ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন জন্ম থেকে জন্মান্তরে

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন জন্ম থেকে জন্মান্তরে

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তদানীন্তন ভারতবর্ষের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাঙালির বহু বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার বলিষ্ঠ এবং সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বে বিশ্বের বুকে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ নামের নতুন একটি জাতিরাষ্ট্র। সেই মহানায়কের আজ ১০৩তম জন্মদিন। তার বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতার নাম সায়েরা খাতুন। চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান।

সুদূর অতীতকাল থেকেই গোপালগঞ্জ জেলা মাছের জন্য বিখ্যাত ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির আশপাশে প্রচুর বিল ছিল। সেই সব বিলে পাওয়া যেতো প্রচুর মাছ, যার ফলে বঙ্গবন্ধুর খাওয়া-দাওয়া ছিল যথেষ্ট পুষ্টিকর। এ কারণেই বোধ হয় বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলায় তেমন কোনো স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা হয়নি।

স্কুল থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গ্রামের স্কুলে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শোনা শুরু করেন। ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে অসুস্থ শরীর নিয়েই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন।

কৈশোরেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা। বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৪৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গঠন করেন।

’৪৭-এর দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতা আন্দোলন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ’৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার অবিসংবাদিত নেতৃত্বে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের।

চোখের অসুস্থতায় চিকিৎসার জন্য কলকাতা যাওয়ার ঘটনায় বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য এক ধরনের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। দেশের মানুষের জন্য কীভাবে চিকিৎসাসেবা আরও উন্নত ও সহজলভ্য করা যায়, এই ভাবনা জীবনের শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। স্বাধীনতার পর দেশ পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপ। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। বাজেট কম, তারপরও বঙ্গবন্ধু আরও নতুন মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

মেডিকেল আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার মাধ্যমে দেশের ডাক্তার সংকট নিরসনের প্রচেষ্টা চালান। এফআরসিএস শেষ করা বহু ডাক্তার বিদেশ ছিল তাদের দেশে ডেকে আনেন। তখন স্বদেশে তারা চিকিৎসাসেবা শুরু করেন। সদ্য স্বাধীন দেশে যা যা করণীয়, বঙ্গবন্ধু তাই করলেন। শিক্ষা, সেবা, পুষ্টি, প্রিভেনশন অব ব্লাইন্ডনেস কার্যক্রমের জন্য RCSB-এর মাধ্যমে ব্যবস্থা করেন। তিনি ইপিআই প্রোগ্রাম চালু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে ১৯৭৩ সালে পরিবার-পরিকল্পনা বিষয়ে বিশেষ দিকনির্দেশনা দেন এবং অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এ খাতে কিছুটা বাস্তববাদী পরিবর্তন আনতে দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালে বঙ্গবন্ধু তাদের দ্রুত সুস্থতার জন্য আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য হাজার হাজার আহত মুক্তিযোদ্ধাকে পূর্ব জার্মানি, তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া), ভারত, চেকোস্লোভাকিয়া এবং ফ্রান্সে প্রেরণ করেছিলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের ওষুধের বিশাল সংকট ছিল এবং এটি সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ও তাদের ওষুধ বিনামূল্যে দেয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা ছিল। এর পর বঙ্গবন্ধু দেশের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানির জন্য বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনকে (টিসিবি) নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

তিনি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর আসল চাহিদা অনুযায়ী ওষুধগুলো যথাযথভাবে বিতরণের জন্য আমদানি করা ওষুধগুলো তাৎকালীন মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের কাঁধে হস্তান্তর করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে ওষুধ উৎপাদনে পরিবর্তন এনেছিলেন। সর্বাধিক ওষুধগুলো তখন কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির দ্বারা উৎপাদিত করা হত, যা ব্যয়বহুল ছিল এবং চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা মানুষের পক্ষে সাশ্রয়ী ছিল না।

তিনি ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থাগুলোকে বহুজাতিক সংস্থার সবধরনের ওষুধ উৎপাদন করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশ স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কোর্স চালু করেন।

বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক থানায় থানায় হেলথ কমপ্লেক্স করার ব্যবস্থা নিলেন। সে সময় তিনি ১৩৮টি হেলথ কমপ্লেক্স করতে পেরেছিলেন নিপসমের ওখানে আইপিএইচ ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ, ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশিয়ান স্থাপন করলেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, পুষ্টি, স্বাস্থ্য প্রত্যেক মানুষের দোরগোড়ায় যেন পৌঁছে দেয়া যায় সেই ব্যবস্থা করলেন।

বঙ্গবন্ধু দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পুষ্টিনীতি প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধু গবেষণার জন্য বিএমআরসি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল বিএমডিসি প্রতিষ্ঠিত করলেন। বঙ্গবন্ধু জনবল তৈরির জন্য নার্স-ডাক্তার সেবা মিডওয়াইফার তৈরির জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।

কলেরা হাসপাতাল আইসিডিডিআরবি প্রতিষ্ঠা করলেন ওআইডিসিএইচ হাসপাতাল তৈরি করেন।

সারাদেশে তখনমাত্র ৬৭টি হাসপাতাল ছিল, তিনি ৩৭৫টি থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তৈরি করেন যার শয্যা সংখ্যা ছিল প্রতিটিতে ৩১টি।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর সরকারই প্রথম এ দেশের পল্লি অঞ্চলের সাধারণ মেহনতি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার কথা বিবেচনা করে, চিকিৎসাসেবাকে থানা পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চালু করেন, চিকিৎসকদের সরকারি চাকরিতে সম্মান ও মর্যাদার কথা বিবেচনা করে চিকিৎসকদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেছিলেন, যা দেশের চিকিৎসক সমাজ চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। মেডিকেল উচ্চ শিক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু শাহবাগ হোটেলকে আইপিজিএমআর এ উন্নীত করেন। ১৯৭২ সালে অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জারী (বিসিপিএস) প্রতিষ্ঠা করেন।

যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার ন্যায় থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যসেবা তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে দরিদ্র জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমজিডি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নের প্রস্তুতিসহ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন, দরিদ্রসীমা হ্রাস, গড়আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বৃদ্ধি প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও পরিশ্রমের ফসল। এরই মধ্যে উদ্বোধন হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ পায়রা তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র, বহুল কাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু এবং ঢাকা মেট্রোরেল। এছাড়া চলমান রয়েছে দেশের মেগা সব প্রকল্পগুলো। প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার উদাত্ত আহ্বানে আসুন আমরা দলমত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যা হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণের একমাত্র পথ।

স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার এই মহান নেতার জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। কোনো বিশেষ ঘটনা বা আনন্দের দিনকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দের দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম দিন। বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু একজনই জন্মেছিলেন। যার জন্ম না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না। এজন্য ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত আদর করতেন, ভালোবাসতেন। শিশুদের সঙ্গে গল্প করতেন, খেলা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আজকের শিশুরাই আগামীদিনে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দেবে। তরুণ প্রজন্ম এই মহান নেতার আদর্শ থেকেই দেশ গড়ার অনুপ্রেরণা লাভ করে। যারা বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে তাদের মাঝেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকবেন জন্ম থেকে জন্মান্তরে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত