মানুষ সামাজিক জীব- এই কথাটা আমরা সবাই মুখে স্বীকার করি, মানুষ একে অপরের সাহায্য ছাড়া চলতে পারি না, এই কথাটিও আমরা মুখে স্বীকার করি, আবার মানুষের মধ্যে সাম্যবাদ প্রয়োজন এটাও বিশ্বাস করি। কিন্তু আমরা অনেকেই মানতে চাই না সমাজের একজন মানুষও অশিক্ষিত নয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা সবাই দুই ভাগে বিভক্ত। শিক্ষিত ও কুশিক্ষিত- এ দুই শ্রেণি সমাজে বিদ্যমান। আমাদের তথাকথিত সমাজব্যবস্থায় আমরা তাদেরই শিক্ষিত মনে করি যারা সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট বা সনদপত্র অর্জন করেন। এ সনদপত্র ধারী মানুষগুলোকে আমরা মোটাদাগে শিক্ষিত বলে চিহ্নিত করি, সম্মান দেই। একটি সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি আলোচনা করা যায়। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা যখন এসএসসি, এইচএসসি বা সম্মান উত্তীর্ণ হয়, তখন আমরা তাদের শিক্ষিত ধরে নেই। অথচ উক্ত শিক্ষার্থীদের বয়সের অন্য আরেক দল মানুষ, যারা সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত সেলুন, শিল্প-কলকারখানা, গ্যারেজ, চায়ের দোকান ইত্যাদিতে কঠোর পরিশ্রম করছেন, আমরা তাদের শিক্ষিত ধরে নিই না। সমাজের এ বিষয়টি কী আসলেই সঠিক? আমার কাছে মনে হয় এটি সঠিক নয়। যারা বিভিন্ন বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা অর্জন করেন, তাদের প্রথম পরিচয় অক্ষর-জ্ঞান যুক্ত আর যারা পারিপার্শ্বিক সমাজ এবং প্রকৃতি থেকে শিক্ষা বা দক্ষতা অর্জন করে তাদের প্রথম পরিচয় নিরক্ষর। কিন্তু আমার মতে উভয় মানুষই শিক্ষিত। একদল সাক্ষরতার মাধ্যমে শিক্ষিত আর অন্যদল দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষিত। সত্যিকার অর্থে দুঃখ তখনই হয়, যখন অক্ষরজ্ঞানহীন হয়েও বিভিন্ন দক্ষতা অর্জন করে দেশের সেবায় নিয়োজিত, দেশপ্রেমে নিয়োজিত তাদের আমরা অশিক্ষিত বলি। আমরা যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাব, সমাজের বা দেশের উচ্চ আসনে যারা বসে আছেন, তাদের আমরা শিক্ষিত বলি। অধ্যাপক, ডাক্তার, জজ প্রমুখকে আমরা শিক্ষিত বলি এবং এটি মোটেই কোনো দোষের নয়, বরং সম্পূর্ণ সঠিক। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম ও শহরের কৃষক, রিকশাচালক, মুচি-মেথর, কামার-কুমোর ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত, যারা তাদের আমরা অশিক্ষিত মূর্খ বলে কটাক্ষ করি; অসম্মান করি। প্রকৃতপক্ষে আমাদের মধ্যে অশিক্ষিত কেউ নয়, জজ-ব্যারিস্টার যেমন শিক্ষিত তেমনি দিনমজুর রিকশাচালকরাও শিক্ষিত। আমাদের উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণি বিভাজনের পেছনে মূল কারণ মূলত অর্থনৈতিক অবস্থা।
আমরা স্ব স্ব অবস্থান থেকে সুশিক্ষিত হই। সারকথা, আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করি, অন্যের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা, দেশপ্রেম ও সুপ্ত প্রতিভা ইতিবাচকভাবে স্বীকার করি, তাহলেই আমরা প্রকৃত শিক্ষিত।
কিংবদন্তি শিল্পী সত্য সাহা খুব চমৎকার একটি গান লিখেছেন, ‘নামের বড়াই করো নাকো নাম দিয়ে কী হয়, নামের মাঝে পাবে না তো সবার পরিচয়।’ পরিশেষে, শিল্পী সত্য সাহার গানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিজের ভাষায় বলতে চাই, সাক্ষরের বড়াই করো নাকো সাক্ষর দিয়ে কী হয়? শুধু সাক্ষরের মাঝেই পাবে না তো শিক্ষিতের পরিচয়।
শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়