আন্তর্জাতিক ভোক্তা অধিকার দিবস

ক্রেতা অধিকার ও নিরাপত্তা

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত

প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ক্রেতা অধিকার ও নিরাপত্তা একটি মানবাধিকার : অর্থনীতির ভাষায় যিনি অর্থ বা কোনো কিছুর বিনিময়ে নিজের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, তাকেই ক্রেতা বলা হয়। বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারার এ পণ্য বা সেবা ক্রেতার সামনে এমনভাবে VISUALIZE করা হয়, যা তার সপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে তথা তার পঞ্চইন্দ্রীয়কে দ্রাক্ষা লতার মতো গ্রাস করে ফেলে, যা তিনি নিজে ও অনুভব করতে পারেন না। ক্রেতার এ অনুভব করতে না পারার অবকাশটাই বর্তমান বিশ্বের বাজার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। বস্তুত এখানেই ক্রেতার নিজস্ব সত্তার পরাজয় ঘটে এবং পণ্যের স্বপ্নিল হাতছানিতে অবচেতন মনে এগিয়ে যান পণ্যটি হাতে তুলে নিতে। এক্ষেত্রে ক্রেতার ব্যক্তি মননশীল ভাবনায় দুটি ব্যাপার ঘটে যায়। একটি হচ্ছে তিনি স্বাধীনভাবে নির্দিষ্ট পণ্যটি ক্রয় করার ভাবনা বা বিশ্বাস নিজের ওপর আর রাখতে পারেন না। অন্য কোনো মাধ্যম বা MEANS-এর ওপর অবচেতনভাবে তা ছেড়ে দেন। অপরটি হচ্ছে, ব্যক্তি হিসেবে ক্রয় করতে গিয়ে এ পণ্যটি সম্পর্কে যাচিত কিছু প্রশ্ন তিনি যে করতে পারেন এবং করার যে অধিকার আছে, তা তিনি ভুলে যান এবং ভুলতে তা এক পর্যায়ে মনের অচেতনে হারিয়ে যায়। এর ফলে ক্রেতা যে পণ্য বা সেবাটি ক্রয় করছেন বা ভোগ করছেন, তার ঝুঁকি সম্পর্কে যা তার স্বাস্থ্য ও জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে তা তিনি আর বুঝতে পারেন না। এখানেই পণ্য ক্রয়ের পাশাপাশি জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নটি জড়িত হয়ে পড়ে।

তীব্র প্রতিযোগিতাই হচ্ছে বাজারে টিকে থাকার একমাত্র উপায়। এ প্রতিযোগিতার একমাত্র টার্গেট হচ্ছেন ক্রেতা। বাজারে কোনো পণ্যসামগ্রী নতুন আগমন প্রাক্কালে বা আগমন এরই মধ্যে ঘটলে, সে পণ্য অধিক হারে বিক্রি করার লক্ষ্যে MARKET PROMOTION নামে একটি বাজার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। সে প্রক্রিয়ায় ক্রেতাকে করা হয় টার্গেট। ক্রেতার চাহিদা, পছন্দ, স্বাদ, অনুভূতি, শিক্ষা, পেশা, বয়স, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ এগুলোকে বিবেচনা করে, সে পণ্যের বাজার PROMOTE করা হয়। যাতে বাজারে ক্রেতা প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সে পণ্যটি লুফে নেন। এ ক্ষেত্রে ক্রেতার শ্রেণি বিভাজনও করা হয়। যেমন- উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, শিশু, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী ও প্রৌঢ় প্রত্যেককে টার্গেট করেই MARKET PROMOTION STRATEGY ঠিক করা হয়।

এ STRATEGY-এর ফাঁদে ব্যাপারটি এমনভাবে ঘটে, ক্রেতা টেরও পান না যে, তিনি এ খোলা বাজারে স্বাধীনভাবে প্রবেশ করে নিজেও পরোক্ষভাবে একটি পণ্য হয়ে গেছেন। অর্থাৎ সরল কথায় তিনি নিজেও বিক্রি হয়ে গেছেন। বস্তুত ক্রেতা বাজারে প্রবেশ না করে ঘরে বসে থাকলেও একটি পণ্যের প্রতি তার আকর্ষণ বা চাহিদা তৈরি হয়ে যেতে পারে। বর্তমান সাইবার নেট বা মাল্টি-মিডিয়ার যুগে একজন ক্রেতা ঘরে বসেই বাজারের পণ্যটি কিনে ফেলেন। আমাদের মতো দেশে যেখানে শিক্ষার হার অত্যধিক নিচু ও সচেতনতার অভাব তীব্র সেখানে পণ্য ক্রয়ের ঝুঁকি অনেক বেশি। এমনও দেখা যায়, উন্নত বিশ্ব তাদের দেশে নিষিদ্ধ ও বাতিলকৃত অনেক ওষুধ ও ভোগ্যপণ্য সে দেশের সচেতন মানুষের আন্দোলনের কাছে বাধাগ্রস্ত হয়ে আমাদের মতো দেশে রপ্তানি করে দেয়। এ ক্ষেত্রে এমন সব ভোগ্য পণ্যও এখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আসে যা ক্রেতার সমগ্র জীবনচক্র বা LIFE CYCLE-কে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করার সম্ভাবনা থাকে। দরিদ্র থেকে যেখানে শিক্ষার হার অত্যধিক কম সেখানে ক্রেতাকে তার ক্রয়কৃত বস্তু বা পণ্যটির সুবিধা ও অসুবিধাজনিত তথ্যগুলো বিষদ জানানো হয় না।

ক্রেতা অধিকার আন্দোলনের উৎপত্তি : ক্রেতা অধিকার আন্দোলন সর্বপ্রথম শুরু হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শিল্প এলাকায়। এখানে একটি অটোকারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তাজনিত অধিকার স্থাপনে সরকারি নীতিমালা প্রণয়নে চাপ সৃষ্টিকল্পে এ আন্দোলনে তীব্র আকার ধারন করে। পরবর্তী সময়ে জন এফ কেনেডি প্রশাসন ক্রেতা অধিকার ও নিরাপত্তাজনিত ৪টি নীতিমালা প্রণয়ন করেন। নীতিমালাগুলো হচ্ছে- ১. ক্রেতার নিরাপত্তার অধিকার। ২. ক্রেতার তথ্য জানার অধিকার। ৩. ক্রেতা নিজ পছন্দ প্রকাশের অধিকার। ৪. ক্রেতার কণ্ঠ অধিকার বা RIGHT OF VOICE.

মূলত উপরোক্ত ৪টি বিষয়কে কেন্দ্র করেই পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে ক্রেতা আন্দোলনের জোয়ার গড়ে ওঠে। তবে আমাদের মতো দেশে এ আন্দোলন এখনও বিশাল ক্রেতা সাধারণের মাঝে তেমন কোনো জোয়ার সৃষ্টি করতে পারেনি।

বাংলাদেশে বেসরকারি ও অলাভজনক সংস্থার সমন্বয়ে CONSUMERS নামক একটি প্রতিষ্ঠান ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক ক্রেতা অধিকারগুলো সম্পর্কে সাধারণ ক্রেতা শ্রেণির মাঝে শিক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টি ও ক্রেতা অধিকার আন্দোলন গড়ে তোলাই এ প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য। এছাড়া ক্রেতা সাধারণের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানেও এটি সচেষ্ট রয়েছে। এ উদ্দেশ্যে এ প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন স্থানে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় ফোরাম, কর্মশালা ও সভা-সম্মেলনের আয়োজনও করে থাকে।

ক্রেতার নিরাপত্তা : এটি হচ্ছে পণ্য ক্রয়জনিত কারণে ক্রেতার স্বাস্থ্য ও জীবন যাতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে না পড়ে, তার ব্যবস্থা নেয়া। এ অধিকার বাংলাদেশে তীব্রভাবে অবহেলিত। ফলে জনস্বাস্থ্য দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে।

মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার : জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হলে তার ক্রয় ক্ষমতা কখনও বৃদ্ধি পাবে না এবং এ ক্ষেত্রে ক্রেতা অধিকার আন্দোলন জোড়দার হতে পারবে না, তাই মৌলিক চাহিদা পূরণ এ আন্দোলনের একটি পূর্ব শর্ত।

পণ্য সম্পর্কিত তথ্য অবগত হওয়ার অধিকার : উৎপাদিত যে কোনো পণ্য কি উপাদানে তৈরি এবং তা মানবদেহে কী কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, পাশাপাশি তা কীভাবে এড়ানো যায়, তা জানার অধিকার রয়েছে ক্রেতার।

ক্রেতার পণ্য পছন্দ করার অধিকার : ক্রেতার স্বাধীনতা রয়েছে যে, তার চাহিদা বিচার বিশ্লেষণ করে পণ্য যাচাই করা ও পছন্দ অনুসারে তা ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়া। ক্রেতার কণ্ঠ অধিকার RIGHT ক্রয়কৃত পণ্য ক্রেতার যদি কোনো ক্ষতি করে থাকে বা অন্য কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করে, তবে পণ্য উৎপাদন করা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে তার প্রতিবাদ বা অভিযোগ শুনতে হবে। সে পরিপ্রেক্ষিতে পদক্ষেপও নিতে হবে। এটা মূলত ক্রেতার অধিকার।

পণ্য সম্পর্কিত মতৈক্য পৌঁছার অধিকার : ক্রয়কৃত পণ্য সম্পর্কিত যদি কোনো অভিযোগ ক্রেতার থাকে, তবে তা বিক্রেতা ও ক্রেতার মতামত বিনিময় করে একটি সুব্যবস্থা ক্রেতাকে করে দেয়ার প্রক্রিয়া থাকতে হবে। যাতে ক্রেতার অসন্তুষ্টি লাঘব হয়।

স্বাস্থ্যকর পরিবেশ : পণ্য শিল্প ও পণ্য উৎপাদন এখন বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ছে। পরিবেশের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ক্রেতা অধিকার ক্ষেত্রে ও এ কথা হচ্ছে যে, পণ্য ও পণ্য বাজার ব্যবস্থা এমন হতে হবে যে, যেখানে পরিবেশগত কারণে ক্রেতার স্বাস্থ্য ও গুণগত জীবনের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।

ক্রেতা শিক্ষা সচেতনতা সৃষ্টির অধিকার : পণ্য দ্রব্য যাচাই ও চাহিদা অনুসারে ক্রয় করার দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনে ক্রেতার শিক্ষা অর্জন ও সচেতন হওয়া, এটা ক্রেতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার বলে বর্তমানে বিবেচিত।

ভবিষ্যৎ করণীয়, ক্রেতা সংগঠন : ক্রেতা সাধারণকে আন্দোলনে শরিক করার জন্য প্রয়োজন তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে তাদের অংশগ্রহণে প্রয়োজন এলাকাভিত্তিক সংগঠন নির্মাণ। যার উদ্দেশ্যে হবে ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণ করা ও অধিকার আদায়ে তৎপর থাকা। এ সংগঠন বাজার দর ও ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতাও মনিটর করবে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে অবগত করার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।

ক্রেতা সচেতনতা ও শিক্ষা : ক্রেতা অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ক্রেতা সাধারণকে সচেতন করার প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও কার্যকলাপের মাধ্যমে SOCIAL CAMPAIGN শুরু করতে হবে। পাশাপাশি এ সম্পর্কিত সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন ও ব্যস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে POLICY ADVOCACY করতে হবে। দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযোগ কেন্দ্র খোলা যেখানে ক্রেতা সাধারণ তাদের মতামত দানে উদ্বুদ্ধ হবে। এছাড়াও এসব কেন্দ্রের বিভিন্ন অভিযোগের আলোকে ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতা সাধারণকে আইনগত সহযোগিতাও দেয়া যেতে পারে।

পরিবেশ সংরক্ষণ কর্মসূচি : আমাদের মতো দেশে এমন সব পণ্য আমদানি করা হয়, যা পরিবেশের জন্য এক বিরাট হুমকি। DIRTY DOZEN নামক যে ১২টি মারাত্মক কীটনামক ওষুধ আমাদেরও দেশে একসময় ব্যবহার হতো তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। আন্দোলনের মাধ্যমে এসব দ্রব্যসামগ্রী আমদানি রোধে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

উপসংহারে আমরা বলতে পারি যে, ক্রেতা অধিকার ও নিরাপত্তা একটি সামাজিক আন্দোলন, যার মাধ্যমে VOICE OF CONSUMERS সোচ্চার হয়ে উঠবে। ‘অধিক লাভ অধিক মুনাফা’ বিশ্ব বাণিজ্যকীকায়নের এ স্লোগানের তোড়ে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের ক্রেতা সাধারণ বর্তমানে বাণিজ্য শিকারে পরিণত হয়েছে এবং এটা ক্রেতা সমাজের অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য এক বড় রকমের হুমকি। তাই সামাজিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সুশীল সমাজ তথা সাধারণ মানুষ সবার অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।