ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভয়াল কালরাত এবং স্বাধীনতার ঘোষণা

আব্দুল কাইউম, ডিরেক্টর জেনারেল (অব.), এনবিআর
ভয়াল কালরাত এবং স্বাধীনতার ঘোষণা

একাত্তুরের পঁচিশে মার্চের ভয়াল কালরাত নিয়ে বহু লেখা বেরিয়েছে বিগত ৫১ বছর ধরে। লেখনী শক্তির অভাবে শুধু আমার দেখা পঁচিশে কালরাত প্রকাশ পায়নি। আমার দেখা সামান্যই। তবু কিছু তো দেখেছি। অনেকটা বছর হয়ে গেল। স্মৃতি আমার ফিকে হয়ে এসেছে। বয়সের ভারে কালের গ্রাসে হয়তো একদিন বিস্মৃতি অতলে ডুবে যাবে আমার দেখাটি। আমি কেউকেটা নই, এ লেখা কেউ পড়ে দেখবে সে ভরসাও করিনি। তবু লিখছি যদি কেউ পড়ে।

আমি ১৯৬০ সালে ট্রেনিংয়ের জন্য টেলিকম স্টাফ কলেজ হরিপুর হাজারা পশ্চিম পাকিস্তানে দেড় বছর ট্রেনিং শেষ করে বাংলাদেশ ফিরি। ১৯৬৮ সালে পদোন্নতি পেয়ে সহকারী বেতার প্রকৌশলী পদে মগবাজার ভিএইচএফ ওয়্যারলেস যোগদান করি। একাত্তুরের গণঅসহযোগ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়ে সরকারি-বেসরকারি বাঙালি কর্মচারীরা তখন পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ অমান্য করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে আমরা চলছিলাম। এদিকে গোল টেবিল বৈঠক চলছিল রমনা গার্ডেনের পাশের সুরম্য ভবনটিতে। এই ভবনটি কখনও কুইন হাউস, কখনও গণভবন অধুনা ভাইস প্রেসিডেন্টস হাউস নামে পরিচিত। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান, চৌকষ রাজনীতিবিদ জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং বেশ কিছু পাকিস্তানি জেনারেল হররোজ গোলটেবিল বৈঠকে বসেন এ বাড়িটিতে। বঙ্গবন্ধুও তাতে শরিক হন। আলাপ-আলোচনা চলছিল দিনের পর দিন। কি সে গোপন শলাপরামর্শ- কোনো দিন খবরের কাগজে বা রেডিওতে শোনা যায়নি। আমরা শুধু গুজব শুনতাম আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে। কোনোদিন শুনতাম শেখ সাহেব প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করবেন। আবার হয়তো পরদিন শুনতাম- সবই গুজব, কিছুই হচ্ছে না। দু’পক্ষের গরমিল।

আমি তখন অবিবাহিত, বয়েস ২৯ বছর, ঢাকার মগবাজার বেতার অফিসে সহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরি করি। বলাবাহুল্য, এ বেতার অফিসটির মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগোযোগ রক্ষা করা হতো।

আমরা গুজব শুনতাম। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার সুযোগ ছিল না। আমি আর আমার দুই বন্ধু প্রায় প্রতিদিন বিকেলে শহরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পর্যবেক্ষণ করতে যেতাম। ওসব স্থানে আমাদের প্রবেশাধিকার ছিল তা নয়। আমরা জিপে করে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর পাশ ঘেঁষে চলে আসতাম। যদি ওই জায়গাগুলোতে পাকিস্তানি সৈন্যের আধিক্য দেখতাম, অথবা ওদের ব্যস্ত হয়ে পজিশন নেয়া অবস্থায় দেখতাম আমরা ভাবতাম আজ অবস্থা গরম। আবার ওদের খোশ মেজাজে দেখলে মনে করতাম আলোচনা বুঝি ভালো চলছে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ রেডিওর ব্রডকাস্টিং হাউস, হোটেল ইন্টারকন, টেলিভিশন স্টেশন (ডিআইটি বিল্ডিং), তেজগাঁও বিমানবন্দর এলাকা এবং গোলটেবিল বৈঠকের সেই বাড়িটির আশপাশ দিয়ে প্রতি বিকেলে একটি চক্কর দিতাম। সেই পঁচিশের বিকেলেও আমরা নিত্যকার মতো চক্কর কেটেছি সেই স্থানগুলোতে।

টেলিযোগাযোগ দপ্তরে চাকরির সুবাদে রমনা টেলিযোগাযোগ কেন্দ্রের আমাদের কোনো এক সহকর্মী আড়ি পেতে শুনে নেয় দুই পাকিস্তানি জেনারেলের টেলিফোন আলোচনা। আলোচনা ছিল, ২৫ মার্চের রাতে আর্মি মুভমেন্ট করবে। আমরাও খবরটা পেয়ে গেলাম। আরও জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর কানেও খবরটা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। তাই বিকেলে আর্মি মুভমেন্ট সত্যিকার হবে কি-না, পাকিস্তানিরা কীভাবে এর প্রস্ততি নিচ্ছে, তা দেখার জন্য আমরা সেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দেখতে বেরুলাম বিকেলে। দেখলাম প্রচুর পাকিস্তানি সৈন্য সব ক’টি জায়গায়। এরা পূর্ণ সমরসজ্জায় সজ্জিত। সবশেষে তেজগাঁও বিমানবন্দর এলাকাটি ঘুরে আসার জন্য ময়মনসিংহ রোড ধরে আমরা এগুচ্ছিলাম। তখন বিকেল সাড়ে ৫টা। পথে কাওরান বাজার এলাকায় দেখলাম আটটি ট্রাক বোঝাই পাকিস্তানি সৈন্য। সবার হাতে অটোমেটিক রাইফেলস। প্রতি ট্রাকে ৪টি করে মেশিনগান, সামনে পেছনে ও দুই পাশে মেশিনগান তাক করে এগিয়ে চলেছে শহরের দিকে। আমরা শুধু বলাবলি করলাম, এরাই হয়তো রাতের বেলায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করবে। এদের একটি হয়তো মগবাজার ওয়্যারলেস অফিস দখল করতে আক্রমণ করতে যেতে পারে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ সময় পাকসৈন্যরা মহাখালী, মগবাজার কেন্দ্রে আক্রমণ চালিয়ে বাঙালি ওয়্যারলেস অপারেটরদের বেধরক মারপিট করে। আমরা এগিয়ে গেলাম। বিমানবন্দর এলাকাটি নির্জন, থমথমে মনে হচ্ছিল। বিমানবন্দর নিকটবর্তী হলে দেখতে পেলাম এর ছাদের উপরে পাকিস্তানি সৈন্যরা বালুর বস্তা দিয়ে চারপাশ ঘিরে রাস্তার দিকে তাঁক করে মেশিন গানের নল উঁচিয়ে বসে আছে। রাস্তার উভয় পাশে ছাদের উপর এদের অবস্থান ও রণমূর্তি দেখে সত্যি বলতে কি আমরা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বিমান বন্দরের টারমাকে একটি পিআই-এর উড়োজাহাজ দাঁড়ানো দেখে আমরা ফিরে চলেছিলাম। আবার কাওরান বাজার এলাকার কাছাকাছি এসে দেখতে পেলাম পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া সশস্ত্র প্রহরায় বিমানবন্দর অভিমুখে যাচ্ছেন। পাশে বসা লোকটিকে মনে হলো জুলফিকার আলী ভুট্টো। তখন সন্ধ্যা ছয় থেকে সোয়া ছয়টা হবে। অবশ্য অল্প কিছুক্ষণ পর পিআই-এর বিমানটি উড়ে চলে যায়। আমরা তখন বলাবলি করছিলাম প্রেসিডেন্ট ও ভুট্টো চলে গেল নাকি? পরে শুনেছি প্রেসিডেন্ট তখন চলে গিয়েছিলেন, ভুট্টো আরও পরে।

সন্ধার পরপরই বাসায় ফিরে এসেছি। আমার বাসাটি ছিল মগবাজার ওয়্যারলেস অফিসের ফটকের লাগোয়া। সন্ধ্যা শিফটে অফিসের কর্মচারীরা এসেছে কি-না দেখার জন্য অফিসে গেলাম সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে। যারা এসেছিল এরা আমাকে দেখেই চেপে ধরে বলল, স্যার আজ রাতে আর্মি মুভমেন্ট হবে। আমাদের ভয় করছে। আমরা বাসায় চলে যেতে চাই। আমি বলেছিলাম, চিলে কান নিয়েছে অমনি চিলের পেছনে ছুটলেন? এখানে তো নাও আসতে পার। অগত্যা আসছে বলে টের পেলে আমার বাসায় দৌড়ে আসবেন। গেট থেকে তো মাত্র ২৫ গজ দূর। আপনারা ডিউটি করতে থাকুন।

ওদেরকে এ কথা বলে আমি বাইরে মালিবাগ টেলিভিশন রোডের অবস্থা দেখার জন্য এলাম। বাইরে তখন নিকষ কালো আঁধার। সারা শহরে বিদ্যুৎ নেই। ইলেকট্রিক সাপ্লাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অগুনতি লোকজন মালিবাগ টেলিভিশন রাস্তা খুঁড়ে ব্যারিকেড তৈরি করছিল। কোনো কোনো রাস্তায় ইট, গাছের গুঁড়ি, লোহা লক্কর, ভাঙা গাড়ি ইত্যাদি দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হচ্ছিল হানাদার বাহিনীর অগ্রগতি রুখে দেয়ার জন্য। আমি রামপুরা টেলিভিশন রোড ধরে মালিবাগ মোড় হয়ে ফিরে এলাম। দেখলাম অসংখ্যা মানুষ স্থানে স্থানে ব্যারিকেড গড়ে তুলছে।

রাস্তার দিকে আমার ঘরের দরজায় একটা প্রকাণ্ড তালা ঝুলিয়ে দিলাম। রাত সাড়ে ১০টা পৌনে ১১টা নাগাদ গুলির আওয়াজ ও বহ্নিশিখা দেখতে পেলাম। মনে হলো তেজগাঁও এলাকার আগুন লেগেছে। ক্রমেই গুলির আওয়াজ বাড়তে লাগল, আগুনের লেলিহান শিখা নজরে পড়তে লাগল। একজন মাত্র অপারেটর অফিস ছেড়ে আমার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল। বাসার ভেতরের আঙিনায় দাঁড়িয়ে আমরা উপলব্ধি করছিলাম বর্বর বাহিনীর তাণ্ডবলীলা। দূর থেকে আমরা বিস্তীর্ণ এলাকার অগ্নিশিখা, কানফাটা গুলির আওয়াজ আর মাথার উপর দিয়ে স্কুলিঙ্গের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে যেতে দেখতে লাগলাম। রাত প্রায় ১২টা কি ১টা হবে, হঠাৎ করে মগবাজারে অফিস ও আমার বাসার টেলিফোন যন্ত্রটি অসাড় হয়ে গেল। শুনতে পেলাম মেশিনগানের অনবড়ত গুলির ছোড়ার আওয়াজ, মর্টার ছোড়ার কানফাটা আওয়াজ। এরই মধ্যে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী মগবাজার চৌরাস্তার দিকে এগিয়ে আসছিল। কালো রাত্রির নিকষ আঁধারকে ভেদ করতে বর্বর বাহিনী ব্যবহার করছিল এক ধরনের হাওয়াই বোমা। এটা উপরে ছোড়া হতো, এক থেকে দেড়শ’ গজ উপরে উঠে। এটা ফেটে গেলে সারা এলাকা আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে পড়ত। এতো আলো যে মনে হতো এ আলোতে দুর্বা ঘাসে একটা সুঁই হারিয়ে গেলেও তা খুঁজে বের করা যাবে। এ সময় বেবিট্যাক্সি গাড়ির আওয়াজ কানে এলো। আসলে এগুলো বেবিট্যাক্সি গাড়ির আওয়াজ ছিল না। ছিল ট্যাংকের আওয়াজ। ম্ইাকে পরদিন থেকে করফিউ ঘোষণা করা হয়। মাইকে থেকে ২৬-০৩-৭১ তারিখে ১০টা থেকে ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়।

রাতে পাকবাহিনী অবিরাম মর্টার থেকে শেল ছুড়ছিল, মেশিন গানের গুলি ছুড়ছিল। কদাচিত এদের জবাব থ্রি নট থ্রিতে দেয়া হচ্ছিল। বর্বর বাহিনী মগবাজার এলাকা পৌঁছলে থ্রি নট থ্রির গুলির সংখ্যা বেড়ে গেল। পরের শুনেছি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের কিছু সংখ্যক পুলিশ আড়াল থেকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়েই এদের বেশ কিছু সংখ্যককে সাবাড় করেছিল। বর্বর বাহিনী আর্মাড কারে চেপে মর্টারশেল ও মেশিনগানের গুলি ছুড়ে ছুড়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছাকাছি পৌঁছালে বীর বাঙালি পুলিশ থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়েই এদের মোকাবিলা করে। বর্বর বাহিনীর বেশ কিছু জোয়ান ও অফিসার পুলিশের গুলিতে ধরাশায়ী হয়। অসংখ্য থ্রি নট থ্রির গুলির আওয়াজ আমরা গুনতে পাচ্ছিলাম। রাত আড়াইটায় নরকীয় গোলাগুলির মাঝে আমার মনে হলো কয়েকটি বেবিট্যাক্সি যেন রাস্তা দিয়ে চলছে। আমি অবাক হয়েছিলাম, এত রাতে বেবিট্যাক্সি এত গোলাগুলির মাঝে চালাচ্ছে কে? আসলে বুঝাতে পারিনি যে এটা বেবিট্যাক্সির নয়। ট্যাংকের আওয়াজ। পুলিশের মোকাবিলা করতে গিয়ে বর্বর বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং ট্যংক বহর তলব করে। বর্বর বাহিনী ট্যাংক নিয়ে রাজারবাগ ্আক্রমণ করলে আমাদের বীর পুলিশ বাহিনী কাবু হয়ে পড়ে। থ্রি নট থ্রি গুলির আাওয়াজ অপেক্ষাকৃত কম শোনা যেতে থাকে। ট্যাংকের সামনে পুলিশ অসহায় হয়ে পড়ে। পুলিশের বাঁশের তৈরি ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দিলে বহু পুলিশ শহিদ হয়। অনেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। সকাল অবধি পুলিশ আড়াল থেকে বর্বর বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে যায়। ফাঁকে ফাঁকে টুশটুশ থ্রি নট থ্রির আওয়াজ পাচ্ছিলাম।

ভোর ৫টা হবে, আমার অপারেটর অফিসে ফেলে আসা তার চাদর আনতে গেলে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা যায়। ভদ্রলোক অপারেটরকে বঙ্গবন্ধুর একটি নির্দেশ দিয়ে বলেন, এটি বঙ্গবন্ধু পাঠিয়েছেন। যত শিগগিরই সম্ভব এটি বাংলাদেশের সর্বত্র পৌঁছে দিতে হবে। নির্দেশনামাটি নিয়ে অপারেটর আমার কাছে ফিরে আসেন এবং এটা পাঠানো হবে কি-না এ ব্যাপারে আমার নির্দেশ চান। শহরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন নিকশ কালো আঁধারে, শহরে সব টেলিফোন অচল, বাইরে অবিরাম প্রচণ্ড গোলাগুলি, এ অবস্থায় কারও কাছে আমার করণীয় বিষয় শলাপরার্মশ করা সম্ভব ছিল না। অপারেটর মেসেজটি পাঠাবে কি-না এ বিষয় আমার কাছে নির্দেশনা চায়। এ বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপদেশ চাওয়াও সম্ভব ছিল না। কারণ সব ফোনলাইন অচল। বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলি। এ অবস্থা নিয়ে অস্থিরতায় ভুগছিলাম। দেশে পাকিস্তানি রাজত্ব। আওয়ামী লীগের জননেতার শরণাপন্ন হওয়াও সম্ভব ছিল না। অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির হাত থেকে পাওয়া স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয় পাকবাহিনী জানতে পারলে গুলি খেয়ে মরতে হবে। কোনো কিছুই স্থির করতে পারছিলাম না। এই পর্যায়ে আল্লাহর নাম নিয়ে নিজস্ব একক দায়িত্বে মেসেজটি পাঠাতে স্থির করি। মনে ধরা খাওয়ার ভয়ও করছিল। পাক বাহিনী ধরতে পারলে গুলি খেয়ে মরতে হবে। এমন ভয়ও ছিল মনে। যাহাক, সাহস করে মেসেজ পাঠানো হলো। পরবর্তী সময়ে জেনেছি, মেসেজটি চট্টগ্রাম ওয়্যারলেস স্টেশনে পৌঁছলে ফোনে তা আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হান্নান কাছে পাঠানো হয়। তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি সারা দেশে প্রচার করেন। চট্টগ্রামে ভিএইচএফ কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামে বন্দরে অবস্থিত সব বিদেশি ও জাহাজে পাঠানো হয়। সেখান থেকে যার যার দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠানো হয়। বলাবাহুল্য, মগবাজার ওয়্যারলেস থেকে এ স্বাধীনতার ঘোষণা না পাঠালে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হান্নানের কাছেও এ স্বাধীনতার ঘোষণাটি পৌঁছাত না, বিদেশি জাহাজেও প্রেরণ করা সম্ভব হতো না। স্বাধীনতার ঘোষণাটি দিনের আলো দেখতে আরও দীর্ঘ সময় লেগে যেত।

আমার বর্তমান বয়স ৮২ বছর। শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়। কোনদিন এ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে যেতে হবে জানি না। প্রায় ৫২ বছর আগের আমার দেখা পঁচিশে মার্চে যৎসামান্য স্মৃতি নতুন প্রজন্মের সঙ্গে শেয়ার করার মানসে আমার এ লেখা। লেখা শক্তি দুর্বল, তাই কে বা কারা এ লেখা পড়বে, আদৌ কেউ পড়বে কি-না বলতে পারি না। তবু আমার ধারণায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ঢাকা শহরে, টেলিফোন সেবা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ঢাকা শহর থেকে ভিএইচ বেতার মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রেরণে সক্ষম হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর একজন অখ্যাত সৈনিকের কাজটির জন্য নিজে গর্ববোধ করছিলাম। কারণ আমার ধারণায় আমি উদ্যোগী হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাটি ভিএইচ বেতার মাধ্যমে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ না করলে ঢাকার বাইরে অথবা দেশ বা বিদেশে তা প্রেরণে বিলম্ব হতো। আমার কাজটি নেহায়েত অকিঞ্চিৎকর হলেও আমার প্রচেষ্টার সাফল্যের কারণে নিজেকে গৌরবান্বিত ভাবছিলাম। অন্যথায় দেশ বিদেশে (চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থিত বিদেশি জাহাজের সাহায্যে বিদেশে স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদ প্রেরণ এবং দেশের অভ্যন্তরে ভিএইচএফ বেতার মাধ্যমে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবন্দ, ছাত্রলীগ, ইপিআর, পুলিশ, সেনাসদস্য) কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা পৌঁছানো সম্ভব হতো না। এতক্ষণ আলোচনা করছিলাম স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে; কিন্তু কি ছিল স্বাধীনতার ঘোষণায় তার বর্ণনা দেয়া হয়নি। অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের হাত ধরে স্বাধীনতার ঘোষণার বর্ণনা নিম্নরূপ উদ্ধৃতি করছি।

“Message to the people of Bangladesh and to the people of the world:

Last night at about 0000 hrs Pakistani army suddenly attacked Rajarbag Police Camp and EPR Head Quarters at Peelkhana with tanks, machine guns and all other modern weapons. Lakhs and eakhs of innocent lives mercilessly killed by the enemy forces. People fighting face to face heroically with the enemy forces in the streets of Dacca and declared independence. All People of Bangladesh are requested to resist the enemy forces at aû cost in the every corner of the country. Take all possible help from the peace loving people of the world. May God bless you. Joy Bangla.Ó

Sk. Mujibur Rahman

এই মেসেজটি চট্টগ্রাম চিলিমপুর ভিএইচএফ স্টেশন পেয়ে চট্টগ্রাম নগরী আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নানের কাছে পৌঁছে দেন। ঢাকার মগবাজার ভিএইচএফ কেন্দ্রের মাধ্যমে আব্দুল কাইউম চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পৌঁছে দেন। আব্দুল হান্নান ২৬-০৩-১৯৭১ ইং তারিখে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে জাতির পিতার প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি প্রচারের ব্যবস্থা করেন। আমার এ অভিজ্ঞতার বর্ণনা ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের স্বাধীনতা দিবসে এর স্মরণিকা প্রতীতিতে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালেও ভীমরুল নামক পত্রিকার (২২-২৯ মার্চ সংখ্যায়) বঙ্গবন্ধুর ম্যাসেজসহ ‘২৫ মার্চের কালরাত ও তারাবার্তা সমাচার’ এ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।

বাঙালি জাতি ২৬ মার্চ প্রতি বছর আড়ম্বরপূর্ণভাবে দেশের স্বাধীনতা দিবস পালন করছে। দেশবাসী কালুরঘাটের বেতার বার্তার কথা জানলেই এই সংবাদটি কীভাবে সেখানে পৌঁছালে তা সবার অজানা। ঢাকা শহরে টেলিফোন সেবাবিচ্ছিন্ন থাকলেও ভিএইচএফ বেতারের কল্যাণ এবং আমার একক উদ্যেগে, ফোনের সুবিধা বিচ্ছিন্ন থাকা সত্ত্বেও ঢাকা শহরে কারও কাছ থেকে উপদেশ নেওয়ার সুবিধা বঞ্চিত অবস্থায়, স্বাধীনতার ঘোষণাটি ২৬ মার্চ ১৯৭১ ইং তারিখে কালুরঘাট বেতারে প্রচার করা সম্ভব হয়েছিল। মগবাজার ভিএইচএফ থেকে মেসেজটি চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে না পাঠালে চট্টগ্রামে আব্দুল হান্নানের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা পৌঁছাত না এবং কালুরঘাট থেকে তা প্রচারও সম্ভব হতো না। বিদেশে জাহাজেও ঘোষণাটি পৌঁছাত না। দেশে বিদেশে স্বাধীনতার ঘোষণা আড়ালেই পড়ে থাকত। সম্প্রচারে অভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারে আরও বিলম্বিত হত।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে লেখক আব্দুল কাইউম সহকারী প্রকৌশলী বেতার ভিএইচএফ পদে মগবাজার ওয়্যারলেস এ কর্মরত ছিলেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এই সুবাধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রেরণের মাধ্যমে দেশের প্রথম মুক্তিযোদ্ধার হিসেবে তাকে বিবেচনা করা অন্যায় হবে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কমিশনার (কাস্টমস) হিসেবে অবসর নিয়ে তিনি বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত