স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নারীরা

আফরোজা নাইচ রিমা, উপ-প্রকল্প পরিচালক, তথ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা

প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

স্মার্ট বাংলাদেশ হবে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সোসাইটির ওপর ভিত্তি করে। আর সমাজ উন্নয়ননির্ভর করে পুরো জনসংখ্যার ওপরে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন; নারী ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন। এই হিসাবে বর্তমানে প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষ আছেন ৯৮.০৪ জন। সাশ্রয়ী, টেকসই ও জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে ‘প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি’তে অবশ্যই নারীর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অধিকতর অংশগ্রহণের কারণে বাংলাদেশে জেন্ডার সমতাসহ সব ক্ষেত্রেই উন্নতি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে লিঙ্গ সমতায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে নারীর অনেক ভূমিকা রয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে নারীর অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে হলে নারীদের প্রযুক্তিশিক্ষার হার বাড়াতে হবে। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনার জন্য বিভিন্ন সুযোগ দিতে হবে। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে মাত্র ৩০ শতাংশ নারী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। আর দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পেশাজীবীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ১২ শতাংশ। স্মার্ট বাংলাদেশের নারীরা এখন অনেক এগিয়ে গেছে। তারা এখন গ্রামে বসে মোবাইলের সাহায্যে অনলাইনে ব্যবসা করছে। বিকাশে টাকা লেনদেন করছে। মেয়েরা অনলাইনে ক্লাস করছে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও বর্তমানে ডিজিটাল সেন্টার থেকে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ডিজিটাল সেন্টার থেকে দেশের নাগরিকরা ৮০ কোটির বেশি সেবা গ্রহণ করেছে। বিশ্বে অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। প্রায় সাড়ে ছয় লাখ প্রশিক্ষিত ফ্রিল্যান্সার আউটসোর্সিং খাত থেকে অন্ততপক্ষে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। মাত্র ১৩ বছরে ৬৫ লাখ থেকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন ১৩ কোটির বেশি এবং মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটির ওপরে।

জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৮ হাজার ৮০০টির বেশি ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এসব সেন্টার থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৭০ লাখেরও অধিক সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত দেশের নাগরিকরা ৮০ কোটির বেশি সেবা নিয়েছেন। এতে নাগরিকদের ৭৮.১৪ শতাংশ কর্মঘণ্টা, ১৬.৫৫ শতাংশ ব্যয় এবং ১৭.৪ শতাংশ যাতায়াত সাশ্রয় সম্ভব হয়েছে। এছাড়া পেপারলেস কমিউনিকেশন চালু করার লক্ষ্যে ই-নথির মাধ্যমে ২ কোটি ৪ লাখের বেশি ফাইলের নিষ্পত্তি করা হয়েছে। ই-নামজারি সিস্টেমের মাধ্যমে ৪৫.৬৮ লাখের বেশি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে অনলাইনে।

এ ধরনের নানান সুবিধা পাওয়ায় দেশে স্টার্টআপ ইকো সিস্টেম গড়ে উঠেছে। প্রায় আড়াই হাজার স্টার্ট আপ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। যারা প্রায় আরও ১৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। মাত্র ৭ বছরে এ খাতে ৭০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে। ১৩ বছর আগে ডিজিটাল অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। আর বর্তমানে তা ১.০৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের লক্ষ্য ২০২৫ সালে আইসিটি রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলার এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আইসিটি খাতে কর্মসংস্থান ৩০ লাখে উন্নীত করা। আইসিটি পার্কে দেশি-বিদেশি ১৯২টি প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে আরও ৩৫ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হবে। জরুরি সেবার মাধ্যমে সুবিধা পাচ্ছে জনগণ। জরুরি সেবা-৯৯৯, সরকারি তথ্য ও সেবা ৩৩৩, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ১০৯, দুদক ১০৬, দুর্যোগের আগাম বার্তা ১০৯০, লক্ষ্য এবার স্মার্ট বাংলাদেশ। দেশে ই-কমার্সের ৮০ ভাগ ব্যবসা পরিচালনা করছেন নারীরা। ফ্রিল্যান্সিংয়ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। নারীর শান্তি ও নিরাপত্তা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ১,৩২৫ নাম্বার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে যা নারীর শান্তি ও নিরাপত্তা-ডব্লিউপিএস এজেন্ডা প্রতিষ্ঠা করেছে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধান ও নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে। সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: রাষ্ট্র শুধু ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করবে না, অথচ একই অনুচ্ছেদের (২) ধারায় বলা হয়েছে : নারীদের সমান অধিকার থাকবে রাষ্ট্র ও জনজীবনের সব ক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে। সরকার নারী নীতি ২০১১ প্রণয়ন করেছে এবং নীতিমালায় নারীর সামগ্রিক উন্নয়ন ও মূলধারার আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের ক্ষমতায়নের পথে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা, ব্যবসা, খেলাধুলা, সশস্ত্র বাহিনী প্রভৃতি খাতে তাদের বর্ধিত অংশগ্রহণ ও অবদান বাংলাদেশের আর্থসামাজিক দৃশ্যপটকে বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশে নারীরা এখন সরকারের সচিব, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং অনেক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। কারিগরি শিক্ষায় বর্তমানে শতভাগ ছাত্রদের উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। ছাত্রদের ক্ষেত্রে এ হার ৭০ শতাংশ। ডিপ্লোমা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং লেভেলে ভর্তির ক্ষেত্রে নারীদের ১০ শতাংশ কোটা বৃদ্ধি করে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক উপবৃত্তি প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে ৪০ শতাংশ ছাত্রীদের উপবৃত্তি, বই ক্রয়, ফরম পূরণ, টিউশন ফি-এর অর্থ উপকারভোগী ছাত্রীদের Electronic Funds Transfer (EFT)-এর মাধ্যমে অর্থ প্রদান করা হচ্ছে। এ উপবৃত্তি প্রদানের ফলে গরিব নারী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় Improving Access and Retention Through Harmonzed Stipend Program শীর্ষক কর্মসূচির মাধ্যমে বৃত্তি ও মেধাবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের শ্রমশক্তির আকার কম বেশি ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে নারী আছে কম বেশি ২ কোটি। শ্রম বাজারে নারীর অবদান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের ৮ কোটি ২২ লাখ নারীর কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশ ও জাতির দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব হতো। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি (এনএসডিপি-২০১১)-এর আলোকে জেন্ডার সংবেদনশীলতা ও নারী সার্বিকায়ন নিশ্চিত করে শ্রমবাজারের চাহিদা উপযোগী টিভিইটি ও দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়নে আরও কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ করা দরকার।

