ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আমেরিকার ব্যাংক খাতে অস্থিরতা বাংলাদেশ কী বার্তা পেল

এম এ মাসুম, ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক, [email protected]
আমেরিকার ব্যাংক খাতে অস্থিরতা বাংলাদেশ কী বার্তা পেল

২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ছিল প্রায় ২৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা আমাদের জিডিপির প্রায় ৬০ গুণ বেশি। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন অর্থনীতির যেকোনো বিপর্যয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। গত এক সপ্তাহ ধরে সারা বিশ্বে বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে মারাত্মক অস্থিরতা বিরাজ করছে। বড় খবর হচ্ছে, অর্থ সংকটে ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে সম্প্রতি দেউলিয়া হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় দুটি ব্যাংক-সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) ও সিগনেচার ব্যাংক। পতনের ঝুঁকিতে দেশটির আরও একটি ব্যাংক-ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক। এ অস্থিরতা ইউরোপের ব্যাংকগুলোতেও দেখা ছড়িয়ে পড়ছে।

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতন যেন এক বিরাট ভূমিকম্প, যা প্রায় ৮ হাজার মাইল দূরে থাকা বস্তুর ওপরর তরঙ্গের মতো খেলে গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম বৃহত্তম ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি)। ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যাঙ্কিং নিয়ন্ত্রকরা ১০ মার্চ শুক্রবার, বিশ্বের বৃহত্তম কিছু টেক কোম্পানির ঋণদাতা সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বন্ধ করেছে। মূলধন সংকটের কারণে বন্ধ করা হলো সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক। এটি ২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের পর ব্যর্থ হওয়া বৃহত্তম ব্যাংক। মার্কিন নিয়ন্ত্রকরা সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বন্ধ করেছে এবং এর আমানতের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। একটি পদক্ষেপ যা ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণে গ্রাহকের আমানতে প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন ডলার রাখে। পাশাপাশি একটি নাটকীয় ৪৮ ঘণ্টার পরে এই ব্যাংক অবশেষে বন্ধ করা হয়। এ ৪৮ ঘণ্টায় দেখা যায় এসভিবির শেয়ারের দামে বিপুল পতন দেখা যায়। এর কারণ হিসেবে দেখা যায় যে ভীত গ্রাহকরা ব্যাংকে ভিড় করে সেখানে রাখা নিজেদের টাকা তুলে নিচ্ছেন।

১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক স্টার্টআপ এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালের অর্থ সাহায্যে তৈরি টেক ওয়ার্ল্ডকে সেবা দিয়ে আসছে। ব্যাংকটি কর্মকর্তার সংখ্যা ৮ হাজার ৫২৮ এর মতো। একইসঙ্গে ভিসি এবং প্রাইভেট ইক্যুইটি ফার্মগুলোকে একাধিক সেবা প্রদান করে তারা। এর পাশাপাশি উচ্চ নেট-ওয়ার্থের মানুষদের জন্য ব্যক্তিগত ব্যাংকিং সেবাও প্রদান করে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের দুটি সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার প্রধান যে কারণগুলো রয়েছে তা হলো, নীতি সুদহার বৃদ্ধি, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (বিটকয়েনসহ ডিজিটাল মুদ্রা) বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, স্টার্টআপ খাতে ছোট উদ্যোগে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ, আগ্রাসী ঋণ বিতরণ, গৃহায়ন খাতে বড় আকারের বিনিয়োগ। অনেকে বলছেন, ২০০৮ সালের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতে এটি বড় ঘটনা। এসভিবি ব্যাংকটির এক দিনে শেয়ারপতন ঘটে ৬০ শতাংশ। এতে আমানতকারীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমানতকারীরা দীর্ঘলাইনে দাঁড়িয়ে এক দিনেই ব্যাংক থেকে ৪২ বিলিয়ন ডলার তুলে নেয়।

এসভিবির গ্রাহকদের মোট আমানতের মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ বিমাকৃত, বাদবাকি আমানতের কোনো বিমা নেই। সে ক্ষেত্রে একজন আমানতকারীর যত অর্থই জমা থাকুক না কেন, তিনি বিমাকৃত মাত্র ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার ফেরত পাবেন। বাদবাকি বিমাহীন আমানতের জন্য পাবেন রিসিভারশিপ সার্টিফিকেট, যা ব্যাংকের সহায়-সম্বল বিক্রি করার পর নগদায়নের ব্যবস্থা হতে পারে, যা এখন অনিশ্চিত। নিউইয়র্কের সিগনেচার ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাংকটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়। ২০২২ সালের শেষে এসে ব্যাংকটির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১১১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সিতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করে ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়ে যায়।

তহবিল সংকট ব্যাংকের অনেক গ্রাহকদের ওপর তাদের আমানত তুলে নেয়ার জন্য চাপ তৈরি হয়। ফলে ব্যাংক তাদের বিনিয়োগ কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। বুধবার এসভিবি বলেছে যে ২১ বিলিয়ন ডলারের বন্ড সম্পদ বিক্রি করার পরে এটি প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে। ১০ মার্চ, ইউএস ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি) বলেছে যে ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল প্রোটেকশন অ্যান্ড ইনোভেশন দ্বারা ব্যাংকটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপরেই গ্রাহকদের মধ্যে ভয় আসে যে ব্যাংকে নগদের সমস্যা রয়েছে। ২ দিনেরও কম সময়ে এসভিবি গ্রাহকদের তাদের টাকা না তোলার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করেছিল।

এসভিবির বিমাকৃত আমানতকারীরা তাদের বিমাকৃত আমানত পাবেন। অন্যদিকে এফডিআইসি ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করবে এবং অবিমাকৃত আমানতকারীদের লভ্যাংশ প্রদান করবে। এফডিআইসি আমানতকারীদের আশ্বস্ত করেছে যে, শাখা খোলার পরে তারা তাদের বিমাকৃত আমানতগুলোতে লেনদেন করতে পারবে এবং পুরোনো চেকগুলোও দেয়া হবে। যাহোক, এসভিবি এর আকস্মিক পতন সিলিকন ভ্যালি উদ্যোক্তাদের অন্ধকারে ফেলে দিয়েছে। অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসন মার্কিন নিয়ন্ত্রকদের প্রতি তার ‘পূর্ণ আস্থা’ প্রকাশ করেছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে আশ্বাস দিয়েছেন, তা শুধু ধসে পড়া দুটি ব্যাংকের গ্রাহকদের জন্যই নয়। তবে প্রেসিডেন্টের আশ্বাস গ্রাহকদের মধ্যে কতটুকু আস্থা ফেরাবে তা বলা মুশকিল।

ফেডারেল ডিপোজিট ইন্সিওরেন্স কর্পোরেশন সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের কর্মীদের ৪৫ দিন কাজের সুযোগ দিয়েছে। এ অন্তর্র্বর্তী সময়ে সিলিকন ভ্যালির কর্মচারীরা দেড় গুণ বেশি বেতন পাবেন। এক ই-মেইলে কর্মচারীদের বলা হয়েছে, কাজ করে যেতে। শুধু জরুরি কাজের এবং ব্রাঞ্চ কর্মীদের আসতে বলা হয়েছে। এর বাইরে যাদের ঘরে বসে কাজ করা সম্ভব, তাদের সেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বন্ধ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই তিনদিনের মাথায় গত ১২ মার্চ নিউইয়র্কের সিগনেচার ব্যাংক বন্ধের ঘোষণা দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। নিউ ইয়র্কের ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস জানায়, গত বছরের শেষ নাগাদ সিগনেচার ব্যাংকের সম্পদ ছিল ১১০ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। আমানতের পরিমাণ ছিল ৮৮ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। হঠাৎ করে এ ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণায় বিপাকে পড়ে যান আমানতকারীরা। সিগনেচার ব্যাংকের অনেক গ্রাহকই ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ ব্যাংকের আমানতের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এসেছে এ খাত থেকে। কিন্তু ডিসেম্বরে তারা ৮ বিলিয়ন ডলারের আমানত কমানোর ঘোষণা দেয়।

সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার উভয় ব্যাংকই একটি খাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। উচ্চ সুদহারের কারণে সম্পদের মূল্য চাপের মধ্যে ছিল এবং ব্যাংক দুটির বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছিল। সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংকের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র, এশিয়া এবং ইউরোপজুড়ে ব্যাংকের শেয়ারের দরপতন হয়েছে, কারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকিং খাতের অবস্থা নিয়ে এখন উদ্বিগ্ন। বিশেষভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট ব্যাংকগুলো। বিনিয়োগকারীদের ধারণা, ব্যাংক দুটির পতন অন্যান্য ফার্ম বা কোম্পানিগুলোর জন্যও বিপদ সংকেত। তবে বেশিরভাগ ব্যাংকের নজর যেহেতু ব্যাপকভাবে বিভিন্ন খাতে রয়েছে, হাতে প্রচুর পরিমাণে নগদ অর্থ রয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুমান হলো- ব্যাংকিং খাতের বাকি অংশে ঝুঁকি কমই রয়েছে। তবে ব্যাংক খাতের এই ব্যর্থতা আরও যে বিষয়টিকে সামনে এনেছে, তা হলো- ব্যাংকগুলোকে যেরকম দেখা যাচ্ছে, সেগুলো তার চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার নেতিবাচক ফল হিসেবে জাপানের টপিক্স ব্যাংকের সূচকের পতন হয়েছে সাত শতাংশ। টপিক্সের এ পতন গত ৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড়। এ ছাড়া জাপানের মিতসুবিশি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের শেয়ারদর কমেছে ৮ দশমিক ১ শতাংশ। পতনের হাওয়া লেগেছে ইউরোপেও। গত সোমবার স্পেনের স্যানটানডার ও জার্মানির কমার্স ব্যাংকের শেয়ারদরও কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি। দরপতনের মধ্যে পড়েছে সুইজারল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের শেয়ার। গত বুধবার ব্যাংকটির শেয়ারদর কমেছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। যদিও ক্রেডিট সুইসের ২০২১ ও ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদনও দরপতনের একটি কারণ। প্রতিবেদন বলছে, গত বছর ক্রেডিট সুইস লোকসান দিয়েছে ৮০০ কোটি ডলার। তবে সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচারের ঘটনায় ক্রেডিট সুইসের ওপর বিনিয়োগকারীরা পুরোপুরি আস্থা হারিয়ে ফেলে।

নগদ অর্থের সংকটে পড়া আমেরিকান ব্যাংকগুলো গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের কাছ থেকে ৩০ হাজার কোটি ডলার ধার করেছে। তবে এ অর্থের প্রায় অর্ধেক পেয়েছে দুটো হোল্ডিং কোম্পানি, যাদের মালিকানাধীন দুই ব্যাংক মার্কিন কর্তৃপক্ষ এক সপ্তাহের মধ্যে বন্ধ ঘোষণা করেছে। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে উদ্ধৃত করে ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ফেডারেল রিজার্ভের তথ্য বলছে, সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ও সিগনেচার ব্যাংকের দুই হোল্ডিং কোম্পানি সব মিলিয়ে ১৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলার ধার করেছে। এ দুটি ব্যাংকের ধসের ঘটনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আর্থিক বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তবে ৩০ হাজার কোটি ডলারের বাকি অর্থ আর কোন কোনো ব্যাংক ধার করেছে কিংবা কতগুলো ব্যাংক অর্থ ধার করেছে, সে ব্যাপারে ফেডারেল রিজার্ভ কিছু জানায়নি।

সুদহার বৃদ্ধির কারণে সরকারি বন্ডে বিনিয়োগকারীদের অনেকেই লোকসানের মুখে রয়েছেন; তাদের শেয়ারের দর কমে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিনিয়োগকারীরা নড়েচড়ে বসেছেন, যেটি ব্যাংকের শেয়ারের দরপতনের একটি কারণ। সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংকের দুই ধরনের গ্রাহক রয়েছে। সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে বেশি কাস্টমার হলো স্টার্ট-আপ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। আর সিগনেচার ব্যাংক করপোরেট সেক্টরে বেশি মনোযোগ দিয়ে আসছিল। আর এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আমানত রক্ষা সীমা আড়াই লাখ ডলারের বেশি।

বিবিসি বলছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত আমানত রক্ষার নিশ্চয়তা দিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট, ফেডারেল রিজার্ভ এবং এফডিআইসি যে পদক্ষেপ নিয়ে নিশ্চয়তা দিচ্ছে, সেখানে আড়াই লাখ ডলারের বেশি যারা আমানত রেখেছেন, তারাও অর্থ হারাবেন না।

পতনের ঝুঁকিতে পড়েছে দেশটির আরেক ব্যাংক ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক। তবে সানফ্রান্সিসকোভিত্তিক এ ব্যাংকের পতন ঠেকাতে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্যাংক। জে পি মরগ্যান ও সিটি গ্রুপের নেতৃত্বে ১১টি ব্যাংক ফার্স্ট রিপাবলিককে ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলার আমানত দিচ্ছে। তিন দিনের ব্যবধানে দুটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতে একধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আরও ১৮৬ মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে, আমানকারী যদি দ্রুত অর্থ তুলে নেন, তাহলে সেই ব্যাংকগুলোও বন্ধ করে দিতে হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত আমানত বিমা করা থাকলেও এই ব্যাংকগুলোতে বিমাবিহীন আমানতের পরিমাণ অনেক বেশি। সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ নেটওয়ার্কের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের সূত্রে এনজেড হেরাল্ড বলেছে, এই ১৮৬টি ব্যাংকের বিমাবিহীন আমানকারীরা আতঙ্কিত হয়ে আমানত তুলে নিতে পারেন। এ ছাড়া এসব ব্যাংকের সম্পদের বড় একটি অংশ সরকারি বন্ডের মতো অস্থিতিশীল ব্যাংকে রক্ষিত আছে। ফলে সুদহার হ্রাসবৃদ্ধির কারণে এসব বন্ড হঠাৎ করে অলাভজনক হয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়।

যুক্তরাষ্ট্রে ৩ দিনের মধ্যে দুই ব্যাংকের পতনের পর এশিয়া-ইউরোপের ব্যাংকগুলোর শেয়ারের সূচক উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংকের পর এবার ডুবতে বসেছে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যাংক ক্রেডিট সুইস। জানা যায়, সুইজারল্যান্ডের ক্রেডিট সুইস ব্যাংক কিনে নিতে যাচ্ছে, দেশটির আরেক বৃহৎ ব্যাংক ইউবিএস। ৩২৩ কোটি ডলারে ১৬৭ বছরের পুরোনো ব্যাংক ক্রেডিট সুইসকে কিনে নিচ্ছে ইউবিএস। সেই সঙ্গে তারা ব্যাংকটির ৫৪০ কোটি ডলারে ক্ষতির দায়ও নেবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমৃদ্ধশালী সুইস ব্যাংক অর্থপাচারের অভিযোগ, গুপ্তচরবৃত্তিসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হয়েছে। তবে এবার নতুন করে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে ব্যাংকটি। গত বুধবার তাদের শেয়ারের সূচক কমেছে ২৪ শতাংশ। ফলে তাদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেই এখন ঋণ নিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে তারা।

গ্রাহকদের আস্থা একবার হারিয়ে গেলে বৃহৎ ব্যাংক হলেও তা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়া। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে তার প্রমাণ পাওয়া গেল সাম্প্রতিক সময়ে। গত বছরের শেষ দিকে দেশের ইসলামি ধারার কয়েকটি ব্যাংক নিয়ে নেতিবাচক তথ্য প্রকাশ করে কয়েকটি গণমাধ্যম। সে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে গুজবের ডালপালা। তারপর থেকেই গ্রহকদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে এবং আমান তুলে নেয়ার হিড়িক পড়ে যায়। দেশের সমগ্র ব্যাংক খাতে অস্থিতরা দেখা দেয়। যাহোক পরবর্তী সময়ে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়েছে।

তবে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের সমস্যা বহুমাত্রিক। ২০২২ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং খাতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করার লক্ষ্যে চারটি চালক যেমন- শ্রেণিকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধন পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত এবং প্রভিশনের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে ১০টি দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকার বাইরেও আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংক দুর্বল অবস্থায় আছে যাদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। অন্যদিকে একের পর এক বিশেষ ছাড়ের মধ্যেও খেলাপী ঋণের পাহাড় তৈরি হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কারণে ব্যাংক বন্ধ হয়েছে, সেসব কারণ বাংলাদেশে নেই। ফলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে ঝুঁকি নেই। বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুশাসনের ঘাটতি। ব্যাংকগুলোর বড় অঙ্কের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়া ও ব্যাংকের হিসাব পদ্ধতিতে বড় ধরনের ফাঁকি। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু সংকট যতই হোক ইমেজ রক্ষার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যাংকই বন্ধ হতে দেয় না।

থেকে বাংলাদেশের দুটি বিষয় শিক্ষণীয় আছে। একটি হচ্ছে, আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধ করা ও আমানতের বিপরীতে বিমা সুবিধা বাড়ানো। যুক্তরাষ্ট্রে আমনতকারীদের ১২ লাখ ডলার পর্যন্ত আমানত বিমার আওতায় আছে। বাংলাদেশে আছে ২ লাখ টাকা।

বিশ্লেষকরা জানান, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর যে অবস্থা তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি নীতি সহায়তা না দিত, তাহলে অনেক ব্যাংক সমস্যায় পড়ত। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত খেলাপিঋণ অনেক বেশি। এগুলোকে আড়ালে রেখে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো দেখানো হচ্ছে। সংকট যতই হোক বাংলাদেশে ব্যাংক বন্ধ করা হয় না। নীতি সহায়তা দিয়ে সচল রাখা হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫১ বছরেও কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি, আশা করা যায়, আগামীতেও কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। ব্যাংকগুলোয় জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে। সন্দেহ নেই আলোচ্য ঘোষণা জনমনে তৈরি হওয়া উদ্বেগের কিছুটা প্রশমন ঘটাবে; কিন্তু এতে কি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অস্থিরতার অবসান ও সমস্যার সমাধান আসবে?

ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা, গতিশীলতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনার স্বার্থে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে এবং নতুন খেলাপিঋণ সৃষ্টির পথ বন্ধ করতে হবে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে তা যথাযথ পর্যালোচনা করতে হবে। প্রদত্ত ঋণকে যথাযথ তদারকি করতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসন শক্তিশালী করতে হলে বিদ্যমান আইনের সংস্কার প্রয়োজন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা শক্তিশালী করতে হলে এ ধরনের উদ্যোগ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত