ধুলায় ধূসরিত ঢাকা

মোহাম্মদ অংকন, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শীতকালে বৃষ্টিপাত না হওয়ায়, বসন্তের শুরুতে কড়া রোদ থাকায় রাস্তায় ধুলার উৎপাত অনেকাংশে বেড়ে যায়। টানা কয়েক মাস আদৌ বৃষ্টি না হওয়াই মূলত ধুলার উৎপাত বৃদ্ধির আসল কারণ। একটা দমকা হাওয়া বয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ধূলিঝড় শুরু হয়ে যায়। রাস্তায় চলাচলরত মানুষের কান, নাক, মুখ ও চুলে প্রবেশ করেই ক্ষান্ত হয় না এই ধুলা; বাসাবাড়ি, দোকানপাট, যানবাহনের দিকে তাকালে ধুলার যে স্তর লক্ষ্য করা যায়, তা অবিশ্বাস্য। এত ধুলা জমলো কোত্থেকে!

সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী শহরে ধুলার উৎপাত অসহনীয়। এ যেন ধুলার শহর ঢাকা রে! টানা কয়েক বছর ধরে উড়ন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দালানকোঠা নির্মাণসহ নানান কারণেই বিভিন্ন বালুকণা বাতাসে মিশে ধুলায় পরিণত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে বালুকণা মিহি ধুলায় পরিণত হয়ে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। এইসব ধুলা যে স্বাস্থ্যের জন্য কতটা মারাত্মক, তা শুধু বায়ু দূষণজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষই উপলব্ধি করতে পারছে।

রাজধানীতের চব্বিশ ঘণ্টাই মানুষ ও পরিবহন চলাচল করে। এই সময়ে অনিয়ন্ত্রিত ধুলা পথচারীদের শরীরে প্রবেশ করে নানান রকম রোগবালাইয়ের জন্ম দিচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষের কাশির সঙ্গে বের হয়ে আসছে সেই ধুলা। শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জিসহ ধুলাবাহিত নানান রোগে প্রতিনিয়ত হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে মানুষ। জীবন-জীবিকার তাগিদে বাইরে বের হয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছে, এর চেয়ে মারাত্মক বিষয় আর কী হতে পারে। যে শহরে আয়রোজগার করে মানুষ নিরাপদে বসবাসের উপায় খুঁজছে, সেই শহরের বাতাসে বয়ে বেড়ানো ধুলা মানুষকে অসুস্থ করতে তুলছে। এ বড়ই দুঃখজনক!

শুধু চলাচলের রাস্তাতেই এইসব ধুলা সীমাবদ্ধ থাকছে না। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতের ছাদ ও আসবাবপত্রের দিকে তাকালে দেখা মেলে ধুলা তার অবস্থান কতটা জোরালোভাবে তৈরি করে ফেলেছে। একদিন আসবাবপত্র পরিষ্কার না করলে পরের দিন তা আর ব্যবহার উপযোগী থাকছে না। শুধু আসবাবপত্রই না, ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করতে হচ্ছে শুধু ধুলার আস্তরণ পড়ার কারণে। একদিনের পরা পোশাক-আশাক পরের দিন পরার কোনো জো নেই। প্রতিদিন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার করতে সাবান বাবদ যেমন মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করতে হচ্ছে, তেমনই ঘনঘন পরিষ্কারের কারণে পোশাক-পরিচ্ছদ দ্রুততম সময়ে ক্ষয় হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই ধুলা স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিসহ নানানভাবে শহরের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে, তা কি কেউ ভেবে দেখছে?

নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান, নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদান, শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়-দায়িত্ব বর্তায় সিটি করপোরেশনের ওপর। ঢাকা শহরের দায়িত্বে আছে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কিন্তু ঢাকা শহরে ধুলার স্তর পড়ে সয়লাব হয়ে গেলেও ধুলা প্রতিরোধে সিটি করপোরেশনদ্বয়ের তেমন কোনো উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়ছে না। ধুলার এই মৌসুমে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে যদি নিয়মিত পানি স্প্রে করা হতো, তাহলে রাস্তার ধুলাবালি প্রশমিত হতো। সেগুলো বাতাসে উড়ে এসে বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতে জমে থাকত না। পথচারীরাও প্রাণ খুলে রাস্তায় নিঃশ্বাস নিতে নিতে চলাচল করতে পারত। ধুলার দাপটে মাথার চুল সাদা হয়ে এলেও নগরে কেউই কখনও ধুলা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে দেখেনি। তাহলে সিটি করপোরেশনগুলো কি নাগরিকে সুবিধা-অসুবিধার কথাগুলো বিবেচনায় আনতে পারছে না?

রাজধানীতে ধুলা নিয়ন্ত্রণে আনা খুব জটিল কোনো বিষয় বলেও মনে হচ্ছে না। যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে ধুলাগুলো বাতাসে উড়ার সুযোগ পাচ্ছে, সেহেতু ত্বরিতগতিতে কৃত্রিম বৃষ্টি সৃষ্টির মাধ্যমে অন্তত রাস্তার ধুলা খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। শহরের ধুলা নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম বৃষ্টির প্রয়োজন, এই পরামর্শ বোধকরি নগরপিতাদের দেওয়া আমাদের সাজে না। কিন্তু মনে করিয়ে তো দিতে পারি। তারা যে বেমালুম ভুলে গেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। এটা নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখারই একটা অংশমাত্র। সিটি করপোরেশন চাইলেই কৃত্রিম বৃষ্টির মাধ্যমে রাজধানীর ধুলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু কেনই বা করবে তারা? তাদের বাড়ি-গাড়ি তো পুরো কাঁচে ঘেরা, সেখানে তো ধুলা প্রবেশ করতে পারে না, তাই তাদের বোধোদয় হয় না। ঠিক যেমন মশা কখনও নগরপিতাদের কামড় দিতে পারে না বলে তাদের কাছে সর্বদা মনে হয় ঢাকা শহরে কোনো মশা নেই। এক্ষেত্রেও বলা যেতেই পারে, ঢাকা শহরে কোনো ধুলাই নেই। বাতাসের আগে আগে যা উড়ছে, তা নিশ্চিত বসন্তকালীন কুয়াশা!

যাইহোক, নগরে ধুলার আধিক্য বিচারে আমরা ত্বরিত সিদ্ধান্ত আশা করি। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি নির্বাচিত প্রতিনিধি জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল। তাই যে জনগণ সরকারকে কর প্রদান করে, তাদের নিরাপত্তা বিধান করা প্রতিনিধিদের দায়িত্ব। দৃশ্যমান ধুলা যখন মানুষকে মহামারির মতো অসুস্থ করতে শুরু করবে, তখন কি তাদের টনক নড়বে? সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে যেহেতু নিয়মিত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না, নির্মাণজনিত কারণে যেহেতু শহরে ধুলা ক্রমশ বাড়ছে, সেই চিন্তাবোধ থেকে ধুলা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে নাগরিকদের অন্যতম চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক বৃষ্টিপাত নিয়মিত হলে ধুলা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হয় না বলে বৃষ্টিহীন সময়ে রাস্তায় পানি ছিটানোর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে না, তা কেমন বিষয়!

বিশ্বের মরুপ্রবণ অনেক অঞ্চলে ধুলাবালি পরিষ্কারের অত্যানুধিক মেশিন চোখে পড়ছে ইদানীং। সেসব যন্ত্র হয়তো এখনই আমাদের দেশে ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। তবে বাঙালি হিসেবে আমরা তো সবসময়ই বিকল্প চিন্তাধারা নিয়ে পথ চলি। সেই চিন্তা থেকে সকাল-বিকাল পানি স্প্রে গাড়িগুলো শহরের প্রতিটি রাস্তায় নামালে ধুলার আধিক্যতা কমবে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। এজন্য প্রয়োজন নগর কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও নাগরিকদের প্রতি ভালোবাসা। জনগণের ভোট নেওয়ার পর নির্বাচিত হয়ে চেয়ারে বসে জনগণের ভালো-মন্দ বাছবিচার করা হবে না, এমন প্রতিনিধি হয়তো কেউই প্রত্যাশা করে না। পরিমিত বাজেট ও নির্ধারিত লোকবল থাকলে ধুলার মৌসুমে ধুলা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব, এটা বুঝতে নগর পরিকল্পনাবিদ হতে হয় না কাউকে।

আমরা প্রত্যাশা করব, রাজধানীর জনসাধারণকে সুস্থ রাখার অভিপ্রায়ে, বায়ু দূষণ প্রতিরোধে, নগরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে সিটি করপোরেশনসহ দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে কাজ করবে। নচেত দিন-দুপুরে মানুষ যেমন মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জীবনযাপন করে, তার ওপরে আবার যদি ধুলা কানে-মুখে-শরীরে প্রবেশ করে অসুস্থ করে তোলে, তবে এ যে কৃত্রিম মৃত্যুর নামান্তর। আমরা সমাধানের উপায় চোখে দেখছি; কিন্তু সেটা প্রয়োগ করা হচ্ছে না, এটার ব্যর্থতার দায়ভার কে কাঁধে নেবে? দূষণের কবলে পড়ে অতিষ্ঠ নাগরিক-জীবন থেকে মুক্তির কোনো পথ কারও জানা আছে বলে মনে হয় না। এমন অবস্থায় সৃষ্টিকর্তার কাছে বৃষ্টিপাত প্রার্থনা করা ছাড়া বিকল্পও দেখছি না।