দ্রব্যমূল্যের ভারসাম্যহীনতায় অসহায় মানুষ

মো. আবির হাসান

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যরে কবিতার এ লাইন যেন চিরসত্যের চরম শিখরে এ সময়ে। খাদ্যাভাব নেই, তবে অর্থের অভাব এসে ভর করেছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। ফলস্বরূপ প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য সামনে থাকলেও পকেটের দিকে তাকিয়ে শুধু দেখে তাকািয়ে যেতে হচ্ছে বাজারের সারিবদ্ধ দোকানগুলোর দিকে। আজকের দিনে দেশের বহুমুখী উন্নয়ন হলেও এদেশের বহুসংখ্যক মানুষই অপর্যাপ্ত আয়ের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধিতে নাকানিচুবানি খেতে হচ্ছে নিম্নআয়ের মানুষের। এসব মানুষের দুর্দিন ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে নিত্যদিনের অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য ভারসাম্যহীনতার কারণে। এসব জিনিসপত্রের অস্থিতিশীলতা সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষের কাছে বাঁধাহীন মনে হলেও নিম্নআয়ের মানুষের কাছে একেবারে বিপরীত।

অশিষ্ট চেতনার মলাটে অবরুদ্ধ হয়ে উঠেছে সমাজ আজ। সভ্যতা হারিয়ে বর্বররূপে চেপে বসছে একশ্রেনি আরেক শ্রেণির ওপর। বলছি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির ফলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের কথা। এই তো কয়েকদিন আগে ১০ মার্চ আরেক দফা বাড়ল- তেল, পেঁয়াজ ও চিনির দাম। রমজান মাস আসন্ন। সেই উপলক্ষেই বোধহয় এরূপ দফায় দফায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজারে এই যে একটা ভয়াবহ অস্থিতিশীলতা, এটা কি নিম্নআয়ের মানুষ অর্থাৎ মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য যৌক্তিক? বাজারে প্রতিদিনের দরকারি জিনিসের দাম বাড়াতে উচ্চবিত্তদের সঙ্গে হয়তো ‘ভয়াবহ’ শব্দটা খাপ খায় না, তবে বর্তমানে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের যে লাগামহীন চড়া মূল্য, তা যেন গেড়ে বসেছে সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের ওপর। নিত্যপণ্যের লাগামহীন এরূপ চড়া দামের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে নিম্নআয়ের মানুষের অসহায়ত্ব, আর বাড়ছে মানসিক চাপ।

এদেশের ৭৮.৬ শতাংশ মানুষই গ্রামে বাস করছে, বাকি ২১.৪ শতাংশ শহুরে জীবনযাপন করছে। দেশের সিংহভাগই নিম্নমানের জীবনযাপন করছে। কেননা, গ্রামের মানুষের আর্থিক অবস্থা শহরের তুলনায় অতিমাত্রায় অনুন্নত। এখানকার বেশিরভাগ মানুষই কৃষিকাজ, গোপালন, কিংবা ক্ষুদ্র ব্যাবসা করে প্রতিদিনের দুমুঠো ভাত জোগায়। এমতাবস্থায়, দ্রব্যমূল্যের যে নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত বৃদ্ধি তাতে এসব মানুষ পড়েছে চরম বিপাকে। নিত্যপণ্যের এ লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে গ্রামীণ জীবনে তিনবেলা ভাত পাওয়াটাও যেন কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে এখন।

বর্তমানে যে শুধু খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া এরকমটা নয়। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদার কয়েকটি ক্ষেত্রেই এখন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে। বর্তমানের শিক্ষাক্ষেত্রের কথা বলতে গেলে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সুবাদে খাতা এবং বই হলো অবশ্য প্রয়োজনীয় বস্তু; কিন্তু পৃষ্ঠার মূল্যবৃদ্ধিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাতার জোগান দিতে অক্ষম নিম্নআয়ের অভিভাবকরা। কাজেই শিক্ষার্থীরা অনিশ্চিত মনোবল নিয়ে লেখাপড়ার ধাপে এগোচ্ছে যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি মারাত্মক ক্ষতির পরিচয়। পৃষ্ঠার এমন চড়া দামের খপ্পরে পড়ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে যারা বাইরে অর্থাৎ বাড়ি ছেড়ে দেশের আনাচে-কানাচে পড়াশোনায় নিয়োজিত তাদের অবস্থাটা মর্মান্তিক। খাতাপত্রের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্যেমূল্যের যে লাগামহীন বিস্তার এ নিয়ে বেশ বিভৎস রকমের বিপাকে পড়ছে এসব শিক্ষার্থীরা। আগে হাতখরচের জন্য কিছু টাকা জীবিত থাকত মাস শেষে। কিন্তু এখনকার সময়ে যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত তারা বাড়িতে বাড়তি কোনো টাকা চাওয়ার সুযোগও পাচ্ছে না।

নিম্নআয়ের মানুষের এ নিঃশব্দ হাহাকার কে শুনবে, দেখবে কে তাদের এই রংহীনতা? বেঁচে থাকাটাই যেন দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে সামনের পথে এগোতে গেলেই। যেসব পরিবারে মাত্র একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বিদ্যমান, সে ব্যক্তির পক্ষে আদৌ কি সম্ভব নিত্যদিনের এই পণ্য মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা? জীবনের নির্মম অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে এসব মানুষকে প্রতিনিয়ত। এ অবস্থা চলমান থাকলে দেশের সাধারণ মানুষ হতাশ আর অসহায়ত্বের কিনারায় ডুবে মরবে। সাধারণ মানুষ মানসিকভাবেও নির্যাতিত হচ্ছে এর ফলে। দেশের এরূপ পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্যকে অবশ্যই সর্বস্তরের মানুষের সক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত করাটা আবশ্যক। দ্রব্যমূল্যের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করাটাই বর্তমানের এ সমস্যার সঠিক উপয়ান্তর হবে।

শিক্ষার্থী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়