আপনাদের ভাবনা

নিরাপদ হোক মানুষের খাদ্য

মাইন উদ্দীন হাসান

প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল’ সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমান সময়ে দেশে পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য পাওয়া দুষ্কর। প্রতিটি মানুষের দেহ যেন খাদ্য ভেজালের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত। শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে সব খাদ্যই এখন ভেজালযুক্ত। এই খাদ্য গ্রহণে মানবদেহে তৈরি হচ্ছে অনিরাময় যোগ্য সব রোগ। যা একজন মানুষকে অনায়সে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। খাদ্য ভেজাল রোধ করা এখন সময়ের দাবি। তবে এতে দেশের প্রশাসনের কঠোর একটা অবস্থান নেই বললেই চলে। খাদ্য ভেজালের বিরুদ্ধে দেশের প্রশাসনের মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করতে দেখা গেলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

ফলমূল, শাকসবজির বেশির ভাগই দেশে উৎপাদিত। এ পিউর খাদ্যগুলোকে দুষ্টচক্রের ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা বেশিদিন ধরে টিকিয়ে রাখতে এবং মৌসুমী ফলমূল যাতে দীর্ঘ সময় ভালো রাখতে পারে, সেই জন্য ফরমালিন মিশিয়ে করে তুলছে বিষাক্ত। অপরিপক্ব ফল গাছে থাকতে পাকানো হচ্ছে কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি স্প্রে করে। আম, কলা, পেঁপে, আপেল, আঙুর ফরমালিন মিশিয়ে চাকচিক্য করে তোলে ভোক্তা আকৃষ্টকরণের জন্য।

আমের মৌসুমে আম পাকার নির্দিষ্ট সময়ের আগে মুনাফালোভী কিছু ব্যবসায়ীরা আম বাজারজাতকরণ করে ফরমালিন মিশিয়ে। এই আম উপরে ভোক্তাদের চোখে পরিপক্ব মনে হলেও, ভেতরে অপরিপক্ব রয়েই যায়। অনেক ভোক্তারা ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে ক্রয় করছে এসব আম। এছাড়া আরও অনেক পিউর প্রাকৃতিক খাবারে ফরমালিন মিশিয়ে করে তুলছে বিষাক্ত। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত মানবদেহে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ তৈরিতে এই ফরমালিন দায়ী।

অন্যদিকে রেস্টুরেন্টগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না এবং নিত্যদিন কড়াইগুলোতে পুরোনো তেল দিয়ে চলে ভাজাপোড়ার কাজ। কিছু রেস্টুরেন্টে ভোক্তার অজান্তে রোগে মারা যাওয়া মুরগি, মরা গরুর মাংস, গরু এবং খাসির মাংসের বদলে অন্য প্রাণীর মাংস খাওয়ানোর অভিযোগ মাঝেমধ্যে খবরের শিরোনাম হতে দেখা যায়। আবার দেশের খাবার তৈরি করা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে নজর দিলে আরও করুণ অবস্থার দেখা মিলে। সুন্দর মোড়কে ঢাকা খাবারগুলো ভেজালে যে পরিপূর্ণ তা বেশিরভাগই ভোক্তার ধারণার বাইরে। যে জুস গ্রীষ্মে একটু প্রশান্তির আশায় মুখে দিই, সেই জুস তৈরি হয় আমের বদলে পচা মিষ্টি কুমড়া দিয়ে। আরও আছে শিশুদের জন্য তৈরি বিভিন্ন খাবার চকলেট, চিপস যা ভেজালে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। এই খাবার গ্রহণে ব্যাহত হচ্ছে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ।

মুড়ি, পানি ও দুধ ভেজালের বাইরে নয়। মুড়ি শ্রমিকরা লবণের বদলে ইউরিয়া মিশিয়ে তৈরি করছেন মুড়ি। কোনো বিশুদ্ধিকরণ ছাড়াই পুকুর ও ওয়াসার পানি মিনারেল পানি বলে বোতলজাত করে সরাবরাহ করছে বাজারে। জীবন রক্ষাকারী পানি করে তুলছে মরণঘাতী পানি হিসেবে। দুধ উৎপাদনে এখন আর গাভী লাগে না। দুধ তৈরির কারখানাগুলোতে খাবার পানি, ময়দা, ভাতের মাড় ও চিনি মিশিয়ে আগুনে ফোটানো হয় এবং পরে কাটিং অয়েল ও এসেন্স মিশিয়ে দুধের সুবাস দিয়ে বাজারে সরবরাহ করছে গরুর খাঁটি দুধ বলে।

হাটবাজার ঘুরে কেমিক্যালমুক্ত মাছ মেলে না কোথাও। নিজেদের ফায়দা লুটতেই ইউরিয়া, ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল মিশিয়ে মাছকে বিপজ্জনক বিষে পরিণত করছে ব্যবসায়ীরা। নিয়মিত বাসায় রান্নার কাজে ব্যবহৃত মসলাতেও রয়েছে ভেজাল। মরিচের গুঁড়ায় এক ধরনের ব্যবসায়ী মেশাচ্ছেন ইটের গুঁড়া, হলুদে দেয়া হচ্ছে মটর ডাল, ধনিয়ায় কাঠের গুঁড়া ও পোস্তদানায় ব্যবহৃত হচ্ছে সুজি, যা মানবদেহে মারাত্মক ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে।

যে খাবারগুলো মানবদেহে গিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর কথা, বরং তার বিপরীতে তৈরি করছে নানা ধরনের জটিল রোগ। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের ‘বিষাক্ত খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি’ শীর্ষক সেমিনারে বলা হয়, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ।

খাদ্যে ভেজাল বন্ধে মোবাইল কোর্ট অনেকটা সুনাম কুড়িয়েছে। এটির কঠোর প্রয়োগে খাদ্য ভেজাল রোধ করা সম্ভব। যেখানে সরকারের একনিষ্ঠ ভূমিকা থাকা দরকার। তা নাহলে অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি আরও বেশি ভয়াবহতায় রূপ নেবে। নিপাত যাক খাদ্যেভেজাল মেশানো সব দৃষ্কৃতকারী ব্যবসায়ী এবং নিশ্চিত হোক মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য।

শিক্ষার্থী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]