তুচ্ছ ঘটনায় গণপিটুনি

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে

প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের মতো সমাজদেহেও নানা রোগ বাসা বাঁধে। তাই সমাজেরও সুস্থতার প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেয়া দরকার হয়ে পড়ে। তার আগে রোগ সম্পর্কে অভিহিত থাকা আবশ্যক। তবে সমাজে এমন কিছু রোগের আবির্ভাব ঘটে, যেগুলোর কার্যকারণ খুঁজে বের করা কঠিন। এরকমই একটি রোগের নাম হলো গণপিটুনিতে হতাহতের ঘটনা। লক্ষণীয়, দেশে একের পর এক ঘটছে গণপিটুনিতে প্রাণহানির ঘটনা। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সহিংস হয়ে উঠছে মানুষ। ভুল-সঠিক না ভেবে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা থেকে আইন তুলে নিচ্ছে নিজের হাতে। গুজব ছড়িয়েও অনেক ক্ষেত্রে উত্তেজিত করে তোলা হয় লোকজনকে। সর্বশেষ গত রোববার ঢাকা শিশু হাসপাতালে সাইকেল চোর সন্দেহে মো. মামুন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মামুন হত্যার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করলে শিহরিত হতে হয়। প্রকাশ, মামুনকে পিটিয়ে হত্যা করে অন্তত ১০ জন। বারবার প্রাণভিক্ষা চেয়েও তাদের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি ভুক্তভোগী। প্রথমে নিছক সন্দেহের বশে দলবদ্ধভাবে খুন করা হয় মামুনকে। দ্বিতীয়ত, কিছুক্ষণের জন্য ধরেই নেয়া হলো মামুন চুরি করেছে, তাই বলে কি তাকে খুন করতে হবে? এটি নিঃসন্দেহে সামাজিক অবক্ষয়ের চরম লক্ষণ। এমন একটি সমাজ বাস্তবিক অর্থেই প্রত্যাশিত নয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন ৯৫৪ জন। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে নিহত হয়েছেন আটজন। সর্বমোট ৯৬২ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন ঢাকা বিভাগে, ৪২৩ জন। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘শিশুদের মাথা লাগবে’ বলে গুজব ছড়ানো হয়। ওই বছর ২০ জুলাই সকালে রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেনুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, যা দেশব্যাপী বিপুল ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায়। কিন্তু এরূপ হতাহতের ঘটনার রাশ টানা সম্ভব হয়নি। এদিকে গত ২২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির প্রবেশমুখে মোবাইল ফোন ছিনতাইকারী সন্দেহে এক যুবককে গণপিটুনি দেয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ জানুয়ারি মারা যান তিনি। এসব মৃত্যু সামাজিক নৃশংসতার বহিঃপ্রকাশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুরি করার জন্য একজনকে মেরে ফেলতে হবে? যদি সামাজিক মূল্যবোধের অভাব থাকে, নৈতিকতা এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকে, তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। সব মিলিয়ে অস্থিরতা রয়েছে সমাজে। সামাজিক নীতি-নৈতিকতা নিয়ে কাজ করে এমন লোকেরও অভাব আছে। সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, সন্দেহভাজন অথবা অপরাধী হিসেবে মানুষ অনেক সময় জনরোষের মুখোমুখি হয়। তবে সমাজে নেতিবাচক ধারণার অনেকগুলো কারণও আছে। অপরাধী অনেক সময় ধরা পড়ে না, বিচারের আওতায় আসে না। এ কারণে আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না দেখিয়ে অনেকে নিজেরাই প্রতিরোধ করতে চায়। এভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।

বলা হচ্ছে, বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা না থাকায় মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। আবার পারিবারিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধেরও অভাব রয়েছে। আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না দেখিয়ে নিজেরাই প্রতিরোধ করতে চেয়েছে। তাই আইনের কঠোর প্রয়োগ হলে ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এলে এ ধরনের সহিংসতা কমবে বলে আশা করা যায়। তাই এ ধরনের ঘটনা এড়াতে বিচার ব্যবস্থায় জনগণের আস্থার যে সংকট আছে তা কাটিয়ে উঠতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে। সবাইকে এই নিয়ে সচেতন থাকতে হবে।