সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন বৈশ্বিক উদ্যোগ

মোতাহার হোসেন, সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ, ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম

প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাতাসে কার্বন নির্গমন ক্রমেই বাড়তে থাকায় উত্তপ্ত হচ্ছে বায়ুমণ্ডল। পাশাপাশি পৃথিবীতে গাছপালা, বৃক্ষরাজি কমে যাওয়ায় বায়ুমন্ডলের আদ্রতা ও উত্তপ্ত অবস্থা লাঘব না হওয়ায় ভূপৃষ্ঠে উত্তপ্ত হচ্ছে। এর প্রভাবে বরফাচ্ছাদিত হিমালয় পর্বতসহ পৃথিবীর অপরাপর বরফাচ্ছাদিত হিমবাহ ও পর্বতের বরফও গলছে সমভাবে। পৃথিবীর বরফাচ্ছাদিত পর্বতগুলোর বরফ গলে সেই পানি সমুদ্রে পতিত হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো ঝুঁকিতে আছে। অতিসম্প্রতি এই ঝুঁকির তথ্য নিরাপত্তা পরিষদকে জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এ সময় তিনি বিশ্বের নিচু উপকূলীয় অঞ্চল ও ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে বসবাসকারী লাখ লাখ বাসিন্দাদের বিষয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেন। জাতিসংঘের দেয়া তথ্য অনুসারে, ১৯০০ সাল থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস বাড়ার কারণে প্রায় ২ কোটি মানুষ গৃহহীন ও আশ্রয়হীন হবে। এমন পূর্বভাস পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর। সংস্থাগুলোর মতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে জলোচ্ছ্বাস বাড়লে সমুদ্রের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। এ অবস্থায় কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে, খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে। একই সঙ্গে খাদ্য নিররাপত্তায় ঝুঁকিও বাড়বে সমহার।

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দেয়া এক বক্তব্যে গুতেরেস আরও জানান, বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও নেদারল্যান্ডসের মতো দেশগুলো ছাড়াও হুমকির মুখে রয়েছে ব্যাংকক, বুয়েনস আয়ার্স, জাকার্তা, লাগোস, লন্ডন, লস অ্যাঞ্জেলেস, মুম্বাই, মাপুতো, নিউইয়র্ক ও সাংহাইয়ের মতো বড়ো শহরগুলো। গুতেরেস নিরাপত্তা পরিষদকে বলেন, বিপদটি বিশেষ করে প্রায় ৯০ কোটি মানুষের জন্য প্রকট, যারা নিম্ন উচ্চতার উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে। বিশ্বের প্রতি ১০ জনের একজন মানুষ এই মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবী সহনীয় পর্যায়ের চেয়েও বেশি উত্তপ্ত হচ্ছে। যার কারণে হিমবাহ ও বরফ গলে যাচ্ছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মতে, অ্যান্টার্কটিকায় প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন টন বরফ গলে যাচ্ছে। গ্রিনল্যান্ড প্রতিবছর ২৭০ বিলিয়ন টন বরফ হারাচ্ছে। জাতিসংঘ প্রধান বলেন, গত শতাব্দীতে বিশ্বে মহাসাগর সবচেয়ে বেশি দ্রুত উষ্ণ হয়েছে। বিশ্ব ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণায়নের সীমা অতিক্রম করছে। এটি ২.৮ ডিগ্রির দিকে যাচ্ছে। এভাবে উষ্ণতা বৃদ্ধি দুর্বল দেশগুলোর জন্য কার্যত ‘মৃত্যুদণ্ড’।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, হিমালয়ের বরফ গলে এরই মধ্যে পাকিস্তানে বন্যা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। কিন্তু আগামী কয়েক দশকে হিমালয়ের হিমবাহ কমতে থাকায় সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীগুলো আরও সংকুচিত হবে। এমনকি নিচু দেশগুলো চিরতরে অদৃশ্য হয়েও যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে কলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তের নেতিবাচক প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকতে হবে। ফলে জলবায়ু তহবিলের জন্য ১০০ বিলিয়ন অর্থ প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তা দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে।

