ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির ২০০ বছরপূর্তি

এশিয়াটিক সোসাইটি ও এশিয়ার পুনর্জাগরণ

ড. মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, মিরপুর কলেজ, [email protected]
এশিয়াটিক সোসাইটি ও এশিয়ার পুনর্জাগরণ

সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি স্পেন ষোড়শ শতকে ব্রাজিল বাদে সমগ্র লাতিন আমেরিকায় প্রভুত্ব স্থাপন করে। দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ফ্রান্স কবজা করে নেয় প্রায় সমগ্র আফ্রিকা। সতেরো-আঠারো শতকে উত্তর আমেরিকায় কয়েকটি যুদ্ধে ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ডকে পরাজিত করে ইংল্যান্ড হয়ে যায় প্রথম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, ফ্রান্স থেকে যায় দ্বিতীয় সারিতে। তবে ফ্রান্সের সহযোগিতায় আমেরিকা স্বাধীনতা লাভের পর পরাজিত ইংল্যান্ড তার ঔপনিবেশিক দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আসে এশিয়ায়। পরাজিত সেনানায়ক ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতে গড়ে তোলে বৃহৎ সাম্রাজ্য- নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে হয়ে ওঠেন ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথম গভর্নর জেনারেল তার শাসনামলে (১৭৭৩-১৭৮৫) ইংরেজ সিভিলিয়ানদের ভারতীয় ভাষা ও রীতিনীতি শিক্ষায় গুরুত্ব দেন। হুগলিতে স্থাপিত মুদ্রণযন্ত্র থেকে ১৭৭৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের এ গ্রামার অব বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ। ১৭৮০ সালে বেরোয় ইংরেজি সাপ্তাহিক হিকি’জ বেঙ্গল গেজেট। ইউলিয়াম জোনস ১৭৮৪ সালে সর্বপ্রথম কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন এশিয়াটিক সোসাইটি।

উইলিয়াম ক্যারির ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৯২ সালে। চার্টার অ্যাক্ট ১৮১৩-এর বলে ব্রিটিশরাজ ভারতে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তার ও খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করে। তারই অংশ হিসাবে গ্রন্থ প্রকাশের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি (১৮১৭)। এসময়ে ব্যতিক্রমী ইংলিশ প্রাচ্যবিদ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন হেনরি টমাস কোলব্রুক- যিনি তার পিতা স্যার জর্জ কোলব্রুকের উৎসাহে কলকাতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেন ১৭৮২ সালে; কিন্তু ১৭৯১ সালে বাংলার বাণিজ্যের ওপর গ্রন্থ প্রকাশের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একনায়কত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। কোম্পানির সঙ্গে নয়, ইংল্যান্ডের সঙ্গে ভারতের সরাসরি বাণিজ্যের পক্ষে মতপ্রকাশ করতে থাকেন। সংস্কৃত ভাষায় কৃতবিদ্য হয়ে ১৮০৫ সালে প্রকাশ করেন ‘সংস্কৃত ব্যাকরণ’ এবং ‘বেদ বিষয়ক প্রবন্ধাবলি’। ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগে ১৮০৫-১৮১৫ সালে হিন্দু কলেজে অনারারি অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য ও কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি হিসেবে।

ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পর এশিয়াটিক সোসাইটির সম্প্রসারণের বিষয়ে মনোনিবেশ করেন। রাজা চতুর্থ জর্জের অনুমতি নিয়ে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৮২৩ সালের ১৫ মার্চ। ১৮২৯ সালে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বোম্বে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু হয় রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সম্প্রসারিত কার্যক্রম। ১৯৩০ সালে মাদ্রাজ লিটারারি সোসাইটি তার সহযোগী সংগঠনে পরিণত হয়। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১৮৩২ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির নামকরণ করা হয় এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল। কোলব্রুক (১৭৬৫-১৮৩৭) আমৃত্যু রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। আঠারো শতকের শেষার্ধে উইলিয়াম জোন্স প্রতিষ্ঠা করেন এশিয়াটিক সোসাইটি, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বোম্বে ও মাদ্রাজে সম্প্রসারণ করে হয়ে ওঠেন ‘দ্বিতীয় অধ্যায়ের উইলিয়াম জোন্স’।

