সৌদি আরব-ইরান চুক্তি

ইয়েমেনে শান্তির সুবাতাস

অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, [email protected]

প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি দেশের নাম ইয়েমেন। যুদ্ধ-বিগ্রহ চলতে চলতে সেই দেশটি একটি কঙ্কালসার প্রতিকৃতিতে দাঁড়িয়েছে। এতদিন ইয়েমেনের সমস্যার কোনো সমাধানের পথই দেখা যাচ্ছিল না। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। তাছাড়া এসব ক্ষেত্রে শান্তি প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া তা সে যত রক্তপাতই হোক বা যত শিশুই না খেয়ে থাকুক না কেন। এসবে যুদ্ধ থামে না। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে ঐকমত্যে না পৌঁছাতে পারলে সমাধান অসম্ভব। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে অপুষ্টিতে ভোগা একটি শীর্ণ শিশুর ছবি পত্রিকায় দেখে মনটা শিউরে উঠেছিল। সাত বছরের শিশুটির ওজন ছিল মাত্র সাত কেজি! ভাবা যায়! কতটা যন্ত্রণাদায়ক ছিল এ ছবিটি ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। ছবিটি ইয়েমেনের হাসপাতালের বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে থাকা একটি শিশুর ছিল। প্রায় এক দশকেরও সময় ধরে চলা যুদ্ধে বিপর্যস্থ ইয়েমেন। যেখানে খাদ্য সংকটে ভুগছে দেশটির লাখ লাখ মানুষ। সৌদি আরব ও ইরান দীর্ঘদিন ধরে বিরুদ্ধে চলতে চলতে সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে। মূলত এই চুক্তিতেই ইয়েমেনের বর্তমান পরিস্থিতির অবসান হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও এখনও সম্পূর্ণরূপে কিছুই বলা যায় না। এর কারণ হলো আজ অবধি বহু চুক্তি হয়েছে এবং চুক্তি হওয়ার পরেও চুক্তির লঙ্ঘনও হয়েছে। একে অপরকে এর বিপরীতে দোষারপ করেছে। চুক্তির প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে প্রক্সি যুদ্ধে লড়াইরত দুটি স্থানীয় দল বন্দিদের বিনিময়ে সম্মত হয়। সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সংবাদে জানা যায়, ইয়েমেনে শিয়াপন্থি হুথি বিদ্রোহীদের আর অস্ত্র সরবরাহ করবে না ইরান। মিত্রতা পুনঃস্থাপনের পর দেশটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দীর্ঘদিনের এ দ্বন্দ্বে আরব দেশ দুটির কোনো লাভই হয়নি। উপরন্তু বিভক্তি বেড়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্য অস্থির হয়েছে। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ নাম ইয়েমেন। অথচ আজ এই দেশটিই নির্মম পরিহাসের শিকার। ২০১৪ সালে হুথি বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারকে উৎখাত করে দেশটির উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

২০১৫ সালে ইয়েমেনি সরকারকে সহযোগিতা এবং বিদ্রোহীদের দমনের লক্ষ্যে ইয়েমেন যুদ্ধে যোগ দেয় সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। বর্তমান ইয়েমেনে দুই শাসকগোষ্ঠীতে চলছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক সহযোগিতার ওপর দেশটির দক্ষিণাঞ্চল এখনও মনসুর হাদিও নেতৃত্বাধীন সরকারের নিয়ন্ত্রণে এবং উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হুথি বিদ্রোহীদের। এখানেই দু’দেশের মধ্যে ক্ষমতা এবং আধিপত্য শক্তি দেখানোর লড়াই। এর ফল ভোগ করছে সেখানকার সাধারণ মানুষ। বহু মানুষের প্রাণ গেছে এবং বাড়িঘর হারিয়েছে। এখন তারা মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করছে। এখন পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ এই যুদ্ধে হতাহত হয়েছে। আশ্রয়হীন হয়েছে। পুষ্টির অভাবে ভুগছে সেদেশের শিশু। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা (ইউনিসেফ) জানায়, ইয়েমেনে দশক ধরে চলা সহিংসতায় শিশুরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। কারণ, ২০১৫ সালের পর কমপক্ষে ১০ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। ঘরছাড়া হয়েছে আরও লাখ লাখ মানুষ। আজ ইয়েমেন পরিচিতি পেয়েছে দুর্ভিক্ষের দেশ হিসেবে। শিশুযোদ্ধা নিহতের খবরও আছে। জাতিসংঘ জানায়, ২০২০ সালে হুথিদের নিয়োগ করা ১৪০৬ জন শিশুযোদ্ধা নিহত হয়। মানবতা, মানবাধিকার এ শব্দগুলো মানবসভ্যতার মাপকাঠির নির্ধারক হলেও আজকের বিশ্বে তা বেমানান। স্বার্থ আর বিভেদে এসব শব্দ অবহেলিত। মানবাধিকার শব্দটি দ্বারা কোনো দেশে জন্মগ্রহণকারী কোনো শিশুর প্রাপ্য অধিকারকে বোঝায়। এই প্রাপ্য অধিকারের সংজ্ঞা আবার মানুষ থেকে মানুষ ভিন্ন হয়ে থাকে। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের পর থেকে বেড়ে ওঠার বিভিন্ন পর্যায়ে একজন মানুষ এই অধিকারগুলো পাওয়ার অধিকার রাখে বলে এগুলোকে মানবাধিকার বলে। একজন মানুষের প্রাপ্য অধিকার বলতে বেশ কিছু মৌলিক অধিকারকে বোঝায়। তবে সত্যিকার অর্থে পৃথিবীর অনেক দেশেই আজ মানবাধিকার মারাত্বকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের অধিকার ঘটে।

যুদ্ধ বিগ্রহে যেসব দেশ বিপর্যস্থ সেসব দেশে মানবাধিকারের কোনো বালাই নেই। অভিবাসীরা বিভিন্ন দেশে অমানবিক জীবনযাপন করছে। পৃথিবীতে বহু মানুষের নেয়া জন্মই যেন আজন্ম পাপ। ন্যূনতম অধিকারগুলোও তারা পায় না। তাছাড়া জাতিতে জাতিতে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিভেদ, যুদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগেই আছে। ইয়েমেনের অভ্যন্তরে এই যুদ্ধাবস্থা এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে, সেখানে মানবিক সংকট এখন চরমে। খাদ্য, চিকিৎসাবিহীন মারাত্মক মানবিক সংকটে থাকা ইয়েমেনের হাজার হাজার শিশুর জীবনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের হামলায় ইয়েমেন শতাব্দীর ভয়াবহতম সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। অন্তর্দ্বন্দ্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের লাখ লাখ শিশু স্কুলে যেতে পারছে না। তারা শিক্ষাগ্রহণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এ গৃহযুদ্ধের কারণে ইয়েমেনের এ যুদ্ধের কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম অবনতি ঘটেছে। সেখানে খাদ্যাভাব এত তীব্র হচ্ছে, যেখানে তীব্র খাদ্যসংকটের কারণে ক্ষুধার জ্বালায় শিশুদের এবং বড়দেরও কষ্ট পেতে হচ্ছে এবং অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। শিশু আমালের মতো বহু শিশু দুর্ভিক্ষের কবলে রয়েছে ইয়েমেনে। সংঘাত বা যুদ্ধ যা যা করতে পারে ইয়েমেনে তার সবই ঘটছে। অবস্থাকে শতাব্দির চরম মানবিক সংকট বলা হচ্ছে। সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের হামলায় সেখানে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে বহু বেসামরিক মানুষ। ধ্বংস হয়ে গেছে দেশটির স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সরবরাহকেন্দ্র, পানি শোধন কেন্দ্রসহ সব ধরনের সেবামূলক স্থাপনা। সেখানকার শিশুরা জানে না তারা পরবর্তী সময়ে কি খাবে অথবা তাদের সেই খাবার কি হবে বা কোনো উৎস থেকে তাদের খাদ্যসরবরাহ হবে। হাসপাতালগুলোতে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুরা দিন পার করছে।

ইয়েমেনের এ পরিস্থিতিতে খুব তাড়াতাড়িই এই যুদ্ধাবস্থা বন্ধ করা প্রয়োজন ছিল। না হলে দেশটি শতাব্দীর ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষের শিকার হতে পারে বলে জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সেই সম্ভাবনা আছে আবার নেইও। কারণ বিশ্ব বিবেক যদি জাগ্রত হয়, তাহলে এটি সম্ভব হবে। ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের রাজধানী সানা দখলের পর অবরুদ্ধ সরকারের সমর্থনে সৌদি আরব ও তার মিত্র জোট ২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে যে অভিযান চালিয়ে আসছে, তাতে হাজার হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে। এদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। এছাড়া লাখ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংসের পাশাপাশি দেশটিতে ভয়াবহ অর্থ তারল্যের সৃষ্টি হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। যা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সাধারণত ঘটতে পারে ইয়েমেনে সেটাই ঘটছে। এ পরিস্থিতি তৈরির জন্য যুদ্ধের রণনীতিকেই দায়ী করা হচ্ছে। বলা চলে যুদ্ধ আর অবরোধে পুরোপুরি বিধ্বস্ত ইয়েমেনের সমাজ। এখনও আশপাশের বাজারগুলোতে খাবার জিনিস পাওয়া যায়। তবে সেগুলোর দাম এত বেশি যে অধিকাংশ বাবারই তার ক্ষুধার্ত সন্তানের জন্য খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। সুতরাং ইয়েমেনের এ কঠিন পরিস্থিতিতে এবং বর্তমানের ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যেকার চলমান যুদ্ধের ভেতরেও সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যেকার এই পুনঃমিত্রতা নিঃসন্দেহে চীনকে কূটনৈতিক সাফল্যে এগিয়ে রাখবে। এই চুক্তি করাটাই এতদিন চ্যালেঞ্জের বলে মনে হচ্ছিল এবং কোনোভাবেই ইয়েমেনে শান্তি ফেরানো যায়নি। যদি চুক্তিটি বাস্তবায়িত হয় এবং শান্তি বজায় রাখে, তাহলে ইয়েমেনসহ আরও বড় বড় সমস্যাগুলোর সমাধানও আসবে। তার চেয়ে বড় কথা এটি একটি বার্তা যে কীভাবে শান্তি ফেরাতে হয়।