প্রসঙ্গগত বায়ুমন্ডলে অতিমাত্রায় কার্বন নিঃসরণের ফলে ক্রমাগত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দ্রুত জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশেও ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে ওঠেছে পরিবেশ প্রকৃতি। সাম্প্রতিককালে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, হঠাৎ অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের বর্ধিত আনাগোনায় বাংলাদেশের জনজীবন, কৃষি, ভৌত অবকাঠামো বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে সবচেয়ে অধিক ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে, এমন সতর্ক মন্তব্য পরিবেশবিদদের। তাদের মতে, ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের ১৭ শতাংশেরও বেশি জমি পানির নিচে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নদীভাঙন ও ঝড়ো জলোচ্ছ্বাসের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের দুই কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিও জন্য মূলত আমরাই দায়ী। পাশাপাশি আমাদেরও অতিমাত্রায় ভোগবিলাসী জীবনযাপনই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে। বিজ্ঞানের সূত্র মেনে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে পানির আয়তনও বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া মরু অঞ্চল ও পর্বতচূড়ায় অবস্থিত বরফ গলে যাওয়ার ফলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১ থেকে ৩৮ ইঞ্চি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। গ্রিনল্যান্ড ও পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকায় বড়োসড়ো কোনো ভাঙন দেখা দিলে এটা আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সারা বিশ্বের নিম্নাঞ্চলের দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তসরকার সংস্থা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) একটা গবেষণা বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার (৩৯.৩৭ ইঞ্চি) বাড়লে বাংলাদেশের ১৭-২০ শতাংশ স্থলভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর প্রণীত বাংলাদেশের জাতীয় কৌশলনীতির তথ্যঅনুসারে দেশের আড়াই কোটি মানুষ জলবায়ু-উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। নাসার সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকতে রয়েছে। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার ঘনত্ব ও সীমিত সম্পদের কারণে পরিবেশ-উদ্বাস্তুদের অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা কষ্টসাধ্য হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিছু দ্বীপরাষ্ট্র। মালদ্বীপ, পাপুয়া নিউগিনি এবং প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রগুলো পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে যাবে। এসব দেশ পুরোপুরি নিমজ্জিত হওয়ার আগেই বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। এ ছাড়া পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা বেশ ঝুঁকিতে রয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিশ্বের বৃহৎ ১০টি মেগাসিটির মধ্যে ৮টিই সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ সমুদ্রোপকূল থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাস করে। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ, যাদের সম্পদ সীমিত, তাদের পক্ষে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কষ্টকর হবে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন দেশের বর্তমান সামুদ্রিক সীমানা পরিবর্তিত হবে। দ্বীপরাষ্ট্রগুলো পুরোপুরি তলিয়ে গেলে সংলগ্ন সমুদ্রসীমার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাবে। সীমানার সামান্য পরিবর্তনের ফলেই ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল’ অব দ্য সি (ইউএনসিএলওএস) কর্তৃক নির্ধারিত সামুদ্রিক সীমা পরিবর্তিত হবে। এর ফলে পরিবর্তিত নতুন সমুদ্রসীমা নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরোধ দেখা দিতে পারে। সাগরের মধ্যে যে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে, সেটা নিয়ে এবং গভীর সমুদ্রে প্রবেশাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে তিক্ততাও বাড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। লবণাক্ত পানির সংক্রমণের কারণে বিভিন্ন ধরনের শস্য উৎপাদন ব্যাহত হবে এবং ফসলের গুণগতমান পরিবর্তিত হবে। গবেষণা বলছে, সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গভীরতার পরিবর্তন এবং পানির রাসায়নিক গুণগত মানের পরিবর্তনের ফলে মাছের অসংখ্য প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অনেক সামুদ্রিক প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কারণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি তাদের শ্বসন, বাস্তুসংস্থান ও শারীরিক বৃদ্ধির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সারাবিশ্বের অর্থনীতির ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়বে। উপকূলীয় অবকাঠামো-সমুদ্রবন্দর, রাস্তাঘাট ও রেলসংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বন্দরগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যাহত হবে। এর ফলে সমুদ্রোপকূলবর্তী শহর ও রাষ্ট্রগুলোর মানুষকে সেবা দেয়ার সক্ষমতা হ্রাস পাবে, যা রাষ্ট্রগুলোকে ভঙ্গুর করে তুলবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র, যেমন নিউইয়র্ক, সাংহাই, মুম্বাই ইত্যাদি সমুদ্রোপকূলে অবস্থিত। এই অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিগুলো যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা সাময়িকভাবেও যদি এদের স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হয়, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়ে যাবে। উপকূলে অবস্থিত পর্যটন শিল্পের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হবে। বাংলাদেশে যে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটছে, তা হয়তো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব নয়। বরং বৃদ্ধির হার কতটা কমিয়ে রাখা যায়, সেটাই সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। পাশাপাশি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে যেসব নিরাপত্তা ঝুঁকির সৃষ্টি হতে পারে, তা মোকাবিলার জন্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের যৌথ পদক্ষেপ দরকার। একই সঙ্গে এ জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা তা বাস্তবায়নে স্থানীয় এবং বৈশ্বিক উদ্যোগ। তাহলেই পৃথিবীর মানুষকে, ভবিষ্যৎকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে।