বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও আমাদের সতর্কতা

সৈয়দ ফারুক হোসেন, রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ফের রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার সকাল সোয়া ৬টার দিকে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে ফায়ার সার্ভিসের অন্তত ৫০টি ইউনিট। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা। রাজধানীর গুলিস্তানের বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যবসায়ীদের সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আগুনে সকাল থেকে ধোঁয়ায় পুরো আকাশ কালো হয়ে যায়। এসময় পোশাক ব্যবসায়ীদের হতাশ হয়ে রাস্তায় বসে থাকতে দেখা যায়। এ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৪ হাজার দোকান পুড়েছে। আগুনের ভয়াবহতার কারণে ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল উদ্ধার করতে পারেননি। আশপাশের অনেক দোকান থেকেও অনেক মানুষকে তাদের জিনিসপত্র বের করতে দেখা গেছে। তারা তাদের মালামাল রাস্তায় রেখেছেন। দেশে দিন দিন বেড়ে চলছে অনাকাঙ্ক্ষিত বিস্ফোরণ ও অগ্নিদুর্ঘটনা। পত্রিকা খুললে বা টেলিভিশনের সামনে বসলেই দেখা যাচ্ছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের খবর। আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অনেক মানুষ এবং এরই সঙ্গে আগুনে পুড়ে শত শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সম্পর্কে আমরা বেশির ভাগ মানুষই অসচেতন। মানবজীবনে দুর্ঘটনা সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। কিছুটা প্রাকৃতিক কিংবা দৈববলেই বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। সেই উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলাও করতে হয়। কিন্তু যখন কোনো দুর্ঘটনা নিজেদের উদাসীনতার কারণে সংঘটিত হয় এবং এর পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে, তখন তা একটি জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্যজনকই বটে। ক্ষয়ক্ষতি যেমনই হোক না কেন, আগুন কিন্তু সবসময় মারাত্মক। কারণ ছোট ছোট আগুনে মানুষ না পুড়লে পুড়ছে মানুষের স্বপ্ন। বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ড এখন একটি অহরহ ঘটনা। নানাবিধ কারণেই অগ্নিকাণ্ড ঘটে। গ্রাম-গঞ্জে অগ্নিকাণ্ডের মূলত সূত্রপাত হয় অসতর্কতা, কুপি, মাটির চুলা, মোমবাতি, মশার কয়েল, ছাইয়ের স্তূপ ও বিড়ি-সিগারেটের আগুন থেকে। গ্রাম-গঞ্জে, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, গুদামে আগুন লাগলে তাতেও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু শহর-বন্দরে, দালানকোঠা ও কল-কারখানায় আগুন লাগলে জানমালের যে পরিমাণ ক্ষতিসাধন হয় তা মাত্রাতিরিক্ত। মানুষ যতদিন না সচেতন হবে, ততদিন অগ্নিকাণ্ড ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়তে থাকবে। শুরুতেই আগুন নেভানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের সব বিভাগ থেকে ঢাকায় দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি বেশি। বিগত কয়েক বছরে দেশে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে। এতে ভারী হচ্ছে মানুষের মৃত্যুর মিছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো ছিল। ২০১০ সালের নিমতলী, ২০১২ সালে তাজরীন গার্মেন্টস, ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টা, ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ফ্যাক্টরি, ২০১৯ সালে এফআর টাওয়ার ইত্যাদি। অন্য দিকে বিস্ফোরণের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জ মসজিদে গ্যাস লিকেজ, ২০২১ সালে ঢাকার মগবাজারে গ্যাস বিস্ফোরণ ও ২০২২ সালে সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর অক্সিজেন পার-অক্সাইডজনিত বিস্ফোরণ ও প্রাণহানি জনগণকে আতঙ্কিত করেছে। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলেও ঘটেছে একাধিক অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের ঘটনা। যেহেতু পোশাক কারখানাতেই হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে কাজ করে, তাই সেখানে আগুনে প্রাণহানির আশঙ্কা সবচেযে বেশি। বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের জন্য নগর বিশেষজ্ঞরা অপরিকল্পিত নগরায়ণকেই মূলত দায়ী করেন। নগরায়ণে গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের লাইনও পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন সময় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের জন্য দাহ্য পদার্থ বহন ও মজুতের তদারকির দুর্বলতাও দায়ী। এজন্য ভবন মালিক ও ব্যবহারকারীকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। দীর্ঘ সময় পর বসতবাড়িতে ফিরলে দরজা, জানালা প্রথমে খুলতে হবে, যেন গ্যাস জমা থাকলে তা বের হতে পারে। এরপর বৈদ্যুতিক সুইচ দেয়া উচিত। ঢাকাতে অল্প জায়গায় বেশি মানুষ বসবাস করে। অনেক অপরিকল্পিত ও অবৈধ বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে। নতুন নতুন ইলেকট্রিক গ্যাজেট, ল্যাপটপ, মোবাইল চার্জারসহ অন্যান্য দাহ্য পদার্থের প্রাপ্যতা বেশি। তাই ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি। আমাদের দেশের বেশির ভাগ দালান-কোঠা, কলকারখানা, বৈদ্যুতিক সংযোগের সঠিক নিয়ম না মেনে বৈদ্যুতিক সংযোগ স্থাপন করা। এর ফলে হুটহাট শর্টসার্কিটের মাধ্যমে অগ্নিদুর্ঘটনা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া অগ্নিদুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, দাহ্য কেমিক্যাল গোডাউনে ত্রুটি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম (এসি, ফ্যান, লাইট) থেকে, বিড়ি-সিগারেটের ফেলে দেয়া জ্বলন্ত অংশ থেকে ইত্যাদি। এক বা দুইজনের অসতর্কতার দরুণ হাজারো মানুষের মৃত্যু ও ক্ষতিসাধন হয়। নিজেদের কারণে সংঘটিত এ ধ্বংসাত্মক অবস্থা থেকে ফিরে আসতে আমাদের একটু নজরদারি প্রয়োজন। অন্যথায়, আগুনের এ ক্ষতির শঙ্কা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। আমাদের দেশে বাসাবাড়িতে সবসময় গ্যাস-সংযোগের লাইনে গ্যাসের সরবরাহ থাকে না। যে কারণে কেউ কেউ চুলা অন (চালু রাখা) করে রাখেন। এর ফল হচ্ছে চুলায় গ্যাসের সরবরাহ আসার পর রান্নাঘরে গ্যাস জমে যেতে পারে। এ ছাড়া গ্যাসলাইনের রাইজার (গ্যাস সরবরাহের সংযোগস্থল) থেকে প্রায়ই গ্যাস লিকেজ (গ্যাস বের হওয়া) হয়। শপিংমল কিংবা কারখানাগুলোতে অগ্নিনিবার্পক ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে সহজে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে না। কোনো এক ফ্লোরে আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে যদি অটো-অ্যালার্মিং সিস্টেম চালু থাকে, তবে অন্য ফ্লোরে অবস্থানরতরা আগেই স্থান ত্যাগ করতে পারে। এ ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে অন্তিম মুহূর্তে সবাই বুঝতে পারে আগুন লেগেছে। ফলে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। হতাহতের সংখ্যাও বাড়ে। অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি বেশ ব্যাপক। দেশের অর্থনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করে একেকটি অগ্নিকাণ্ড। অকালে তাজা প্রাণ তো ঝরেই, সহায়-সম্বল ভস্মীভূত হয়ে নিঃস্ব হয় বহু পরিবার। অথচ ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ড থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি না। নিত্যদিনে মানুষের মৃত্যু, দেশ ও জনগণের সম্পদ নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ হলো অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণ। ৭ মার্চ, ছিদ্দিক বাজারের ৭ তলা ভবনের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবগত। রাজধানীতে এখনও রাস্তার পাশে, ফুটপাত ঘেঁষে, জনবহুল স্থানে গজিয়ে ওঠা হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয় অবলীলায়। সব ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন হতে হবে। অবকাঠামোগুলো যেন সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে তোলা হয়, এ ব্যাপারে সরকারকে যেমন ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তেমনি ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হতে হবে সবাইকে। ঘরের ভেতরে ম্যাচের কাঠি, সিগারেট, লাইটার ইত্যাদি অ্যালাউ না করা। চুলা জ্বালানো কাজে ওসব লাগলে নির্দিষ্ট স্থানে রাখা। বাড়ির বাইরেও জ্বলন্ত সিগারেট, জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি যেখানে সেখানে ছুড়ে না ফেলা। বৈদ্যুতিক তার, সার্কিট ইত্যাদি নিয়মিত চেক করা। যদি কোথাও কোনো ত্রুটি পাওয়া যায়, তাহলে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে মেরামতের ব্যবস্থা নেওয়া। অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, বৈদ্যুতিক আগুনে পানি ঢালা চলবে না। এতে আগুন ভয়াবহ রূপ নেবে। সে ক্ষেত্রে আপনাকে মেইন সুইচ অফ করে দিতে হবে। তারপরে ফোম বা বালি ছিটাতে হবে। কিন্তু পানি না। দাহ্য পদার্থ বাড়িতে না রাখা। রাখলেও সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করা। বিশেষ করে যেখানে আগুন লাগার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকে, সেখানে অবশ্যই এসব পদার্থ না রাখা। প্রতিটা কমার্শিয়াল দালানে ইমার্জেন্সি ফায়ার এক্সিট রাখা, যদি না থাকে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা করা। যদি তার পরও কেউ ব্যবস্থা করতে না চান, তাহলে আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিধান করা। ফায়ার এক্সিট না থাকলে কোনো কমার্শিয়াল ভবন নির্মাণের অনুমতি না দেয়া। অব্যবস্থাপনা যেন গেড়ে ধরেছে আমাদের! প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডে দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে ছাই হয়। পুড়ে কয়লা হয় বহু প্রাণ। সন্তানহারা হন মা, অকালে বিধবা হন পত্নী, পিতার কাঁধে ওঠে সন্তানের পোড়া লাশ। মর্মান্তিক এসব শুধু অসতর্কতার খেসারত, যা দেশ ও জাতির জন্য চরম ক্ষতির কারণ। আমরা একটু সচেতন হলেই এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলতে পারি। আমাদের দেশে বহুবার অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনায় সবারই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। গ্যাসের চুলা, খোলা চুলা, শর্টসার্কিট, সিগারেটের আগুন, গ্যাসলাইনের ছিদ্র, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক স্থাপনা বা যন্ত্রাংশ ইত্যাদি কারণে অহরহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে রাজধানীতে।

আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা সামগ্রী, ঘিঞ্জি পরিবেশ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সরু রাস্তা দিয়ে উদ্ধার সামগ্রী পৌঁছাতে কষ্টসাধ্য, অগ্নি প্রতিরোধের ব্যবস্থা বিল্ডিংয়ে না থাকা বা মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যবস্থা, ঢাকার আশপাশে বা মধ্যের নদী-খালের পানিশূন্যতার কারণে উদ্ধার কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। ফলে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড থেকে প্রচুর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটু সচেতনতা হলেই অনেক দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত বা ক্ষতির হার কমানো সম্ভব। আমরা যদি সচেতন না হই বা সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না করি ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে। জীবনযাপনে কোনো কাজেই সচেতনতার বিকল্প নেই। জেনে বুঝে আমরা যদি অচেতন থাকি, তাহলে আমাদের কোনো কাজেই সফলতা আসবে না। সচেতনতা বা সতর্কতাই সব নিরাপত্তা দিতে পারে।