মূল্যবান কয়েকটি বছর কাটিয়ে দিয়ে কি পেলেন? তবে হ্যাঁ, শিক্ষার জন্য পৃথিবীময় ভ্রমণের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না, বিশেষত যুগে যুগে পৃথিবীতে আল্লাহর নাফরমানদের পরিণাম কি হয়েছিল তা প্রত্যক্ষ করার জন্য। আল কোরআনে বলা হয়েছে; ‘তারা কি পৃথিবী ভ্রমণ করে না? তাহলে দেখত, তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছিল। তারা তো শক্তিতে ছিল এদের চেয়েও শক্তিশালী’ (সুরা আল ফাতির-৪৪)। যান, আপনি যেতে চাইলে বিমানে বিশ্ব ভ্রমণ করে আসুন! কিন্তু সাইকেলে বিশ্বভ্রমণে যদি জীবনের বৃহদাংশ ব্যয় করে ফেলেন, তাহলে অন্য কাজ করবেন কখন? স্রষ্টা প্রদত্ত অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবেন কীভাবে? আসলে এখানে লক্ষ্য থাকে সংবাদের শিরোনাম হওয়া। সবকিছুর পেছনে কাজ করে খ্যাতি যশের লোভ, শ্রেষ্ঠত্ব বা সুখী হওয়ার বাসনা যা পরিশেষে মানুষকে সুখের পরিবর্তে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এসব বাসনা শুধু ব্যক্তি নয়, অনেক জাতিকেও খেয়ে ফেলছে। অহংকার আর প্রতিযোগিতার লোভের ফলে সুউচ্চ টাওয়ারে টাওয়ারে ছেয়ে যাচ্ছে বিশ্বময়; কেউ বানায় বুর্জাল খলিফা, কেউ বানায় কিংডম টাওয়ার আর কেউ বানায় টুইন টাওয়ার। এসবই কেয়ামতের লক্ষণ! আল কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেন, ‘তোমরা কি প্রত্যেক উচ্চ স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করছ, আর তোমরা বড় বড় অট্টালিকাগুলো নির্মাণ করছ, যেন তোমরা পৃথিবীতে চিরকাল থাকবে।’ (সুরা শুয়ারা-১৩০-১৩১)।

খ্যাতিপ্রিয়তার অর্থ হচ্ছে- অন্যের দৃষ্টিতে সম্মানিত হওয়া অর্থাৎ নিজের জন্য প্রত্যাশিত বিষয়টি অন্যের চিন্তার ওপর নির্ভরশীল। আরও সোজা কথায় বলতে গেলে- খ্যাতিপ্রিয়তা তথা মানুষের দৃষ্টিতে সম্মানিত হওয়ার এ বিষয়টির ওপর নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই; মানুষ যখন ইচ্ছা, তখনই মত বদলাতে পারে। তখন সব খ্যাতি ধুলোয় মিশে যাবে। অথচ খ্যাতিপ্রিয় ব্যক্তি এমন দুর্বল ভিত্তির ওপর নির্ভর করে আত্মপ্রসাদ লাভ করে যে, মানুষ আমাকে ভালো জানে, শ্রেষ্ঠ জানে। যেমন ইঁদুর এই ভেবে আনন্দিত হয় যে, বণিকের দোকানে আমার জন্য খাদ্য এসেছে। কিন্তু একটু অগ্রসর হয়েই সে যখন পেতে রাখা ফাঁদে পড়ে, তখন সব আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়।

ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের লেখা, নিজের কর্মকাণ্ডের একটু লাইক বা প্রচার পাওয়া বা ভাইরাল করার মাধ্যমে একটু প্রশংসা পাওয়ার আশায় কি সব আজব কাজকর্মে জড়িত হচ্ছেন আমাদের সন্তানরা এমনকি আমরা নিজেরাও ! জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করছি প্রতিনিয়ত! আমরা এখন ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করছি না ভালো মানুষ হতে, খোদাভীরু হতে, দানশীল হতে। আমাদের সন্তানদের নবী ও সাহাবাদের জীবনী পড়াই না, হাজী মোহাম্মদ মহসিনের জীবনীও পড়াই না, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতো জ্ঞানতাপস হতেও উৎসাহ দেই না।

প্রতিযোগিতা অবশ্যই হতে হবে ভালো কাজের জন্য, যে কাজে মুক্তি মিলবে ইহকাল-পরকালে। ভালো কাজের প্রতিযোগিতার আহ্বান জানানো হয়েছে সুরা মায়িদার-৪৮, সুরা আম্বিয়ার-৯০ নং আয়াত ছাড়াও আল কোরআনের বিভিন্ন স্থানে। আল কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আরও বলেন, ‘যাকে তার মন্দকর্ম শোভনীয় করে দেখানো হয়, সে সেটাকে উত্তম মনে করে।’ (সুরা আল ফাতির-৮)। বর্তমানে মন্দ কাজগুলোকে শোভনীয় করে দেখানোর প্রচারণা ভয়ংকর রূপ ধারন করেছে। ফলে মানুষ খ্যাতির অন্বেষায় অলিক কল্পনার জগতে উড়ে বেড়াচ্ছে। হজরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা সেই সব কাজের লোভ করো, যেগুলো তোমাদের জন্য উপকারী।’ সাধারণ অবস্থায় লোভ একটি খারাপ এবং তা থেকে বারণ করা হয়েছে। সম্পদের লোভ, যশ-খ্যাতির মোহ মানুষকে পেয়ে বসেছে, স্রষ্টার কথা ভুলিয়ে তাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

আরেক হাদিসে রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আদম সন্তানের অবস্থা হলো এই, যদি একটি সোনার উপত্যকা পেয়ে যায়, তাহলে সে চাইবে আরও একটি পেতে। এভাবে তার চাহিদা বাড়তেই থাকে। আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া আর কিছুতে ভরতে পারে না। যখন কবরে যাবে, তখন কবরের মাটি তার পেট ভরে দেবে (বোখারি-৫৯৫৩, মুসলিম-১৭৩৯)। স্মরণ করুন! ‘প্রতিটি জীবন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে এবং কেয়ামতের দিন তোমাদের পূর্ণমাত্রায় বিনিময় দেয়া হবে। যে ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করা হলো এবং জান্নাতে দাখিল করা হলো, অবশ্যই সে ব্যক্তি সফলকাম হলো। কেননা, পার্থিব জীবন ছলনার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (সুরা আল ইমরান-১৮৫)।

অবশেষে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সুখী হওয়ার উপায় নিয়ে বক্তব্যের অংশবিশেষ উল্লেখ করে এ লেখার ইতি টানছি।

‘এখন প্রতিযোগিতার হাতে পড়ে মানুষ শুধু অসুস্থের মতো ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটছে। থামার উপায় নেই। দুই দুগুনে চার। চার দুগুনে আট। আট দুগুনে ষোলো, বত্রিশ, চৌষট্টি। এর শেষ নেই, এ থেকে মুক্তি নেই। সুখী হতে হলে কী শুধু চাই চাই করলে চলবে? সুখী হওয়ার উপায় একটাই; থামা. প্রত্যাখ্যান করা। সুখী হতে হলে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করতে শিখতে হবে। তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে কতটুকু তোমার দরকার যার পরে তোমার আর চাওয়া নেই। অন্যদের দিকে তাকালে তুমি দুঃখি হয়ে যাবে, তাই ওটা চলবে না, তাকাতে হবে নিজের দিকে, নিজের ইচ্ছা-খুশির দিকে। তখন তোমার মন শান্ত ও সুস্থির হবে। কাঁচা রোদের ভেতর প্রকৃতির মাঝখানে যেয়ে বলতে হবে, এই গাছের নিচে বসে নীল-আকাশের রূপ দেখে আমার মন খুশি হয়ে আছে। আমি আর কিছুই চাই না।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত