ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রমজানে আমিষ ঘাটতি, নিরামিষ দুর্লভ

মো. আরফাতুর রহমান, শিক্ষক ও কলামিস্ট, [email protected]
রমজানে আমিষ ঘাটতি, নিরামিষ দুর্লভ

খাদ্য মানুষের জীবনে অপরিহার্য উপাদান। পুষ্টিগুণের ওপর ভিত্তি করতে সুস্থ স্বাস্থ্য নির্ভরশীল। তাই সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতি মানুষের খাদ্য নিশ্চয়টা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবার বলা চলে এক রকম হিমশিমই খাচ্ছে। রমজান মাস শুরু হচ্ছে, ফলে নিম্নবিত্তদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিচ্ছে।

ব্রয়লার মুরগির মাংস বাংলাদেশে সবচেয়ে সস্তা ও সহজলভ্য আমিষের উৎস। অথচ সেই ব্রয়লার মুরগির দাম এখন প্রতি কেজি ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা ছুঁইছুঁই। মাস তিনেক আগেও যেখানে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৩০ থেকে ১৮০ টাকা। ধাপে ধাপে বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকা। ব্রয়লারের এই দাম সোনালি জাতের মুরগিকেও উসকে দিয়েছে। এ জাতের মুরগির দাম আরও বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৪০ থেকে ৪০০ টাকা। এ ছাড়া দেশি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে- ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে। গরুর মাংস ও মুরগির দামে হতাশ হয়ে ক্রেতাদের মাছের বাজারে গিয়ে দামের আগুনে পুড়তে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম ৪৫ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষরা তাদের দৈনিক আমিষ গ্রহণে কাটছাঁট শুরু করেছেন। এর ফলে জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গরুর মাংস অনেকের জন্য দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়েছে, এখন মাছেও হাত দেয়া যায় না। যেভাবে দাম বাড়ছে তাতে গরিবের আমিষের উৎস পাঙাশ মাছ ও ফার্মের মুরগিও সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। এভাবে দামের চোটে পাতে আমিষের টান বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রকাশ, বড় বাজারগুলোতে মাসখানেক আগেও হাড়সহ গরুর মাংস কেনা যেত ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায়। সেই দাম গেছে গত সপ্তাহ তিনেক আগে। এখন কেজিতে খরচ পড়ছে ৭৫০-৮০০ টাকা। তবে পাড়া-মহল্লায় এই দাম আরও বেশি। এ ছাড়া খাসির মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। বলাবাহুল্য, গরুর মাংসের এই আকাশচুম্বী দামের কারণে মধ্যবিত্তদের অনেকেই ভিড় করছেন ব্রয়লার মুরগি ও মাছের বাজারে। তবে আগে থেকেই তেঁতে আছে ব্রয়লার আর মাছের বাজার।

মাছ-মাংসের দাম ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের প্রাণিজ আমিষের কিছুটা চাহিদা পূরণ করছিল ডিম। কয়েক মাস ধরে ওই ডিমের রেকর্ড দামে এসব মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণ নাগালের বাইরে চলে গেছে। ফলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের আমিষের চাহিদায় বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

আমিষের আরেক উৎস দুধ। বাজারে তরল ও গুঁড়া- এ দুই ধরনের দুধ পাওয়া যায়। এর মধ্যে গত বছরে কয়েক দফায় দুধের দাম বেড়েছে। তরল দুধের দাম গত ১ বছরে লিটারে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) এক লিটার দুধের দাম এখন ৯০ টাকা। টিসিবির হিসাবে গত ১ বছরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে ২৭ থেকে ৩৫ শতাংশ।

সোজাসাপ্টা কথা, প্রাণিজ আমিষ এখন পাতে তোলা সামর্থ্য অনেক পরিবারই হারিয়েছে। মাছের মধ্যে দামের তালিকায় তুলনামূলক নিচের দিকে থাকা চাষের কই, তেলাপিয়া ও পাঙাশ দাম শুনেই ক্রেতার কপালে ভাঁজ পড়ছে। তাছাড়া শাকসবজির দাম হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। রমজানে আলু, পেঁয়াজ, বেসন, ছোলাসহ ভোজ্যতেলের দাম ক্রয় ক্ষমতার ঊর্ধ্বে যাওয়ায় এবার রোজাদারদের ঘরে ভালো ইফতার হওয়া সম্ভব হবে কি-না সামনের দিনগুলোতেই বলা যাবে।

প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মোট ছয় ধরনের খাবার রাখার পরামর্শ দেন পুষ্টিবিদরা। দৈনিক গড়ে একজন মানুষের ২ হাজার ১০০ কিলোক্যালরি খাদ্যের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে আমিষজাতীয় খাবার যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, ডাল ১০-১২ শতাংশ থাকতে হয়। ভাত ও রুটি বা শর্করাজাতীয় খাবার থাকতে হবে ৬০-৭০ শতাংশ। আর বাকি ২০-২৫ শতাংশ তেলজাতীয় খাবার থেকে আসতে হয়। প্রতিদিন ভিটামিন ও খনিজ যেমন- শাকসবজি, ফলমূল খেতে হয়। শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণের জন্য দুধ খেতে হয়। পুষ্টিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনুযায়ী দুধের অভাব রয়েছে। দুধের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আবার ক্রয়ক্ষমতার পার্থক্যের কারণে সব শ্রেণিপেশার মানুষ সব পণ্য সমানভাবে কিনতেও পারে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী, আট ধরনের প্রাণিজ আমিষে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান আছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে মাছ, মাংস, সামুদ্রিক খাবারসহ পুষ্টিকর উপাদানসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে দেশের মাত্র ১৭ শতাংশ পরিবার। বাকিরা পারছে না। সাধারণভাবে শিশু, গর্ভবতী মা ও অপুষ্টিতে ভোগা নারীদের এ ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। এ খাবারগুলো তাদের নিয়মিতভাবে না পাওয়া আশঙ্কাজনক।

মাছ-মাংসের দামে মানুষ উদ্বিগ্ন। সন্তানের পাতে প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষ তুলে দিতে না পারার বেদনা প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই নিত্যকার হতাশা। উল্লেখ্য, ডাল থেকেও আমিষ পাওয়া যায়। তবে প্রাণিজ আমিষই হচ্ছে প্রথম শ্রেণির আমিষ, যা পাওয়া যায় মাছ-মাংসে। মানুষের শরীরে আমিষের ঘাটতি হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শিশুদের দীর্ঘমেয়াদে নানা রোগ দেখা দিতে পারে। পুষ্টিহীনতায় বর্ধন কমে যেতে পারে। সংগত কারণেই প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণ করতে হলে এসব পণ্যের দাম নাগালের মধ্যে রাখা জরুরি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। আর সেই উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত