গণপরিবহণে যাত্রী বিড়ম্বনা

এ এইচ খান রতন, কলাম লেখক

প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য, বাক-স্বাধীনতা, বস্ত্র এই অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলো মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও, কালক্রমে মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্র এখন বহুধা বিস্তৃত। সময়ের সঙ্গে প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের স্বপ্ন জয়ের তালিকা যেমন দীর্ঘ হচ্ছে, মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রেও নতুন নতুন চাহিদা যুক্ত হচ্ছে। পরিবর্তনের এ ধারাবাহিকতায় মৌলিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে, গণপরিবহণ যুক্ত হয়েছে। অহর্নিশি মানুষ এখন চক্রাবর্তের ন্যায় কর্মব্যস্ত সময় পার করছে। আর সঙ্গত কারণেই গণপরিবহণ এখন মৌলিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত কিংবা কর্মস্থলে যাতায়াতে ব্যক্তিগত গাড়ি না থাকলে একমাত্র বিকল্প, গণপরিবহণ। ব্যয়বহুল রাইড শেয়ারিং তো নিম্ন-মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে।

পৃথিবী ব্যাপী পরিবহণের গতি ও ধরনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। দ্রুতগতি এবং বিলাশবহুল পরিবহণ ব্যবস্থার প্রতিযোগিতা এখন বিশ্বময়। জল-স্থল ও আকাশপথে সর্বত্রই মানুষের জীবন এখন ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে গতি মিলিয়ে জীবনযুদ্ধে চলমান এক যন্ত্রমানবের প্রতিচ্ছবি। মেট্রোরেল, নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, আকাশপথে উন্নয়নের ক্ষেত্রে হাজার হাজার কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ, রেল, পরিবহণ সেবা উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্প ও গন্তব্য নির্ধারণ তারই উদাহরণ। দেশব্যাপী এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন নিঃসন্দেহে গণযোগাযোগের নতুন দিগন্তের সূচনা।

কিন্তু দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ, যারা নিয়মিত গণপরিবহণের যাত্রী, তাদের যাতায়াতের জন্য সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের পরিবহণ ব্যবস্থার আসলে কতটা উন্নতি হয়েছে। সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু, যে পরিবহণে নির্ধারিত ভাড়ার বিনিময়ে সাধারণ, মধ্যবিত্ত, এমনকি ধনী শ্রেণির নাগরিকরাও প্রয়োজনে যাতায়াত করে থাকে, ওই পরিবহণ ব্যবস্থায় মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একে তো গণপরিবহণের যাত্রীরা তার অধিকৃত আসনে ন্যূনতম স্বস্তিকর পরিবেশে যাতায়াতে অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে; তার ওপর পরিবহণগুলোতে বিন্যাস করা আসন ব্যবস্থাগুলো যার পর নাই অস্বস্তিকর। যাত্রীকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে আসনে স্থান করে নিতে হয়। সীট কভারগুলোর অবস্থা শরৎ চন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে নতুনদার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা করেও নিতান্ত বাধ্য হয়ে ব্যবহার করা র‍্যাপারের কথা মনে করিয়ে দেয়। তেল চ্যাটচ্যাটে সিট কভারগুলোর অবস্থা এমনই যেখানে, নিতান্ত বাধ্য না হয়ে কেউ নোংড়া ওই আসন ব্যবহারের কথা ভাবতেও পারে না। বাধ্য হয়েই নাক-মুখ বন্ধ করে যাতায়াতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। দেশের ৯০ ভাগ পাবলিক পরিবহণের বাস্তবচিত্র এমনই। অনেক সময় অস্বস্তিকর এ পথযাত্রায় প্রশিক্ষণহীন পরিবহণ কর্র্মীর সঙ্গে অনেক ভদ্রলোকের যাত্রীকেও অপ্রাসঙ্গিক তর্কে জড়িয়ে মেজাজ হারাতে দেখা যায়।

অথচ, বিদ্যমান স্থানে মাত্র দুটো আসন কম বসালেই অন্তত কিছুটা স্বস্তিকর পরিবেশে এই কঠিনতর অবস্থা হতে মুক্তি পেতে পারে মানুষ। জঘন্য এ পরিবেশ দেখার কেউ আছে বলে মনে হয় না। যদিও বা সৌভাগ্যক্রমে কোনো যাত্রী আসনে বসার সুযোগ পায়, তাহলে হাঁটুর সন্ধিবন্ধনী (Legament) বা মালাইচাকি ছিটকে বেরিয়ে আসার অবস্থা তৈরি হয়। অনেক সময় অস্বস্তিকর অবস্থায় দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামে যাত্রীরা নিজের অজান্তে ঝিমিয়ে পরে সামনের আসনে, মাথা ঠেকিয়ে সিটকভারের নোংড়া পরিবেশের স্পর্শে কপালে জীবাণু সংক্রমণের মতো ঘটনাও ঘটছে। দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা তো না পারছে ঠিকমতো দাঁড়াতে, না পারছে ভদ্রতা বজায়ে সহযাত্রীর সঙ্গে সৌজন্যতাবোধ রক্ষা করতে।

কারণ, যে পরিবহণে মানুষ যাতায়াত করছে, Stable অশ্ব-শালার অবস্থা তার তুলনায় ঢের ভালো। যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা এই অনিয়মই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আজ যে মানুষটির বয়স তিন যুগের কাছাকাছি, যদি সে আজীবন গণপরিবহণের যাত্রী হয়ে থাকে, তাহলে এ পরিবেশকে সে স্বাভাবিক বলে মনে করবে, যে গণপরিবহণ বুঝি এমনি। এখানে বুঝি যুদ্ধ করেই যাত্রীকে গন্তব্য যেতে হয়। নির্ধারিত ভাড়ার বিনিময়ে এ পরিবহণে তার জন্য নির্ধারিত একটি আসন থাকার পরও নিজের অধিকার খুঁজে নেয়ার কোনো অধিকার তার নেই।

গাদাগাদি করে যে স্থানে ১০ থেকে ১২ জন যাত্রী যাতায়াত করছে, সেই একই পথে এই পরিমাণ জায়গা দখল করে কেউ একজন বিশালাকায় জিপ হাঁকিয়ে একাই চলে যাচ্ছে। সরকারি বড় বড় পদে আসীন কর্মকর্তার জন্য একটা গাড়ি তো বটেই, বরাদ্দের বাইরেও একাধিক গাড়ি পারিবারিকভাবে অবৈধ ব্যবহারের নজিরও রয়েছে। বৈষম্যর চিত্র এতটাই ভয়াবহ। অথচ আস্তাবলের ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাতায়াত করা হতভাগা মানুষের রক্তঘামে অর্জিত অর্থেই কেনা কিছুসংখ্যক মানুষের বিলাসিতায় ব্যবহৃত ওই সো করে চলে যাওয়া গাড়িগুলো। বিশেষ কিছু বাহিনীর সন্তানদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতে শুধু সরকারি গাড়িই নয়, সঙ্গে ইউনিফর্ম পড়া ড্রাইভারসহ বডিগার্ড ব্যবহার করার দৃশ্য অহরহই চোখে পড়ে। এদেশে ক্ষমতায় যাওয়া মানুষগুলো খুব সহজেই ভুলে যায় যে, সেও ওই সাধারণ মানুষদেরই একজন। দেশের প্রতি দায়িত্বশীলদের দায়িত্ববোধ কতটুকু একটি উদাহরণ থেকে তা বুঝে নেয়া যেতে পারে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের একদল শিক্ষার্থী শিক্ষা সফরে চীন গমন করে। কর্মসূচির মধ্যে চীনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর্বটি অন্তর্ভুক্ত ছিল। সফরকারী দলটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তার বাসভবনে পৌঁছলে, অভ্যর্থনা জানাতে আসা ভদ্রলোককে দেখে শিক্ষার্থীদের কেউই অনুমান করতে পারেনি, তিনিই প্রধানমন্ত্রী। কারণ, তিনি তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আলোচনা শুরুর পর ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের কাছে বিষয়টি খোলাসা হলো, তিনিই ‘চৌ এন লাই, চীনের প্রধানমন্ত্রী’। তিনি জানালেন তার চাকরিজীবী স্ত্রীর আগে তিনি আজ বাসায় ফিরেছেন বলে রান্নার কাজটি সেরে নিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্ত্রীও বাসায় ফিরবে। প্রধানমন্ত্রী তার আধা পুরোনো একটি বাইসাইকেল দেখিয়ে বললেন, এটা তার যাতায়াতের বাহন। ঘুরেফিরে নিজেদের শাকসবজির বাগানটি দেখালেন, যেখান থেকে পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে থাকেন। বললেন, পৃথিবীতে যতদিন না তারা অর্থনৈতিকভাবে সবার চেয়ে এগিয়ে যাবেন, ততদিন নিজেরা আরাম-আয়েশের কথা ভাবছেন না। একবার ভাবুন তো এ মুহূর্তে আপনার হাতে পত্রিকার পাতায় ছাপানো কালী কিংবা প্রযুক্তিটি চীনের নয় কি? চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তি আজ গোটা পৃথিবীর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে, যা আপনি আমি টের পাচ্ছি প্রতি মুহূর্তেই। তখন নিজেরা আয়েসী জীবন ত্যাগ করেছিল বলেই আজ তাদের প্রজন্ম বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আর আমরা! দেশের খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ বিলাসিতায় ব্যয় করে চলেছি নির্লজ্জ্বের মতো। একবারও ভাবছি না পরবর্তী সময়ে প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধ দেশ গড়ার কথা।

গণপরিবহণ আর ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে এই যে বৈষম্য, তা ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অধিক সুবিধাভোগী ব্যক্তি, রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়িত্ববোধ ভুলে গেছে। ভিআইপি সুবিধা যদি কারও একান্তই প্রয়োজন হয়, তো রাষ্ট্রকে তা ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। ব্যক্তিগত গাড়ি ও পাবলিক পরিবহণের জ্বালানির মূল্যে ব্যবধান থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ, ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে সুবিধাভোগী বাসার ড্রয়িংরুমের বিলাসী জীবন উপভোগ করছে, গাড়িতে বসেও। অপরদিকে গণপরিবহণের যাত্রীরা অস্বস্তিকর ও দূর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করেও সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না। সেই সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত ভারার বিড়ম্বনা তো আছেই। রাস্তায় নিরন্তর জানজট সৃষ্টির জন্য মূলত ব্যক্তিগত গাড়িগুলোই দায়ী। একই দামে জ্বালানি ক্রয় করে অধিক সুবিধাভোগী ব্যক্তি রাষ্ট্রকে অধিকসেবা প্রদান করা উচিত। রাস্তা নির্মাণে ১০ জনের সমপরিমাণ জায়গা নিয়ে চলা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারী ব্যক্তিটি যেমন কর প্রদান করে, গণপরিবহণের যাত্রীরাও দেশকে নির্ধারিত কর পরিশোধ করে থাকেন। কিন্তু সুবিধাভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য বিস্তর।

গণপরিবহণগুলোর ভেতরে যেখানে সেখানে লোহার ধারালো বাড়তি অংশের কারণে মানুষের পরিধেয় বস্ত্র ছিঁড়ছে অহরহ। হাতল, আসনের বিভিন্ন অংশে, পেরেকের মতো ধারালো লোহার অংশ লেগে রক্তাক্ত হচ্ছে মানুষ। এতসব যন্ত্রণার পরও না আছে অভিযোগের স্থান, না আছে সমাধানের উপায়। বাসস্ট্যান্ডে অকারণেই পেছনের পরিবহণের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে আগে আসা গাড়িটি। কোনো বিশেষজ্ঞের অনুর্বর মস্তিষ্কের উদ্ভাবন এ পদ্ধতি বা বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে কেন আসছে না, তার উত্তর কেউ জানে না। ৩০ জন যাত্রী ধারণ ক্ষমতার পরিবহণে ৫০ জনের দুর্বিষহ ধাক্কাধাক্কির পরও পরিবহণ কর্মীকে হতাশার সুরে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, আহা: রে... গাড়িটা একেবারে খালি, আরে ভাই ভেতরে চাপেন। এটা কি কোনো সভ্য সমাজে পরিবহণ ব্যবস্থা হতে পারে। পরিবহণ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে এ প্রশ্নটা কি জাতির পক্ষ থেকে প্রাসঙ্গিক নয়। সরকারের উচিত এমনভাবে গণপরিবহণ ব্যবস্থা চালু করা, ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলেও তা ব্যবহার না করে স্বস্তিকর পরিবেশ, দ্রুত ও সাশ্রয়ী সেবার কারণে মানুষ যেন বাধ্য হয়ে গণপরিবহণ ব্যবহারে উৎসাহী হয়। এতে রাস্তায় যানজট যেমন কমবে, সময়ও বাঁচবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিষয়টি ভেবে দেখা সময়ের দাবি।