তার জীবদ্দশায় সোসাইটি বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে বোম্বে ও মাদ্রাজে সম্প্রসারিত হয়। তার মৃত্যুর পর ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবিস্তারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে এশিয়াটিক সোসাইটি। এশিয়াটিক সোসাইটি গড়ে ওঠে সমুদ্রবাণিজ্যের পথ ধরে বাণিজ্য বন্দর গড়ে ওঠার সমান্তরাল রেখায়। প্রথম আফিম যুদ্ধের (১৮৩৯-১৮৪২) পর যুগান্তকারী সম্প্রসারণের সূচনা হয়। ১৮৪৭ সালে দক্ষিণ চীনে গড়ে তোলা হয় রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব হংকং এবং উত্তর চীনের সাংহাইয়ে ১৮৫৭ সালে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব চায়না। কলম্বোতে ১৮৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব শ্রীলঙ্কা, ১৮৭৮ সালে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব মালয়েশিয়া। দূরপ্রাচ্যের দেশ জাপানে প্রথম এ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ১৮৭২ সালে, মেইজি শাসনামলে। যে সময় আধুনিক জাপান মহাশক্তিধর দেশ হিসেবে গড়ে ওঠে পাশ্চাত্য প্রভাবে। কোরিয়ার সিউলে সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০০ সালের ১৬ জুন। ভারত থেকে জাপান যাওয়ার প্রবেশপথে গড়ে ওঠে এসব সোসাইটি। তখনকার দিনে বোম্বে থেকে যাত্রা শুরু করে সিঙ্গাপুর থেকে চীন সাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হত হংকং; সেখান থেকে জাপান হয়ে আমেরিকা।

সমুদ্রবাণিজ্য ও বন্দর প্রতিষ্ঠা যেন সবুজ সংকেত, সবুজ সংকেত জ্বলে ওঠার পরই স্থাপিত হতে থাকে এশিয়াটিক সোসাইটির স্থানীয় শাখা। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাণপ্রদীপ নিভে যেতে থাকে। দেশভাগের চার বছর পর ১৯৫১ সালের ১ জুলাই কলকাতার একটি ভবনে সোসাইটি পুনর্জীবিত করে তার নামকরণ করা হয় এশিয়াটিক সোসাইটি। ব্রিটিশ আমলে যার নাম ছিল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল। দেশভাগের পাঁচ বছর পর ১৯৫২ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে তার নামকরণ করা হয় এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান। ১৯৪৫-১৯৪৯ পর্বে চীনে কম্যুনিস্ট বিপ্লব চলার সময় পাশ্চাত্য তাদের উপনিবেশ ভারত মহাসাগরীয় এলাকা থেকে গুটিয়ে নিয়ে ফিরে যায়, যার যার দেশে। একই সঙ্গে গুটিয়ে ফেলা হয় রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির শাখা-প্রশাখা। ১৯৪৯ সালে সাংহাইয়ে মাও সে দংয়ের সরকার গঠিত হওয়ার পর রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব চায়না বন্ধ করে দেয়া হয় (১৯৫২)। চীনে নিষিদ্ধকরণ এবং ভারত ও পাকিস্তানের তার পুনর্গঠন- এসবই ছিল বিঔপনিবেশিকরণের অংশ। কিন্তু নতুন চেতনায় সাংহাই এশিয়াটিক সোসাইটি আবার চালু করা হয় ২০০৭ সালে। এবার চালু করা হয় রয়্যাল সোসাইটির অনুমোদন ছাড়া, সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে। এটি এমন সময় চালু হয়, যখন সাংহাই জোট আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই। নতুন সহস্রাব্দে এসে ঔপনিবেশিক সাংহাই বন্দর দখল করে নিতে শুরু করে বিশ্বের শীর্ষ বন্দরের স্থান। একই রকমভাবে স্বাধীন এশিয়াটিক সোসাইটিও জাতীয় সংস্কৃতি অনুসন্ধানে দখল করতে শুরু করে শীর্ষ স্থান।

২০০ বছরের ইতিহাসে ইংল্যান্ড অর্ধ এশিয়া শাসন করে। তার এক-তৃতীয়াংশ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি। এশিয়ার পুনর্জাগরণের যুগে এখন দরকার হয়ে পড়েছে একটি এশীয় জোটের। এটা হবে রাজনীতিক জোট। একইভাবে এশিয়ার ৪৮টি দেশে প্রতিষ্ঠা করা দরকার হবে এশিয়াটিক সোসাইটি। এটা হবে সাংস্কৃতিক জোট এবং এশিয়ার মহামুক্তির পথপ্রদর্শক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত