ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ন্যায়পরায়ণতাই ভবিষ্যৎ বিকাশের পথ

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত
ন্যায়পরায়ণতাই ভবিষ্যৎ বিকাশের পথ

শিশুর দুর্বলতার প্রতি কঠোর, যুক্তিনিষ্ঠ, খুঁতখুঁতে, সংযমী এবং অসহিষ্ণু হওয়া যতই কঠিন হোক না কেন, তা শিশুর জন্যই সবচেয়ে আগে প্রয়োজনীয়। বাহ্যিক সংযম এবং নীতিনিষ্ঠতার আড়ালে, আন্তরিকতা বজায় রেখে চলা, পূর্ণ যুক্তিনিষ্ঠতা এবং কঠোরতার আড়ালে স্নেহপূর্ণ এবং সাগ্রহ মনোযোগ প্রদান, শিশুর মানবীয় দুর্বলতাগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ এবং সেইসব দুর্বলতাগুলো থেকে তাদের মুক্তিলাভের কার্যকরী সহায়তা প্রদান- ঠিক এইভাবেই মা-বাবাদের নিজেদের শিক্ষামূলক ক্রিয়াকলাপের ভিত্তি গড়া উচিত। তার কোনো বিকল্প আছে কি না, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। অনেককেই এ বিষয়ে শিশুদের প্রতি অবিচার নিয়েও প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়। তারা বলে থাকেন যে, এসব অবিচার নাকি আসলে কঠোরতারই নামান্তর, এইসব নাকি শিশুর মনকে শক্ত করে তোলে।

আমার মনে প্রশ্ন জাগে এ জাতীয় আচরণ কি সত্যিই শিশুর মনকে শক্ত তোলে কি-না। কারণ, শিশুরা সবসময় দুর্বল, বড়দের দাপট এবং ঔদ্ধত্যের সামনে তারা সব সময়ই অসহায়। বড়রা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন বরাবর। দায়িত্বহীনতা প্রায়ই নিষ্ঠুরতার জন্ম দেয়। শিশুদের প্রতি অবিচার খুবই মারাত্মক বিষয়। এসব তাদের কোমল মনকে গভীরভাবে আহত করে এবং তার নৈতিক অনুভূতিকে ক্রমেই বিকৃত করে তোলে। তার ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না।

তবে অধিকাংশ ছেলেমেয়েই বেশ ভালোভাবেই এসব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। ঠিকমতো পড়াশোনা করে, বাড়িতে ও স্কুলে ভালো আচরণ করে, পরিশ্রমী হয়। অথচ এমনটিই বেশি দেখা যায় যে, প্রাইমারি স্কুলের সময়ে, যারা বেশ বাধ্য, তারাই কৈশোরে আমাদের জ্বালিয়ে মারে। তখন পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ার মতো। কিশোর বয়সের এইসব আচার-আচরণের জন্য আমাদের আগাম প্রস্তুতি না থাকলে, পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়।

এবার দেখা যাক, আসলে এ সংকটগুলোর সময় ঠিক কী কী ঘটে। তখন সবচেয়ে আগে তার সাবালকত্ব আসে। এখন সে আর মাত্র বয়সের দিক থেকেই বড় হয়নি, সে এখন বড় হয়েছে আত্মিক এবং শারীরিক দিক থেকেও। এই সময়ে অনেক ছোটবেলার কিছুদিন ধরে চলা একগুঁয়েমি, স্বেচ্ছাচারিতা, আত্মনির্ভরতা, আত্মকেন্দ্রিক আর আত্মনির্ভরতার অবিরাম প্রয়াসের নতুন করে আবির্ভাব ঘটে। তবে এসব শুরু হয় খুবই জটিলভাবে। এখন তার আত্মবিশ্লেষণ খুব তাড়াতাড়িই ঘটে যায়, মা-বাবা ও অন্যদের দিকে সমালোচনামূলক মূল্যায়নের ঝোঁক বাড়ে। কারও প্রতি সে তার মূল্যায়ন ঘন ঘন পরিবর্তিত করে। তার কোনো বন্ধু তাকে সাহায্যের হাত বাড়ালে সে হয়ে ওঠে তার কাছে খুব ভালো। কয়েকদিন পর ঝগড়া বাঁধলেই বলে দেবে তাকে আমি দু’চোখে দেখতে পারি না, সে আমার আসল বন্ধু নয়।

কোনো ছেলেমেয়েই এই বয়সে, পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা পছন্দ করে না। তাই মা-বাবাদেরও কম খোঁটা খেতে হয় না। কখনও হয়তো, কোনো কথা দিয়েও কথা রাখলেন না, তখনও খোঁটা শোনায়। শিক্ষকদেরও সমালোচনা করতে ছাড়ে না। সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের সমালোচনা করে। প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের সমালোচনা করে বা তাদের সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে। মনে রাখতে হবে, এসব কিন্তু মামুলি ব্যাপার নয়, বা যুক্তিহীনবিদ্বেষ থেকে আসা বা খেলাচ্ছলে সমালোচনা নয়। সে তখন জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শিখছে, সে অশান্তভাবে সব বিষয়ে তার মনের মতো অনুকরণযোগ্য প্রকৃত বীরকে খুঁজে চলেছে, যা এতদিন ধরে তাকে সবাই মিলে শোনানো হয়েছে। কারণ সে মানুষের মতো মানুষ হতে চায়। সে এখন সেই উম্মাদনায় ভুগছে।

কিশোর-কিশোরীদের অবাধ্যতাকে অসৎ সঙ্গের ফলাফল হিসাবে দেখা অনুচিত। অথবা ক্রমানবতির লক্ষণ বা শিক্ষিত করে তুলতে না পারার ব্যর্থতা হিসাবেও মনে করা উচিত নয়। এসব ঘটনায় আমরা যেসব মুক্তি খাড়া করি তা ‘এমন হবে আগে ভাবতেও পারিনি’ বা ‘আমি তো এমন আশা করিনি’। ছেলেমেয়েরা এ বয়সে এসবের পরিণাম সম্পর্কে বড়দের সাবধান বাণীগুলোকে অতি বিমূর্ত কোনো ব্যাপার বলেই মনে করে। তারা ভাবে যে, এসব ব্যক্তিগতভাবে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তারা একটা কথাই ভাবে, তা হলো- ‘মা-বাবা জানলে রক্ষে নেই’। আর কিছুই তারা ভাবে না। তারা তাদের আত্মমর্যাদাবোধের জন্যই এসব কাজ করে ফেলে। অন্যসব পরিণাম তাদের কাছে ত্চ্ছু বলেই মনে করে।

কিশোর-কিশোরীরা বড়দের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক বিষয়-আশয় এবং ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে আগ্রহী হয়। তাদের বিশ্বানুভূতি সবেমাত্র গড়ে উঠেছে। তাই তারা শৃঙ্খল ছাড়াই একসঙ্গে অনেক বিষয়ে মেতে উঠতে পারে। এসব আগ্রহে ভবিষ্যতের কোনো লক্ষ্য প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে। তাতে মজা লাগে- ব্যাস, এটুকুই। কিশোর-কিশোরীদের মারাত্মকভাবে আকৃষ্ট করে সাবালক জীবনের বাহ্যিক বিষয়গুলো। যেমন, পোশাক-পরিচ্ছেদ, চুলের স্টাইল, আতর, শ্যাম্পু, মদ, ধূমপান, খৈনি, দ্রুত বাইরে চড়া এসব। উপরন্ত তারা এখনও মানবীয় সম্পর্কগুলো ভালোভাবে চেনেই না। বড়রা যেসব নিয়ম ও বাঁধাহারা নিষেধ মেনে চলেন, তার অনেকগুলোই তাদের কাছে আজগুবি, একঘেয়ে আর অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়। এসব আচরণ, এমনকি তাদের ছোটখাটো ব্যাপারেও প্রকাশ পায়।

সাবালক জীবনের বাহ্যিক দিকগুলো অনুকরণ করা দিয়েই শুরু হয় তাদের সাবালকত্ব এবং তা সবার ক্ষেত্রেই। আর আত্মনির্ভরতার জন্যে প্রয়াস পর্যবসিত হয় অসংখ্য ভ্রম আর ভুল আর ভুল বোঝাবুঝিতে। এ ধরনের বেশির ভাগ ভুল-ভ্রান্তি অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সমাজবিরোধী ব্যাপার বলে কখনও বিবেচনা করা উচিত নয়। তবে এইসব ক্রিয়াকলাপের যথাযোগ্য মূল্য দেয়া আক্ষরিক অর্থেই প্রয়োজন। কিশোর-কিশোরী কবে নিজে থেকে উদ্যোগী হয়ে, সাহসিকতা ও ধৃষ্টতা আর স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার ফারাক বুঝতে পেরে যাবে, সেই আশায় চুপচাপ বসে থাকলে মারাত্মক ভুল হবে। এমতাবস্থায় আমাদের কী করণীয়? একদিকে বলপ্রয়োগ করাও যেমন অনুচিত, ঠিক তেমনি চুপচাপ বসে বসে নিরীক্ষণ করেও চলা যয় না। প্রশ্নটি সত্যি সত্যিই খুব জটিল। আসুন এবার আসল স্থানে দৃষ্টিপাত করা যাক।

আগে ছেলেমেয়েদের বলা হতো- ‘এটা করা উচিত নয়’। কিন্তু এখন ঠিক এই কথাটিই বলা হয় বেশির ভাগ মা-বাবাদের ক্ষেত্রে। শিশু থেকে বালক, বালক থেকে তারা যখন কৈশোরে পা দেয়, তখন এইসব সংকটজনক পর্বে অনেকেই বলে থাকেন, তাহলে কী তার অর্থ এই যে, তারা মাথায় চড়ে বসবে? তা নিশ্চয়ই নয়। তবে শিক্ষার উদ্দেশ্য; কিন্তু সব সময় দমিয়ে রাখা এবং বাধা-নিষেধের মাধ্যমে নাজেহাল করে তোলা নয়। শিক্ষা-দীক্ষার আসল এবং সর্বোপরি উদ্দেশ্যেই হচ্ছে, চরিত্রের প্রাথমিক প্রবণতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা। এ সংকটজনক পর্বই হচ্ছে আসল সময়। এটাই ঠিক সেই সন্ধিক্ষণ, যার পর্বেই শুরু হবে, এই শিক্ষা পেয়ে, ভবিষ্যৎ বিকাশের প্রকৃত পথটাকে চিনে নেয়া।

আত্মপ্রতিষ্ঠার সংজ্ঞা তথা নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমি; কিন্তু পুরোপুরিভাবে কিশোর-কিশোরীদের পক্ষকে সমর্থন করতে চাইছি না। তাছাড়া, এখানে সব কিছুই স্বজ্ঞাত নয়। বহু মা-বাবার প্রধান শিক্ষাগত ত্রুটি হচ্ছে- এই যে, তারা তাদের সন্তানদের ওপর নিজেদের অভিজ্ঞতালব্ধ এবং মানবজাতির এ যাবত অর্জিত জ্ঞানের ফলাফল চাপিয়ে দিতে অনবরত চেষ্টা করেন। কিন্তু একেবারে ছোটবেলা থেকে প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রেই নিজের অভিজ্ঞতার সব কিছুই উপলব্ধি করার অদম্য বাসনা থাকে। সেই জন্যই প্রস্তুত সত্যকে সে গ্রহণ করে অনিচ্ছায়, নিষ্ক্রিয়ভাবে। এ গ্রহণ কার্যকরী হবে কতটুকু, তার প্রশ্ন থেকেই যায়। এসবের দ্বারা সে অনুপ্রাণিত হয় না। তাই দেখা যায়, আমাদের বহু বাধানিষেধ আর হিতোপদেশে কান দিলেও তাদের নিজে নিজে জানার প্রলোভন থেকেই যায়।

তবে আসল কথা হচ্ছে, ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে সক্রিয় কাজকর্মের মধ্য দিয়েই। নিয়ম মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে তা গড়ে ওঠে না। তাই হচ্ছে তাদের বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এটা ভালো করে আমাদের বোঝা উচিত। সে জন্যেই বাস্তবিক ক্ষেত্রে, প্রায়ই তারা মা-বাবার বাধা-নিষেধ অমান্য করে। সাধারণত তা হয় গোপনে, ক্বচিৎ প্রকাশ্যে। গোপনে এসব অমান্য করলেও, পরে অবশ্য সবকিছুই খোলাখুলিভাবে স্বীকার করে নেবার সাহস দেখায়, এমনকি সবার সামনে পর্যন্ত। কিশোর বয়সের বৈশিষ্ট্যেই হচ্ছে এই যে, তখন অনেক নিয়ম লঙ্ঘন করা হয় খোলাখুলিভাবে, এমনকি সবার সামনে। তাদের উদারতা, স্বনির্ভরতা ও ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা পাওয়া উচিত সব শৈশবকাল ধরেই। কিন্তু শুধু পিতামাতা আর শিক্ষকদের উপদেশ স্মরণ রাখার মধ্য দিয়ে তা শেখা যায় না। আত্মস্থ করা যায় না। সর্বাগ্রে পরিবারের দৈনন্দিন জীবনই শিশুর মধ্যে এই গুণগুলো গড়ে তোলে। উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতার অনুভূতি যদি বিকশিত না হয়, তাহলে আত্মনির্ভরতা অর্জনের প্রয়াস সহজেই দায়িত্বহীন বিদ্রোহ আর অর্থহীন হামলার আকার ধারণ করতে পারে, এমন চিত্র প্রায়ই চোখে পড়ে। এসব কারণেই অনেক ছেলেমেয়ে ঘর ছেড়ে পালায়।

তবে আসল কথা হচ্ছে, এ ন্যায়পরায়ণতা অবশ্যই বোধগম্য হওয়া উচিত আর এই ন্যায়পরায়ণতাকে একেবারে সহজ এবং সরল করে তুলেই তাদের সামনে হাজির করতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের জটিল হয়ে ওঠা তাদের বিশ্বানুভূতি ও বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই, মা-বাবা, শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও নিজেদের যুক্তির জালটি বিস্তৃত করেই তোলা উচিত। নাহলে পরিস্থিতি ক্রমেই আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। তাই আবারও বলতে চাই, ছেলেমেয়েদের দুর্বলতার প্রতি কঠোর, যুক্তিনিষ্ঠ, খুঁতখুঁতে সংযমী এবং অসহিষ্ণু হওয়া যতই কঠিন হোক না কেন, তা তাদের স্বার্থেই সবচেয়ে প্রয়োজন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত