অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির দৃষ্টি এখন বাংলাদেশ

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ এ বছর ৫২তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস পালন করেছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল একটি ভূখণ্ডের, যার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেন, বাংলাদেশের গর্ব করার অনেক কারণ রয়েছে। দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতি, ক্রমবর্ধমান সুশিক্ষিত কর্মী বাহিনী এবং একটি গতিশীল যুব জনগোষ্ঠী নিয়ে বাংলাদেশ দ্রুত একটি আঞ্চলিক নেতা হয়ে উঠছে। ‘জেনোসাইড থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের উদারভাবে স্বাগত জানিয়ে ও ঝুঁকিতে থাকা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে আপনারা মানবিক প্রতিশ্রুতি দেখিয়েছেন। জলবায়ু সংকটে অভিযোজন কৌশল তৈরি করে আপনারা পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা জোরদার করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেখিয়েছেন। সবার জন্য উন্মুক্ত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সমর্থনে আমরা আপনাদের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এ সবই উন্নয়নশীল, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী সমাজের বৈশিষ্ট্য। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ তার বিশাল সম্ভাবনা অর্জন করবে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্র্রত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে রূপান্তরিত তা স্বপ্ন নয় বাস্তব। আর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দারিদ্র্য পীড়িত, ক্ষুধা ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করে যেখানে মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য ছিল হাহাকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট পেশ করেন যা আজ তার কন্যা শেখ হাসিনার হাতধরে পরিণত হয়েছে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে। সেদিনের ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশটিতে বর্তমান মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৯৩ মার্কিন ডলার ও মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ৬৮৭ মার্কিন ডলার। করোনা মহামারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ সত্ত্বেও বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ধনাত্মক রাখতে সক্ষম হয়েছে- বাংলাদেশ তার অন্যতম। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৭.২৫ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভারতের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। যেখানে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যার ৮২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করেছিল, সেখান থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যা বর্তমানে ১০.৫ শতাংশ নেমে গেছে, রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলার যার বেশিরভাগ পোশাক শিল্প থেকে যেখানে বাংলাদেশ বিশ্বের ২য় বহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। আর্থসামাজিক এবং অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ বিস্ময়কর উন্নয়ন করেছে। দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ ৬৬টি সবল অর্থনীতির তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। সিইবিআর পূর্বাবাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা আজ শহর থেকে প্রান্তিক গ্রামে বিস্তৃত। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এর সুবিধা কাজে লাগিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। বাংলাদেশ ২০২২ সালের ২১ মার্চ শতভাব বিদ্যুৎতায়নের মাইলফলক স্পর্শ করে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ৯৮ শতাংশ এবং পাকিস্তান ৭৪ শতাংশ বিদ্যুৎ নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে। বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার ৭৫.২ শতাংশ, স্বাস্থ্যসেবায় শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে তার স্থান করে নিয়েছে। সর্বোপরি বলা যায় যে, সময় পেরিয়েছে, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়েছে। মাথাপিছু আয়, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দৃশ্যমান পরিবর্তন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি, বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ব্যবহার এবং সম্পদ উৎপাদন ও আহরণ দৃশ্যমানভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশ আখ্যা দেয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পথে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। এ প্রাপ্তি নিয়েই বলা যায় বাংলাদেশ দ্রুতই আঞ্চলিক নেতা হয়ে উঠছে। শুধু আঞ্চলিক নেতা নয়; বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম শক্তি চীন ও আঞ্চলিক শক্তি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নৈকট্য এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলে এই দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এ বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তির কাছে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। বিরোধী দলের অপপ্রচার ও নানা অপতৎপরতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধন করেছে, তা-ও আন্তর্জাতিক সমাজের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশকে এক সময় যেখানে বিশ্ব রাজনীতির তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও খাটো করে দেখত, সেখানে আজকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া ও অভূতপূর্ব উন্নয়ন বিশ্ব রাজনীতির বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত এবং একটি মর্যাদা সম্পন্ন জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, যাতে কেউ আমাদের দরিদ্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করে অবহেলা করতে না পারে। বাংলাদেশ এখন আর অবহেলা নয় গুরুত্বের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও বিশ্বরাজনীতি বিবেচনা করা হচ্ছে- তা বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চিঠি জ্বলন্ত প্রমাণ। তিনি তার চিঠিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিবসের শুভেচ্ছা বার্তায় লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আপনাকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ অনুধাবন করতে পারে। কারণ তারা ১৯৭১ সালে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। বাংলাদেশ যেহেতু আগামী নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাই আমি দুই দেশের জনগণের গণতন্ত্র, সমতা, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে গভীর মূল্যবোধের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের সুরক্ষিত রাখতে বাংলাদেশ যে প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছে তার জন্য আমরা অভিনন্দন জানাই। বিশেষ করে শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের অবদান সবচেয়ে বেশি। গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যানসহ আয়োজনে বাংলাদেশকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। কারণ, এই উদ্যোগ বৈশ্বিক মহামারি দমনে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। জো বাইডেন তার চিঠিতে আরও লিখেছেন, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। সহমর্মিতা এবং উদারতা চর্চায় বিশ্বে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন আপনি। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের প্রতি আমরাও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের বিরুদ্ধে- যারা নৃশংসতা চালিয়েছিল তাদের জবাবদিহিতায় আনার ক্ষেত্রেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ওই চিঠিতে জো বাইডেন আরও লিখেছেন, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে প্রভূত অর্জন করেছে।

অগ্রগতি হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নে, জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য এবং জলবায়ুবিষয়ক ইস্যুর সমাধান হয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে মানবিক সহায়তায় অংশীদারি হয়েছে। চিঠির শেষে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে জো বাইডেন বলেছেন, স্বাধীনতা উদযাপনের দিনে আমার আন্তরিক শুভকামনা আপনার এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য। তিনি চিঠি শেষ করেন- ‘জয় বাংলা’ বলে। তাই এর পরিপ্রেক্ষিত বলা যায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার উন্নয়ন পলিসি যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা অন্য অংশীজন দেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। উন্নত দেশগুলো শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তার দূরদর্শিতা স্বাগত জানান যা বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ বিশ্ব রাজনীতি শেখ হাসিনার সরকারের অন্যতম অনুপ্রেরণা।