বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

এনডিডি জয় করতে চাই সচেতনতা

মোহাম্মদ জাকির হোসেন, সিনিয়র তথ্য অফিসার (জনসংযোগ কর্মকর্তা), সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়

প্রকাশ : ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মানব বৈচিত্র্যের অংশ। নানা ধরনের শারীরিক ও বুদ্ধিভিত্তিক সীমাবদ্ধতার কারণে তারা সমাজের মূলস্রোতধারার বাইরে। তাদের সমাজের মূলস্রোতে এনে স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিতে সরকার কাজ করছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায়, প্রতিবন্ধিতার ধরনগুলো হচ্ছে- অটিজম বা অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিসঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, বাক প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিন্ন্ড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা।

প্রতিবন্ধিতার ধরনগুলোর মধ্যে ৪টি প্রতিবন্ধিতা- অটিজম বা অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিসঅর্ডারস, ডাউন সিন্ড্রোম, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা ও সেরিব্রাল পালসিকে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী বা সংক্ষেপে এনডিডি বলে। সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট শনাক্তকৃত প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩৯ জন, যার মধ্যে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ৭৮ হাজার ২১৬ জন, ডাউন সিন্ড্রোম ৬ হাজার ০১৪ জন, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ২ লাখ ০৬ হাজার ৯৮৭ জন ও সেরিব্রাল পালসি ১ লাখ ১৩ হাজার ১৬০ জন।

অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিসঅর্ডারস মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের একটি জটিল প্রতিবন্ধকতা যার কারণে এ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের শারীরিক গঠনে কোনো ত্রুটি না থাকলেও এরা পরিবেশের সঙ্গে যথাযথভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না, যেমন ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে না পারা, নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকা। অটিজম স্পেক্ট্রামের মধ্যে সুনিশ্চিত লক্ষণগুলোর মধ্যে মৌখিক বা অমৌখিক যোগাযোগে সীমাবদ্ধতা; সামাজিক ও পারস্পরিক আচার-আচরণ, ভাব বিনিময় ও কল্পনাযুক্ত কাজকর্মের সীমাবদ্ধতা; একই ধরনের বা সীমাবদ্ধ কিছু কাজ বা আচরণের পুনরাবৃত্তি।

ডাউন সিনড্রোম একটি ক্রোমোজোমাল ডিসঅর্ডার। প্রতিটি শিশু, মা এবং বাবা থেকে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মাধ্যমে বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কোনো কারণে ২১তম জোড়ায় একটি অতিরিক্ত ক্রোমোজোমের উপস্থিতি ঘটলে তখন যে ভিন্নতা সৃষ্টি হয়, তাকে ডাউন সিনড্রোম বলে। এর কারণে বিশেষ কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং মৃদু থেকে গুরুতর মাত্রার বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা প্রকাশ পায়।

বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা হচ্ছে- কোনো ব্যক্তির বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্যভাবে বুদ্ধির বিকাশ না হওয়া। এ ধরনের প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে বয়স উপযোগী কার্যকলাপে তাৎপর্যপূর্ণ সীমাবদ্ধতা যেমন- ভাষা ব্যবহার, স্বাভাবিক আচরণ; বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকলাপে সীমাবদ্ধতা যেমন- কার্যকারণ বিশ্লেষণ, শিক্ষণ বা সমস্যা সমাধান; দৈনন্দিন কাজের দক্ষতায় সীমাবদ্ধতা যেমন- পারস্পারিক যোগাযোগ, নিজের যত্ন নেয়া, সামাজিক রীতিনীতি পালনে দক্ষতা, নিজেকে পরিচালনা করা, স্বাস্থ্য সচেতনতা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, লেখাপড়া; বুদ্ধাঙ্ক (আইকিউ) স্বাভাবিক মাত্রা অপেক্ষা কম।

সেরিব্রাল পালসি হচ্ছে মস্তিস্কের সেরিব্রামের প্যারালাইসিস। সেরিব্রাল পালসি শনাক্তকরণের উলে¬খযোগ্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে পেশী খুব শক্ত বা শিথিল থাকা; দুই পা, একপাশের হাত ও পা অথবা উভয় পাশের হাত ও পা আক্রান্ত হওয়া; হাত বা পায়ের সাধারণ নড়াচড়ায় অসামঞ্জস্যতা বা সীমাবদ্ধতা; স্বাভাবিক চলাফেরায় ভারসাম্যহীনতা-ভারসাম্য কম থাকা; যোগাযোগের সীমাবদ্ধতা; প্রায়শই খিঁচুনি হতে পারে ও মুখ থেকে লালা ঝরতে পারে; দৃষ্টি, শ্রবণ, বুদ্ধিগত বা আচরণগত সীমাবদ্ধতাও থাকতে পারে।

এনডিডি সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ধারণার পরিবর্তন জরুরি। অনেক বাবা-মা মনে করেন অটিজম প্রতিবন্ধিতা নয়, বাস্তবতা হচ্ছে অটিজম এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা। শুধু শিশুরাই অটিজমে আক্রান্ত হয় বাস্তবতা হচ্ছে এটি একটি জীবনব্যাপী অবস্থা। তবে শিশু বয়সেই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়।

অটিজম একটি রোগ, চিকিৎসায় ভালো হয় একটি ভুল ধারণা বাস্তবতা হচ্ছে অটিজম একটি স্নায়ু বিকাশজনিত অবস্থা। চিকিৎসা ও সময়মতো এবং নিয়মিত সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে প্রায় স্বাভাবিক অথবা পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে।

বাবা-মায়ের পাপের কারণে সন্তান প্রতিবন্ধী হয় এটি সমাজে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা ও কুসংস্কার, বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ প্রতিবন্ধিতার কারণ জানা যায়নি। তবে প্রতিবন্ধিতার কারণ যাই হোক না কেন, এগুলোর ওপরে বাবা-মার কোনো হাত নেই। তাই সন্তানের প্রতিবন্ধিতার জন্য বাবা-মাকে দোষারোপ বা দায়ী করা ঠিক নয়।

অনেকেই ধারণা করেন, বিদ্যালয় বা সেবাকেন্দ্রে পরিচর্যা করলেই তো শিশু ভালো হয়ে যাবার কথা বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু বিদ্যালয় বা সেবাকেন্দ্রে সীমিত সময়ের পরিচর্যা যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি বাড়িতে অভিভাবকদের পরিচর্যার ধারাবাহিকতা এবং সেবা ব্যতীত এই শিশুদের অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়।

এনডিডি শিশু ও ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিতে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা প্রতিপালন এবং আন্তর্জাতিক সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিতকল্পে অটিজমসহ স্নায়ুবিকাশজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে ২০১৩ সালে ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন’ প্রণয়ন করে। এ আইনের বিধান অনুসারে ২০১৪ সালে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা, জীবনমান উন্নয়ন, আবাসন ও পুনর্বাসনের জন্য নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এনডিডি ট্রাস্ট হতে এনডিডি ব্যক্তিদের এককালীন ১০,০০০ টাকা করে চিকিৎসা অনুদান প্রদান; অতিদরিদ্র এনডিডি শিশু ও ব্যক্তিকে বড় ধরনের চিকিৎসা ও থেরাপি সংক্রান্ত ব্যয়ের জন্য এনডিডি ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমোদনের ভিত্তিতে বিশেষ অনুদান প্রদান; এনডিডি শিশু ও ব্যক্তির মাতা-পিতা ও কেয়ারগিভারদের প্রশিক্ষণ প্রদান; বিশেষ স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান; প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা ২০১৯, প্রণয়ন করে এনডিডি শিশুদের সমন্বিত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা; এনডিডি শিক্ষার্থীদের উপযোগী শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে এনডিডি সুরক্ষা ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে বিশেষ কারিকুলাম প্রণয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এরই মধ্যে-এর গাইড লাইন প্রস্তুত করা হয়েছে; অটিজম শনাক্তকরণ ও মাত্রা নিরুপণের জন্য ‘স্মার্ট অটিজম বার্তা’ ও ‘বলতে চাই’ নামক অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এত চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে এত ভুল ধারণা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ঘরে বসে নেই। সারা বিশ্বে যেভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশেও তারা খুব বেশি পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে একাগ্রভাবে বিশ্বাসী। পাশাপাশি বেসরকারি এবং ব্যক্তি উদ্যোগেও প্রচুর কাজ হচ্ছে। সরকার আইন, নীতিমালা, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করে এগুলোর বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। প্রতিবছর ২ এপ্রিল তারিখে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস সারা দেশব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করা হয়ে থাকে এবং এ বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা প্রদান করা হয়ে থাকে। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় এবং বেশ কিছু উপজেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রগুলোতে অটিজম কর্নার চালু করা হয়েছে। বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগেও সারাদেশে বিদ্যালয় ও সেবাকেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এগুলোতে শিক্ষার পাশাপাশি এদের কর্মক্ষম করার উদ্দেশ্যে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। সরকারি প্রণোদনার কারণে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানীর বাইরে আরও প্রশিক্ষণ ও সেবাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়াও তাদের শনাক্তকরণ, চিকিৎসা, পরিচর্যা ও পুনর্বাসন সেবা নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।

আমাদের যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুযোগ ও সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করলেই প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তিরা পরিবারের ও সমাজের বোঝা না হয়ে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। তবে এই দায়িত্ব পালনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন।