ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিরুদ্ধ পরিবেশে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী
বিরুদ্ধ পরিবেশে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই

প্রাকৃতিক পরিবেশের আমূল পরিবর্তন আজ সহজেই চোখে ধরা পড়ে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এখন গ্রীষ্ম আর বর্ষা- শুধু এ দুই ঋতুই যেন দৃশ্যমান, বাকিগুলো চাপা পড়ে গেছে বৈশ্বিক উষ্ণতার আড়ালে। শরতের স্নিগ্ধ আকাশের দেখা মেলে না একেবারে। যে আশ্বিনে শীতের আগমনীবার্তা শোনা যায়, সে সময়ে প্রচণ্ড গরমে অস্থির মানুষ। খরায় মাঠঘাট, ক্ষেতের ফসল পুড়ে দেয়। শুকিয়ে যায় হাওর, বিল, খাল। চৈত্র থেকেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। আষাঢ়, শ্রাবণে ঘোর বর্ষকালে বৃষ্টির দেখা মেলে না। কখনও বা অতিরিক্ত জোয়ার এবং জলোচ্ছ্বাসের লবণাক্ত পানি ভূখণ্ডে ঢুকে কমিয়ে দেয় ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা। ঋতুচক্রের অস্বাভাবিক পরিবর্তনে বিনষ্ট হয়ে যায় শ্যামল বৃক্ষরাজি, পশুপাখি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামীর বাংলাদেশে ব্যাপক অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে প্রবল বন্যা, মরুময়তা, ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্র্যোগের সম্ভাবনা এরই মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। সম্প্রতি আমাজনের জঙ্গলের তীব্র আগুন এবং বাহামা দ্বীপপুঞ্জে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের বিধ্বংসী প্রভাবের প্রমাণ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশগত সমস্যা পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে প্রকট। ভৌগোলিক অবস্থান, ঘন জনবসতি, জীবিকার জন্য প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা এবং দারিদ্র্যসহ নানা কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা, পূর্বাঞ্চলের হাওর-বাঁওড়, উত্তরাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকা বিশ্বের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ হিসেবেও বাংলাদেশের নাম রয়েছে সর্বাগ্রে। ভূগর্ভস্তর থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের তথ্য অনুসারে, ঢাকা শহরের পানির স্তর বর্তমানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭০ ফুটের অধিক নিচে। বিগত ৫০ বছরে ধ্বংস হয়ে গেছে বাংলাদেশের ৫২০টি নদী।

এক আন্তর্জাতিক গবেষণার তথ্যমতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। জলবায়ুর আমূল পরিবর্তনের কারণে বন্যা ও খরারপ্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। উত্তাপ বাড়ার কারণে হিমবাহের গলন আরও বাড়বে। হিমালয় অঞ্চলে তৈরি হবে অসংখ্য হিমবাহ লেক। এসব লেকে বিস্ফোরণ হলে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বদ্বীপ বাংলাদেশ, এখানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিজনিত বিভিন্ন হুমকি ও চ্যালেঞ্জের ঝুঁকি অধিক। সেক্ষেত্রে জলবায়ুর চরমভাবাপন্ন বৈরী আচরণ এবং পরিবেশের অবনমন টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে চ্যালেঞ্জস্বরূপ।

জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের (আইপিসি) রিপোর্টে উল্লেখিত জাতিসংঘের বিজ্ঞানীদের একটি প্যানেল হুঁশিয়ার করেছে, মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে দ্রুত সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং প্রতিনিয়ত বরফ গলছে। মেরু অঞ্চলের বরফের আচ্ছাদন বিলীন হওয়ার কারণে কার্বণ নিঃসরণের মাত্রাও বেড়ে চলছে। বিভিন্ন জীবজন্তুর আবাসস্থল বদলাচ্ছে। এই শতকের শেষ ভাগে যদি বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তবে তার পরিণতি কী হতে পারে, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ভীতিকর দিক হচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সমুদ্র এবং বরফে আচ্ছাদিত অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলার ফলে প্রাণীজগতের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মানুষের নানা কর্মকাণ্ডে পরিবেশে যে বাড়তি তাপ তৈরি হচ্ছে, তার ৯০ শতাংশই শুষে নেয় সাগর। ১৯৯৩ সাল থেকে শুষে নেয়ার এই মাত্রা দ্বিগুণ বেড়েছে। একই সঙ্গে গলছে অ্যান্টার্কটিকা এবং গ্রিনল্যান্ডের বরফও। দেখা গেছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত যে হারে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলছে তা তার আগের ১০ বছরের তুলনায় তিন গুণ। জানা যায়, সারা বিশ্বে ১ লাখ ৭০ হাজার হিমবাহ রয়েছে, যা পৃথিবীর ৭ লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিদ্যমান। এ থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিও হার ৭ সেন্টিমিটার। বিশেষ করে, আন্দিজ, মধ্য ইউরোপ ও উত্তর এশিয়ায় যেসব হিমবাহ রয়েছে, সেগুলোর বরফ ২১০০ সাল নাগাদ ৮০ শতাংশ গলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এই সব বরফগলা পানি গিয়ে পড়বে সাগরে। ফলে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি নিশ্চিতকরণের জন্য জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, কার্বন নিঃসরণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ বন্ধে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে অর্থ বরাদ্দে আজও তেমন সাফল্য অর্জিত হয়নি। আইনি কাঠামো বাস্তবায়নে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্যে আসেনি অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো। অথচ প্যারিস সম্মেলনে ২০১৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না বাড়ার বাধ্যতামূলক চুক্তিরও সিদ্ধান্ত ছিল। এ ছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার লক্ষ্য নির্ধারণে ধনী দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ শতকরা ৪০ ভাগ কমিয়ে আনার কথা ছিল। চুক্তিতে আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে এনে কোপেনহেগেন ‘গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড’ গঠনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এসব উদ্যোগ উষ্ণায়ন রোধে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় ২৬তম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৬) মূল অধিবেশনে বাংলাদেশ জলবায়ু ক্ষতি কাটাতে উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত বার্ষিক ১০০ কোটি ডলার তহবিল গঠন ও অভিযোজন এবং প্রশমনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে সাশ্রয়ী মূল্যে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ প্রযুক্তি প্রদান এবং সিভিএফ দেশগুলোকে উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করতে উন্নত দেশকে আহ্বান; সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে বাস্তচ্যুত বলবায়ু অভিবাসীদের জন্য বিশ্বব্যাপী দায়বদ্ধতা ভাগ করে নেয়াসহ লোকসান ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে সমাধানের প্রস্তাব দেয়।

চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা মানুগুলোকে বাঁচাতে না পারলে বিশ্ব সভ্যতাই হুমকির মুখে পড়বে। ইন্টারন্যাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত ৬ বছরে বাংলাদেশের ৫৭ লাখ মানুষ গৃহহারা হয়েছে।

ঢাকার বস্তি এলাকায় বাসবাসকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএমও। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের সম্মুখীন হন বাংলাদেশের নারীরা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের ৮০ শতাংশই নারী। জলবায়ু, খাদ্য উৎপাদন ও নারী- তিনটি উপাদান একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯ জেলাধীন ১৪৭ উপজেলায় ২০১১ সালের আদমশুমারির ৩ কোটি ৪৮ লাখ মানুষের মধ্যে ৪৯ শতাংশ নারী। নিমজ্জিত নিম্নাঞ্চলে লবণাক্ত পানি বৃদ্ধির কারণে সেখানে বসবাসরত জনগোষ্ঠী পরিবেশগত, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যগতসহ জীবন-জীবিকাজনিত নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন। ফলে ঘটছে তাদের পেশার পরিবর্তন। কর্মস্থানের খোঁজে ত্যাগ করছে পুরান আবাসভূমি। বাড়ছে কর্মস্থানহীনতা, পরিবর্তন হচ্ছে তাদের জীবন ও জীবিকা এবং পেশার ধরন। জার্মান ওয়াচ গ্লোবালের জলবায়ু ঝুঁকি সূচক (সিআরআই-২০২১) অনুযায়ী, উপকূলীয় অঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা জীবন-জীবিকা, পরিবার, সন্তান, গবাদিপশু, দৈনন্দিন খাদ্য, পানি, জ্বালানি ও পশু সংগ্রহ, বৃক্ষরোপণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে। তাদের জন্য অন্য পেশায় স্থানান্তর সহজ নয়। ফলে তাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয় বেশি। পেশা তাদের দীর্ঘ সময় ঠান্ডা লোনা পানিতে দাঁড়িয়ে কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে তারা হৃদরোগসহ নানা শারীরিক জটিলতায় পুরুষের চেয়ে বেশি ভোগেন। মায়ের শারীরিক অসুস্থতার প্রভাব শিশু সন্তানের ওপর অধিক গিয়ে পড়ে। বর্তমান জ্বালানি ব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে জ্বালানি সংরক্ষণ, গতানুগতিক জ্বালানি চাহিদা হ্রাস, বিদ্যমান যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দক্ষতার উন্নয়ন, জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার জোরদার করাও জরুরি। বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব প্রতিরোধ নিশ্চিত করে সামষ্টিক উন্নয়নে সাহায্য-সহযোগিতা বিনিময়, উন্নত বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ, জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণসহ পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ক্ষরাসহিষ্ণু কৃষিপণ্য উৎপাদন, আধুনিক পদ্ধতিতে শস্য ও বীজ সংরক্ষণসহ কৃষিজমি রক্ষার্থে বনভূমি উজাড়, জলাধার ভরাট বন্ধ করা ভিন্ন কোনো বিকল্প নেই। বদ্বীপ হিসাবে বাংলাদেশের জন্য প্রকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০, নীতি এবং অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ডেল্টা ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্রোচ গ্রহণ পরিবেশের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় টেকসই আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত