ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

তোমার মাঝে বসত করে কয়জনা

ড. মো. শওকত হোসেন, অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
তোমার মাঝে বসত করে কয়জনা

গ্রিক পুরাণে বিচিত্ররূপী ভয়ংকর কিছু দানবের উল্লেখ আছে। কারও মাথা একাধিক, কারও দেহে বিভিন্ন রকম প্রাণীর সংযুক্ত অবয়ব, কারও কণ্ঠ ভয়ংকর ইত্যাদি। এসব প্রাণীর বাহ্যিক রূপ যেমন ভয়ংকর, তেমনি তাদের কর্মকাণ্ডেরও ভয়াবহ বর্ণনা রয়েছে এইসব হেলেনিক কল্প-কাহিনিতে। দার্শনিক প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে এরকম কিছু দানবের উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে একটি হলো কিমেরা (chimaera), যার দেহের একাংশ সিংহের মতো, অন্য অংশ ছাগল এবং বাকি অংশ সাপের মতো। আবার তিন মু-ধারী এক দানব আছে যার নাম ‘সারবেরাস’ (cerberus)। এছাড়া রয়েছে সিলা (scylla) নামক এক ধরনের সমুদ্র-দানব যার মাথা ছয়টি। বাহ্যিক ভয়াবহ রূপের মাধ্যমেই তাদের কর্মকাণ্ড বা চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটি ধারণা করা যেতে পারে।

কল্প-কাহিনির এসব দানবের সঙ্গে প্লেটো আর একটু কল্পনা জুড়ে দিয়ে আমাদের এমন এক বিচিত্ররূপ বহুমুণ্ডুধারী জীবের কথা কল্পনা করতে বলেন, যার সারাদেহে বিভিন্ন ধরনের জীব-জন্তুর মাথা। এদের মধ্যে ভয়ংকর স্বভাবের জন্তুর কাঠামো বা মুণ্ডু যেমন রয়েছে, তেমনি অপেক্ষাকৃত শান্ত প্রকৃতির জীবের অংশও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কেবল তাই নয়, বিভিন্ন জীব-জন্তুর এই মুণ্ডু বা কাঠামো ওই কল্পিত দানব ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়াতে কমাতেও পারে, এমনকি ভিন্নরূপও ধারণ করতে তারা সক্ষম। এ পর্যায়ে এই ভয়ংকর কল্প-দানবের সঙ্গে তিনি আবশ্যিকভাবে যুক্ত করতে বলেন আর দুটি প্রাণীর কিছু আকৃতি। এর একটি হলো সিংহ এবং অপরটি হচ্ছে মানুষ। অর্থাৎ এবার যে দানব কল্পিত হলো তার কাঠামোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, একটি অংশ বহুমুণ্ডুধারী পশু, অন্য অংশ সাহসী সিংহ এবং বাকি অংশ বুদ্ধিমান মানুষ। এ পর্যায়ে প্লেটো আমাদের ভাবতে বলছেন যে, ওই তিনটি অংশের পুরোটাকেই মানুষ আকৃতির একটি খোলস দিয়ে আচ্ছাদিত করে দিতে হবে- যাতে একটি মানব-সত্তায় পরিণত হয়। অর্থাৎ বাইরের খোলস বা রূপটি মানুষের হলেও ভেতরে পুরোটা মানুষ নয়, তার মধ্যে সিংহ আছে, আর আছে বিচিত্র রকমের বন্য পশুর সমাহার। তাহলে বিষয়টি এমন হবে যে, আমরা বাহ্যিক দৃষ্টিতে ওই অদ্ভুত বহু-জীব সত্তাটিকে একক কোনো মানব-সত্তা রূপেই মনে করব। তার ভেতরের বহু সত্তার রূপ আমাদের কাছে হয়তো স্পষ্ট হবে না।

এবার আসুন এই সব বহু-সত্তাধারী আপাত মানুষ রূপে এক একজন মানুষ সমাজে কীভাবে পরিচিত হবে, আমরা তাদের কীভাবে চিনব, তাদের সঙ্গে আমাদের আচরণই বা কী হবে, এসব প্রসঙ্গে। তবে তার আগে বলে রাখা ভালো যে, প্লেটো কিন্তু আমাদের প্রত্যেককে এমন বহু-সত্তার সমন্বয় রূপেই কল্পনা করতে বলেছেন এবং মজার কথা হলো এটাকে তিনি মন্দ বলে মনে না করে স্বাভাবিক বলেছেন। অর্থাৎ আমাদের ভাবতে বলছেন যে, আমরা প্রত্যেকেই আমাদের বাহ্যিক খোলসের অন্তরালে ভয়ংকর সব বন্য সত্তা ধারণ করে চলছি। কিন্তু প্লেটোর কাছে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, তাহলে কি আমরা সবাই মানুষরূপী ভয়ংকর দানব? উত্তরে প্লেটো বলছেন ‘না, সকলে নয়, কিন্তু প্রত্যেকেরই স্বল্প থেকে শুরু করে ব্যাপক পরিমাণে ভয়ংকর পশু প্রবৃত্তির হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ভালো হওয়ার বা প্রকৃত মানব সত্তার মর্যাদা নিয়েও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পথ আছে বলে তিনি মনে করেন।

এতক্ষণ যে সব রূপক কথা বলা হলো তার অন্তরালে রয়েছে প্লেটোর ন্যায়ধর্ম (justice) রূপী সদগুণ (virtue) প্রতিষ্ঠা ও চর্চার জন্য জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতির জন্য একটি স্লোগানকে সামনে রেখেছেন তিনি, তা হলো ‘সদগুণ হলো জ্ঞান’ (virtue is knowledge)। আমাদের প্রথমেই জ্ঞান লাভ করতে হবে নিজের সম্পর্কে। নিজের মধ্যে যে আত্মা (soul) বিরাজ করছে তার রয়েছে তিনটি অংশ। একটি অংশ কামনা-আত্মা (appetite soul) যার মধ্যে হরেক রকম এমনকি ভয়ংকর প্রকারের বন্য-পশুর বাসনা বিরাজ করে। আছে একটি করে সিংহ যে সাহস-আত্মার (spirited soul) প্রতিনিধিত্ব করে। আবার একটি অংশ রয়েছে জ্ঞান-বুদ্ধি প্রজ্ঞার ধারক তথা প্রজ্ঞা-আত্মা (wisdom soul)। এই শেষোক্ত অংশটিই হলো প্রকৃত মানবসত্তার সত্যিকারের নিজস্ব চরিত্র, তার বিভেদক লক্ষণ- যে লক্ষণের দ্বারা অমানব সত্তা থেকে মানুষকে আলাদা করা যায়।

বহু সত্তার ধারক আমরা সব সময়ই থাকি। নিজের মধ্যে পশুগুলোকে সর্বদাই আমরা পুষে রাখতে বাধ্য হই। কিন্তু এসব পশুকে বসে রাখা বা নিষ্ক্রিয় করে রাখাটাই জরুরি। আমরা আমাদের মাঝে বাস করা পশুগুলোকে যদি খাবার না দিই, তাহলে তা ক্রমেই নির্জীব হয়ে পড়বে, বেঁচে থাকলেও কর্মক্ষম (active) থাকবে না। এমনকি, কোনো কোনো পশু একেবারেই মরে যাবে। যে পশুগুলো একটু অবাধ্য হবে তার ওপর লেলিয়ে দিতে হবে আমাদের পালিত সিংহটিকে। আবার সিংহটিও তার নিজের পশুবৃত্তির মন্দ ব্যবহার যাতে না করে, কোনো কিছুর ওপর অজাচিত হামলা না করে তার জন্য আত্মায় বিরাজমান প্রকৃত মানবসত্তাটি অর্থাৎ প্রজ্ঞা-আত্মাকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। আমাদের মধ্যে তিন রকম সত্তার কোন অংশকে আমরা বেশি শক্তিশালী করে তুলব, তাও নির্ভর করে আমাদের প্রজ্ঞার সিদ্ধান্তের ওপর। কিন্তু সমস্যা হলো পশুগুলোকে নিয়ে; এগুলো দমন করা বেশ কঠিন। বরং এগুলো যেসব খাবার-খোরাক চায় সেগুলো দিয়ে এদের পুষে রাখাই অনেকের কাছে সহজ; এমনকি মজার বলে মনে হয়। কিন্তু ভয়ংকর পশুগুলো শক্তিশালী করার ফল বড়ই মারাত্মক। এরা একসময় মানুষের মূল সত্তাকেই, তার প্রভুকেই খেয়ে ফেলে- ধ্বংস করে দেয়। আমাদের আত্মার প্রজ্ঞাময় অংশকে যদি প্রভুত্বের আসনে সর্বদা আসীন রাখা যায়, তাহলে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। আর এর মধ্যে রয়েছে এক মহা বিজয়ের আনন্দ। এক মহা জিহাদে জয়ী হয়ে গাজী হওয়ার মর্যাদা। জীতেদ্রীয় হওয়ার গৌরব। এই বিজয়ী মানব উচ্চতর মানব, গড়পড়তা মানুষ নয়।

আমরা যে সমাজে বাস করি, সেখানে চারদিকে গিজগিজ করছে অনেক গড়পড়তা মানুষ- যাদের অনেকের মধ্যে জোরালো হয়ে বসত করছে বিচিত্র ও ভয়ংকর অনেক পশু। মানব শরীরের খোলসে এবং তার ওপর বৈচিত্র্যময় পেশাকে সেগুলো আড়াল করে রেখে ‘মানুষ’ পরিচয় ব্যবহার করে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং অতর্কিতে অনেক সত্যিকার মানুষের ওপর তারা পশুর মতো আক্রমণ চালাচ্ছে।

এখন কথা হলো, এদের চিনব কীভাবে? চেনা বেশি কঠিন বিষয় নয়। চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছেন যে, ‘মানুষ তার দেহকে পোশাক দিয়ে আচ্ছাদিত করতে পারে ঠিকই; কিন্তু তার চরিত্রকে বা স্বভাবকে কখনও ঢেকে রাখতে পারে না।’ আপনার সঙ্গে, অন্য মানুষের সঙ্গে কে কেমন আচরণ করছে তা একটু খেয়াল করুন। তাদের আলাপের বা আগ্রহের বিষয়ই বা কী কী- তা একটু লক্ষ করুন। কেউ যদি অন্যের ওপর প্রায়ই অশালীনভাবে আক্রমনাত্মক হয়- তাহলে বুঝতে হবে তার ভেতরের হায়েনা বা ওই জাতীয় জীবকে সে ভালোই লালন-পালন করছে। কেউ যদি প্রায়সই চালাকি করে, কূট-কৌশল করে আপনাকে বা অন্যকে ঘায়েল করতে চায়, তাহলে ধরে নেবেন ওই ব্যক্তি তার ভেতরকার শেয়াল বা তৎসদৃশ পশুকে বেশ ইন্ধন দিচ্ছে। এমনকি, বেশ সদালাপের সময়ও প্রায়ই যাদের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে অর্থ-সম্পদ, জায়গা-জমি, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি। তাহলে ধরে নিতে পারেন বা অন্তত সন্দেহ করতে পারেন যে, তাদের মনোপালিত অনেক ছাগল, হাঁস-মুরগি অথবা শূকরকে তারা ভালোই পরিচর্যা করে চলছে। পক্ষান্তরে, যারা আপনার সঙ্গে দায়িত্ব-কর্তব্য, পেশাগত উন্নতি, জনকল্যাণ, জ্ঞান, সত্য, সুন্দর, শিল্প-সৃজন ইত্যাদি মহৎ বিষয় নিয়েই বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছেন এবং তাদের প্রাত্যহিক জীবনে সদাচারণ মহৎ কাজ ও মানবতার জন্য কিছু সৃজন করে চলছেন বা চেষ্টা করছেন, তাদের প্রকৃত মানব, আদর্শ মানব বা খাঁটি মানব হিসেবে মনে করার বিষয়ে আপনি এগিয়ে রাখতে পারেন।

তবে অন্যের প্রতি এই অনুসন্ধিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে, এমনকি, এসবের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়ার আগে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত নিজের প্রকৃতি সম্পর্কে জানা। কেননা স্মরণ রাখতে হবে যে, বেশ কিছু দানবীয় সত্তা বা পশুপ্রবণতা কিন্তু নিজের মধ্যেও বিরাজমান। এগুলোকে ছাপিয়ে আমাদের মনাবসত্তা তথা বুদ্ধিময় বা প্রজ্ঞাময় সত্তাকে নেতৃত্বের স্থানে টিকিয়ে রাখতে হবে। অনেক ধর্মগুরুর মতো প্লেটো মানব আত্মার এই প্রজ্ঞাময় অংশকে দৈবসত্তা হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। আর এর দ্বারা পরিচালিত না হলে আমাদের ভেতরের দানবীয় সত্তা মানবীয় সত্তাকে সর্বদা ছিনিয়ে নেবে। আসুন, এ জন্য প্রত্যেকেই ঘরের খবর আগে নিই। খুঁজে দেখি নিজের মধ্যে কী বিরাজ করছে, কীভাবে বিরাজ করছে।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত