রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি ‘ময়না’ যুদ্ধের শহীদরা

মো. আশিকুর রহমান টুটুল, শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর, রাজশাহী কলেজ, [email protected]

প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৭১ থেকে ২০২৩ দেখতে দেখতে চলে গেছে ৫২টি বছর। ১৯৭১ সালে বাংলার ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষের ওপরে অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি নরপশুর দল। বাংলার মাটিতে চালিয়েছিল ধ্বংসযজ্ঞ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে দিয়েছিল স্বাধীনতার ডাক। বঙ্গবন্ধুর সেই ডাকে সারা দিয়ে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদেশের মুক্তিকামী বীর বাঙালিরা। নিজের মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে দিয়েছিল বুকের তাজারক্ত। যুদ্ধ হয়েছিল প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলেও। তৎকালীন ১৯৭১ সালে উত্তরবঙ্গে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়, নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার ওয়ালিয়া ইউনিয়নের ময়না গ্রামে।

১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ৭৬ জন সদস্যরা ২৫ রেজিমেন্ট তিনটি জিপ ও ছয়টি ট্রাক নিয়ে পাবনার নগরবাড়ি থেকে নাটোর হয়ে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা দেয়। পথে পাবনার দাশুড়িয়া ও রাজাপুরে মুক্তি পাগল জনতার বাধার মুখে পড়ে পাকিস্তান বাহিনী।

পাকিস্তান বাহিনীর একটি দল কাঁচা রাস্তা দিয়ে লালপুর মাঝগ্রাম (রেলগেট) রেল লাইন পার হয়ে টিটিয়া, সুন্দর বাড়িয়া গ্রামের মধ্যে দিয়ে কদিমচিলান ইউনিয়নের চাঁদপুর বাজার থেকে ভোর ৬টার দিকে মনির উদ্দিন আকন্দ রোড হয়ে গোপালপুরের দিকে রওনা হয়।

এসময় নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে মুক্তিকামী হাজার হাজার জনতা ও সাওতাল গোষ্ঠীরা রাস্তার উভয় পাশে লাঠিসোঁটা, বল্লম, তির-ধনুকসহ বিভিন্ন গ্রাম্য হাতিয়ার নিয়ে হানাদার বাহিনীর পেছনে ধাওয়া করে।

পাকিস্তান বাহিনীর বহর গোপালপুরের রেল গেটে পৌঁছার আগেই জানতে পেরে রেললাইনে ওয়াগান দ্বারা ব্যারিকেড সৃষ্টি করলে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে রেল গেট এলাকায় ক্ষিপ্ত পাকিস্তানি সেনারা নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ অভিযান চালায়। এসময় বীর বাঙালির সঙ্গে যুদ্ধ হয় পাকিস্তান বাহিনীর। এ যুদ্ধে আহত ও শহীদ হন অনেকে।

এক পর্যায়ে পাকিস্তান সেনারা মনির উদ্দিন আকন্দ রোড হয়ে ফেরত যাওয়ার চেষ্টা করে আবারও গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এসময় আকন্দ রোডে আরও কিছু মুক্তিকামী বীর বাঙালি শহীদ হন।

কিন্তু পিছু নেয়া জনতা বিজয়পুর ও বামনগ্রাম সীমান্তে অবস্থিত ইছামতি খালের ওপর একটি ব্রিজ (সিঙ্গি ব্রিজ বলে পরিচিত) পশ্চিমপাড়ের পার্শ্বে রাস্তাকে আড়াআড়িভাবে কেটে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এসময় প্রায় ৭ জন বীর বাঙালিকে আটক করে খলিশাডাঙ্গা নদীর দিকে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনারা। নদীর ওপারে (উত্তরপাড়ে) ময়না গ্রামে সৈয়দ আলী মোল্লা ও নওয়াব আলী মোল্লার বাড়ি দখল করে পাকিস্তান সেনারা। দুপুর ১টার দিকে আটককৃত ৭ জন মুক্তিকামী জনতাকে নওয়াব আলী মোল্লার বাড়ির পাশে আম গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে দিনভর নির্যাতন শেষে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। কিন্তু এই ৭ জনের মধ্যে ভাগ্যক্রমে প্রাণে বাঁচে আব্দুস সামাদ।

আব্দুস সামাদ পাকিস্তান সেনাদের গোলাবারুদ শেষ ও নাজুক পরিস্থিতির খবর মুক্তিকামী জনতাদের জানিয়ে দিলে পাকিস্তান সেনাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে। রাতেই বীর জনতা আরও কঠোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং শেষ রাতের দিকে পুনরায় আক্রমণ শুরু করে। এসময় পাকিস্তান সেনাদের উদ্ধারের জন্য কয়েকটি হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করে এবং হেলিকপ্টার ল্যান্ড করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আবারও শুরু হয় উভয়পক্ষের গোলাবিনিময় এবং বাঙালি মুক্তিকামী জনতার কাছে পরাজিত হয় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ২৫ রেজিমেন্ট। পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা ছদ্মবেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে; কিন্তু বাহিনীর কয়েকজন সদস্যসহ বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী মেজর আসলাম হোসেন (রাজা খান) বীর বাঙালির হাতে ধরা পড়ে। পরে বীর বাঙালিরা তাদের লালপুর শ্রী সুন্দরী স্কুল মাঠে জনতার আদলতে রায়ে হত্যা করে। এভাবে ৩০ মার্চ ময়না যুদ্ধে বীর বাঙালি কর্তৃক হানাদার বাহিনীর ২৫ রেজিমেন্ট ধ্বংস হয়। এ যুদ্ধে জীবন দিয়েছিল প্রায় অর্ধশতাধিক বীর বাঙালি। আহতর সংখ্যাও প্রায় অর্ধশত।

দেশ স্বাধীনের ৫১টি বছর পার হলেও উত্তরবঙ্গের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ হিসেবে লালপুরের ময়না যুদ্ধ দিবস আজও পায়নি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। দেশ স্বাধীনের পরে শহীদ পরিবারের অনুদানের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার স্বাক্ষরকৃত চেক প্রদান করেছিল। যুদ্ধে শহীদ পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর খোঁজ না রাখায় বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত অনুদানের চেকও আজ হারিয়ে ফেলেছে পরিবারগুলো। শহীদ ও আহত পরিবারের ঝরেপড়া শিশু-সন্তানরা হতে পারেনি সুশিক্ষিত।

সরকারিভাবে দেয়া হয়নি তাদের শহীদ ও আহত পরিবারের সম্মাননাপত্র। এমনকি ভাগ্যে আজও জুটেনি সরকারি বিশেষ কোন অনুদান। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সাবেক সংসদ সদস্য মমতাজ উদ্দিন ময়না যুদ্ধের স্থানে স্থাপিত করেছিলেন স্মৃতিসৌধ। যেখানে রয়েছে মাত্র ১৭ জন শহীদ বীর বাঙালিদের নাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ শহীদ ও আহত বীর বাঙালিদের নামফলক আজও উন্মোচিত হয়নি। যে আম গাছটির সঙ্গে ব্রাশফায়ার করে হাজারো গুলিবর্ষণে ৭ জন বীর যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়, সে আম গাছটি আজও কালের সাক্ষী হিসেবে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। উপজেলা আওয়ামী লীগ গাছটি মালিকের কাছ থেকে ক্রয় করলেও পরিচর্যার অভাবে গাছটি আজ মৃতপায়। স্মৃতিসৌধের চারপাশে অরক্ষিতভাবে রয়েছে গণকবর। কিন্তু প্রতিবছর ৩০ মার্র্চ আসলেই স্থানীয়দের উদ্যোগে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এসে স্মৃতিসৌধে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ ও শহীদের স্মৃতিচারণ করেই শেষ করে ময়না যুদ্ধ দিবস। কেউ খোঁজ রাখে না যুদ্ধে শহীদ বীর বাঙালি ও আহত যোদ্ধা পরিবারের।

সরকারিভাবে কখনও উদ্যোগ নেয়া হয়নি প্রত্যন্ত ময়না গ্রামে হওয়া প্রথম সম্মুখ যুদ্ধের স্থানটিকে কীভাবে আধুনিক মডেল স্মৃতিসৌধ নির্র্মাণ এবং গণকবরগুলো সংরক্ষণ করার মধ্য দিয়ে ময়না যুদ্ধের স্থান ও শহীদ বীর বাঙালিকে শ্রেষ্ঠ বাঙালির স্বীকৃতি দেয়ার। এ যুদ্ধে যারা জীবন দিয়েছিল তার পরিবার ও স্থানীয়রা আজও মুক্তিযোদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারন করে বেঁচে আছে। সেদিন যে সব বীর বাঙালি যুদ্ধে শহীদ ও আহত হয়েছিল তার পরিবার চায় স্বাধীনতার সপক্ষের সরকার বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ময়না যুদ্ধকে উত্তরবঙ্গের সর্বপ্রথম সম্মুখ যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যুদ্ধের স্থানে আধুনিক স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে এই যুদ্ধের ইতিহাস জানার সুযোগ তৈরি করবে এবং শহীদ ও আহত পরিবার পাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।

৩০ মার্চ ময়না যুদ্ধে যারা শহীদ হন- ময়না গ্রামের শহীদ সৈয়দ আলী মোল্লা, শহীদ মসলেম উদ্দিন মোল্লা (শিক্ষক), শহীদ আবুল কাশেম মোল্লা, শহীদ আয়েজুদ্দিন মোল্লা, শহীদ খন্দকার নুরননবী (মন্টু), নান্দ গ্রামের শহীদ কেয়ামত শেখ, ওয়ালিয়া গ্রামের শহীদ খাইরুল আলম (সাত্তার), শহীদ বক্স সরদার, শহীদ করম আলী, পানঘাটা গ্রামের শহীদ আবেদ আলী, ধুপইল গ্রামের শহীদ আবুল কালাম আজাদ, টিটিয়া মাঝগ্রামের শহীদ আব্দুল কুদ্দুস, শহীদ কালু মিয়া, বামনগ্রামের শহীদ সেকেন্দার আলী, বিজয়পুরের শহীদ আছের উদ্দিন, ভবানীপুরের শহীদ জয়নাল আবেদীন, শহীদ চেরু প্রামানিক, দয়রামপুরের শহীদ নুরুননবী, বাহাদিপুরের শহীদ ইয়াছিন আলী, মধুবাড়ী গ্রামের শহীদ জুধিষ্টির প্রামানিক, নাটোর নিচাবাজার এর শহীদ মুংলা দাস, চাঁদপুর কদিমচিলান-এর শহীদ সাহেব উল্লা, ডাঙ্গাপাড়া চিলান গ্রামের শহীদ আ: গফুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা নাম না জানা স্বাধীনতাকামী জনতা, ইপিআর, আনছার।

পাকিস্তান বাহিনীর গোলার আঘাতে আহত হয়- নান্দরায়পুর গ্রামের অনিল চন্দ্র সরকার, ময়না মন্ডলপাড়া গ্রামের জাহাঙ্গীর মাস্টার, ওয়ালিয়া গ্রামের জবান আলী ও রুস্তুম আলী, ভবানীপুর গ্রামের আবু বক্কর, ময়না গ্রামের নজরুল ইসলাম (নজু), পানঘাটা গ্রামের ডা. নাদের আলী, খোরশেদ আলী চাঁদপুর গ্রামের আয়ুব আলী এবং দুয়ারিয়া গ্রামের ভবেষ চন্দ্র বিশ্বাসসহ আরও অনেকে।