গ্রামীণ জীবনেও আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে প্রতিটি ইউনিয়নে চালু করা হয়েছে ডিজিটাল সেন্টার। এই আমূল পরিবর্তনের সারথী হয়ে দেশের নাগরিকদের নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নারী উদ্যোক্তারা। যারা সংখ্যায় দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে নারী উদ্যোক্তারা ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন। নাগরিকদের সেবা প্রদান, তাদের জীবনমান উন্নয়ন করার পাশাপাশি আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে, এসব নারী উদ্যোক্তারা। সেই সঙ্গে তারা প্রান্তিক অঞ্চলে নতুন নতুন উদ্যোক্তাও সৃষ্টি করছেন।

ডিজিটালাইজেশন হওয়ার পরে বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশে নাগরিকের ব্যাংকিং সেবায় অন্তর্ভুক্তি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালে যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মাত্র ৩১ শতাংশ আর্থিক পরিষেবার আওতায় ছিল। সেটা গত এক দশকেরও কম সময়ে ৫৩ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই বৃদ্ধির হার ক্রমবর্ধমান। ফিনটেক (ফাইন্যান্সিয়াল টেনোলজি)-এর মতো আর্থিক পরিষেবার ডিজিটাল সেন্টারগুলোয় অন্তর্ভুক্তি নাগরিকের হয়রানি হ্রাস করছে, তাদের সেবাপ্রাপ্তিকে করেছে আরও ত্বরান্বিত, আরও সহজ। মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস (MFS)-এর মতো পরিষেবামূলক ব্যবস্থার ফলে ব্যাংকিং সেবা এখন পৌঁছে যাচ্ছে নাগরিকের দোরগোড়ায়। সামগ্রিকভাবে এই ডিজিটালাইজেশন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য রাখছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে নারীরা। নারীর এগিয়ে যাওয়াই দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির এক অপ্রতিরোধ্য যাত্রা। তাদের অগ্রযাত্রার ফলেই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৭ম, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কর্মীদের প্রায় ৭০ শতাংশই নারী, করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়েও তারা ছিলেন সম্মুখ সারির যোদ্ধা। তৈরি পোশাক আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি সেখানেও ৮০ শতাংশের বেশি নারী কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত এসব নারীর প্রতিটি বুননে ফুটে উঠেছে আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের অবয়ব এবং নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এই অংশগ্রহণমূলক ধারাবাহিকতায় রচিত হবে- আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, সোনালি সাহিত্যভিত্তিক ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্বাধীনভাবে সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশের সুযোগ দানে নারী এবং পুরুষকে একযোগে কাজ করতে হবে। শুধু অর্থনীতিই একটি দেশ বা জাতির উন্নয়নের সূচক হতে পারে না, এর পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়নের সূচকও সমান গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, চিত্রকর, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন পেশাজীবীর স্বাভাবিক নিয়মে শিল্পচর্চায় এবং যার যার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। নতুন নতুন চিন্তাভাবনা, ধারণার উন্মেষের ফলেই সম্ভব হবে স্মার্ট মানুষ, স্মার্ট পরিবার এবং স্মার্ট সমাজ সর্বোপরি স্মার্ট বাংলাদেশ। নারীরা স্মার্ট বাংলাদেশের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত হলেই আগামী ৮ মার্চ ২০২৩ আন্তর্জাতিক নারী দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল- ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’ হবে সার্থক এবং টেকসই।

* পিআইডি ফিচার