বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন

একটি গল্পের সমীপে

সামছুল আলম দুদু এমপি, রাজনীতিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মদিনকে ঘিরে এ পর্যন্ত বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা হয়েছে। জাতীয় দৈনিকগুলোতে অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। এ দিনটিকে সরকারিভাবে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। কেন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটিকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে?

এর পেছনে যৌক্তিক কী কারণ রয়েছে তার একটা সারলিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এ ব্যাখ্যাটি বহুমাত্রিক হতে পারে। যে যার মতো করে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন এবং আগামীতে অনেকে করবেন।

কালজয়ী ক্ষণজন্মা এ মহান ব্যক্তির জন্মদিন নিয়ে নানারকম ভাবনা থাকবে- এটাই তো স্বাভাবিক। এ গল্পের যেন শেষ নেই। বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও বাংলাদেশের অভ্যুদ্যয়ের মধ্যে একটি আধ্যাত্মিক সূত্র বিদ্যমান। কেননা, যে মাসটিতে বঙ্গবন্ধুর জন্ম, সেই মাসটিতেই বাংলাদেশ নামক একটি দেশের অভ্যুদয় এবং তারই যোগ্য নেতৃত্বে। ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বও লাভ করেন। কী অদ্ভুত একটি মিল। এ যেন সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত ভবিতব্যের সাযুজ্য। মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস, সংগ্রামের মাস। এ মাসটিকে আমরা অগ্নিঝরা মার্চ হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছি। এ মাসকে ঘিরেই লেখা হয়েছে রক্তের ইতিহাস। একটি জাতির বীরত্বের ইতিহাস। মার্চ মাসটি আমাদের জাতীয় জীবনের তাৎপর্য বহন করে চলেছে। জাতির পিতার জন্ম হয়েছে বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যকে সামনে রেখেই। তার জন্ম না হলে হয়তো একটি জাতি রাষ্ট্রের জন্ম হতো না।

বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মাতা সায়েরা খাতুন এক গর্বিত দম্পতি। ছোটবেলার আদরের খোকা যে একদিন একটি জাতি-রাষ্ট্রের জন্মদাতা হবেন- একথা মনে হয় তার পিতা-মাতাও কখনও ভাবেননি। যা হোক, আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহামানবের দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছি।

শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব কাটে টুঙ্গিপাড়ায়। বাইগার নদীর কূল ঘেঁষে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। বাইগার নদীটি মধুমতীর সঙ্গে মিশে গিয়ে পদ্মায় সংযোগ স্থাপন করেছে। সেদিনের বাইগার নদীর এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। শেখ মুজিব ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মানবিক স্বভাবের ছিলেন। মানবিক উৎকর্ষে দেদীপ্যমান খোকা শিশুকালেই গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, প্রত্যক্ষ করেন। গ্রামের মাটি ও মানুষ তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করত। তদানীন্তন জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার- নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি কৈশোরেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। যদিও শেখ মুজিবের পরিবার যথেষ্ট স্বচ্ছল ছিল। কিন্তু শেখ মুজিব দরিদ্র জনসাধারণের প্রতি প্রচণ্ড দরদি ছিলেন। কৈশর যুবা কাটিয়ে তিনি যখন রাজনীতিতে আলোকিত মানুষ হয়ে উঠেন, তখনও শিশুদের প্রতি ছিল তার প্রচণ্ড অণুরাগ। রাষ্ট্রনায়ক হয়েও শিশুদের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা দেখিয়েছেন। সে জন্য তার জন্ম দিনটি জাতীয় শিশু দিবসের মর্যাদা লাভ করেছে। রাজনৈতিক জীবনের বর্ণাঢ্য কর্মধারায় তিনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন মানব সভ্যতার ইতিহাসে। বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত এতটাই বর্ণময়, যা বলে শেষ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও চিন্তাচেতনার বিশ্লেষণ করলে হাজার বছর আগের এক মহাপুরুষের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি হচ্ছেন ভর্তৃহরি।

গল্পটি উল্লেখ করতে হচ্ছে- ভর্তৃহরি ছিলেন রাজা ও একই সঙ্গে কবি। হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে ভারতের মধ্যপ্রদেশের মালতয়া অঞ্চলের রাজা ছিলেন ভর্তৃহরি। তার ‘নীতিশতক’ গ্রন্থে তিনি বলে গেছেন পৃথিবীতে তিন ধরনের মানুষ রয়েছে। হাজার বছর আগের তার কথা অনুযায়ী বর্তমান সমাজের চেহারাটা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই তিন শ্রেণির মানুষের মধ্যে একশ্রেণি হচ্ছে- সৎ পুরুষ বা সৎ মানুষ, যারা নিজেদের স্বার্থ পরিত্যাগ করে পরহিতে ব্রতী হন। আরেক শ্রেণি আছে অতি ‘সামান্য’, এই সামান্যরা অর্থাৎ সাধারণ মানুষ ততক্ষণই অন্যের মঙ্গল করবেন, যতক্ষণ তাদের নিজেদের স্বার্থে ঘা না পড়ে। আরেক শ্রেণির মানুষ আছেন যাদের ‘মানব রাক্ষস’ বলা যায়। তারা নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের কল্যাণকে বলি দেয়। যারা মানব রাক্ষস তারা শুধু নিজেরটা ভাবে। অন্যের ধন-সম্পদ বা গরিবের ধন-সম্পদ লুট করে নিজে অর্থবিত্তে বলীয়ান হয়, বর্তমান সমাজে রাজনীতিতে মানব রাক্ষসদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ভর্তৃহরি এ প্রথমশ্রেণির অর্থাৎ যাদের তিনি সৎ পুরুষ বা সৎ মানুষ বলেছেন তারা হচ্ছেন মহামানুষ। এদের কেন ভালোমানুষ বা মহামানুষ বলেছেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ভর্তৃহরি বলেছেন- এসব মানুষের সত্তা অন্যের কল্যাণ চিন্তায় এমনই পরিপূর্ণ যে, স্বার্থের কালিমা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এরা নিজের স্বার্থ চিন্তা জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু অন্যের মঙ্গলই করে যান। যে কোনো সমাজের এরাই মহত্তম মানুষ, এরা গর্বের বস্তুতে রূপান্তরিত হন। আধ্যাত্মিক জগতেরও এরাই পুরোধা। ‘নিউ টেস্টামেন্টের’ ভাষায় বলতে গেলে, তারা হচ্ছেন- ‘Salt of the earth’ অর্থাৎ পৃথিবী এদের জন্য টিকে আছে, মানবসভ্যতা এদের জন্য টিকে আছে। এই ভালো মানুষের এমনই চারিত্রিক মহিমা। সমাজে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। বহু যুগের ব্যবধানে এ ধরনের মানুষ জন্ম নেয়। শত চেষ্টায়ও সৎ মানুষের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করা যায় না। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন প্রকৃতির মানুষ। যিনি সারা জীবন অন্যের মঙ্গলই করে গেছেন। তার সত্তায় শুধুই মানব জাতির কল্যাণ চিন্তা। অসহায় পীড়িত মানুষের প্রতি অপরিসীম মমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর।

জীবনের অধিক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি জেল খেটেছেন। একটি জাতির অধিকার আদায়ে কখনও আপস করেননি। শত্রু পক্ষকে তিনি আঘাত না করে প্রথমে সত্যের পথে আহ্বান জানিয়েছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণের এক জায়গায় বলেছিলেন- ‘তোমরা আমাদের ভাই, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আমার লোকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না।’ এ কথাগুলো বলেছেন পাকিস্তানি অবাঙালি সেনাদের উদ্দেশ্যে। বঙ্গবন্ধু ইচ্ছা করলে আরাম-আয়াসে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে অন্যের মধ্যে নিজেকে প্রত্যক্ষ করলেন এবং নিজের ক্ষুদ্র আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে অন্যের কল্যাণার্থেই জীবনযাপন করে গেলেন।

লাখ লাখ বাঙালি জাতিকে দাসত্ব ও ভয়ের হাত থেকে মুক্ত করতে এবং একটি জাতির ভেতর মানবীয় মর্যাদা ও মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। আরেক শ্রেণির মানুষ যাদের ভর্তৃহরি সামান্য বা সাধারণ মানুষ বলেছেন- তাদের এভাবেই বিশ্লেষণ করেছেন- এরা ততক্ষণই অন্যের স্বার্থ দেখবেন যতক্ষণ নিজের স্বার্থে আঘাত না লাগে। একেই ব্রিটিশদের নৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনে ‘এনলাইটেড সেল্ফ ইন্টারেস্ট’ বা ‘মার্জিত আত্মস্বার্থ’ বলা হয়েছে। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে এরকম দর্শনের কদর ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ দরকার। বঙ্গবন্ধু এই বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগের কথাই ভেবেছিলেন। তিনি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আপনাদের স্বার্থেই জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি প্রয়োজন।’ তিনি এও বলেছেন- ব্যবসায়ীদের ভুলে গেলে চলবে না, বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে গেলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো চাই। তা না করে নির্বোধের মতো শুধু নিজের সম্পদ বৃদ্ধির চেষ্টা করলে ধনী আরও ধনী হবে, গরিব আরও গরিব হবে। যে রাষ্ট্র অবাধ বাণিজ্যনীতি প্রচলিত সেখানে সম্পদ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত বানচাল হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু জানতেন, সাধারণ মানুষ মহামানব নন। কিন্তু তারা যদি ‘মার্জিত আত্মস্বার্থে উদ্বুদ্ধ হন, তবেই দেশ এগিয়ে যাবে। নিজের স্বার্থ টিকিয়ে রেখে অন্যের স্বার্থ দেখলেই চলবে। আজকের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এই ‘মার্জিত আত্মস্বার্থের’ চিন্তা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে বলেই উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও প্রযুক্তির জ্ঞান ভাগ করে নিচ্ছে। ব্যবসায়িক ও অন্যান্য সাহায্যের লেনদেনের মাধ্যমেও এই মানসিকতা ব্যক্ত হচ্ছে। এই দর্শনের প্রয়োগ জাতীয় স্তরে হওয়া আরও বেশি প্রয়োজন। সবরকম ব্যক্তিগত স্বার্থকে সমাজচেতনার আলোকে আজ আমাদের পরিশুদ্ধ করে নিতে হবে। ভর্তৃহরি যাদের মানব রাক্ষস বলেছেন, তাদের তিনি দুষ্ট প্রকৃতির মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এসব মানুষের চরিত্রের পৈশাচিকতা কীভাবে প্রকাশ পায়? তার উত্তর হচ্ছে ব্যক্তিগত সুখ ও লাভের উদগ্র বাসনায় এরা অন্যের সুখ-শান্তি বিনষ্ট করে। অন্যের সর্বনাশ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, পাকিস্তানি শাসকরা চোরগুলো রেখে গিয়ে সম্পদগুলো নিয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর পরই বেশ কিছু নররাক্ষস সৃষ্টি হয়। খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, আরও কত রকম দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেই বিভিন্ন বক্তৃতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। জনগণের দুর্ভোগ-দুর্দশা কারণ হচ্ছে নররাক্ষস। তাদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এতে দুর্নীতি কমতেছিল, নররাক্ষসদের পতনও সময়ের ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণমূলক লক্ষ্যগুলো পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আগেই তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। প্রচলিত আছে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য দ্বারা বঙ্গবন্ধু নিহত হন। কিন্তু এটা আপেক্ষিক সত্য, উচ্চতর সত্য নয়। দেশি-বিদেশি তথা আন্তর্জাতিক ‘মানব রাক্ষস’ চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করতে ব্যবহার করে কিছু সেনাসদস্যকে। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের বিচার হলেও কুশীলবদের বিচার এখনও হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ১০৩তম জন্মবার্ষিকীতে মুজিব আদর্শ লালনকারীদের অঙ্গীকার করতে হবে- বঙ্গবন্ধুর হত্যায় কুশীলবদের উত্তরসূরিরা যাতে রং বদলে আওয়ামী লীগের ছাতার নিচে আশ্রিত না হতে পারে। সর্বত্র সদা সতর্ক থাকতে হবে।